Search This Blog

FCO Travel Advice

Bangladesh Travel Advice

AFRICA Travel Widget

Asia Travel Widget

Wednesday, January 19, 2011

পল্লীভ্রমণ: গন্তব্য হাজাছড়ি মারমাপল্লী

পল্লীভ্রমণ: গন্তব্য হাজাছড়ি মারমাপল্লী
মৃত্যুঞ্জয় রায়
by সাপ্তাহিক ২০০০ 13 জানুয়ারি 2011

রাঙামাটিতে টানা কয়েকদিন বৃষ্টির পর এমন একটা সূর্যস্নাত সকাল দেখে মনটা আনন্দে নেচে উঠল। খুশির আর একটা কারণ, ইউএনডিপির আমন্ত্রণে আমাদের প্রত্যন্ত এলাকার একটা মারমাপাড়ায় যাওয়ার কথা। রাঙামাটি থেকে সে পাড়াটা প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে। কাপ্তাই হ্রদের মধ্য দিয়ে বোটে যেতে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক লাগে। তবে ইউএনডিপির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সুপ্রিয় ত্রিপুরা জানালেন, ‘দাদা আপনাদের জন্য ইউএনডিপির স্পিডবোটের ব্যবস্থা হয়েছে। ডাবল ইঞ্জিনের এই স্পিডবোট মিনিটে দেড় কিলোমিটার চলে। তাই হয়তো ৪০-৪৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা সেখানে পৌঁছে যাব।’ ইউএনডিপির কর্মকর্তা সুপ্রিয় ত্রিপুরার কথা শুনে তাই আনন্দ দ্বিগুণ বেড়ে গেল। কর্ণফুলী নদী, মায়াবী পাহাড়-জলের কাপ্তাই হ্রদ, জলজঙ্গল পেরিয়ে ছুটে চলব আমরা এক অদেখা ভুবনে, অজানা দেশে।

ঠিক সাড়ে ৮টায় চাকমা রাজবাড়ির কাছে ইউএনডিপি ঘাট থেকে স্পিডবোট ছাড়ল। পেছনে ফেনিল ঢেউ তুলে তীব্র বেগে ছুটে চলল বোটটা। লেকের এদিক-ওদিকের দৃশ্যগুলো খুব দ্রুত মুছে যেতে লাগল। এমনকি ভালো লাগা দৃশ্যগুলো স্থির হয়ে একটু ভালো করে ছবি তোলার সুযোগও পেলাম না। তবে এর মধ্যেই ক্যামেরার শাটার টিপে যেতে লাগলাম, যা আসে। প্রথমেই পেরিয়ে গেলাম রাঙামাটির ব্যস্ততম বনরূপার ভাসমান বাজার। ভিয়েতনামের বাজারের মতো চিত্র এই বাজারের। শত শত নৌকা ভিড়েছে বনরূপা বাজারের ঘাটে। আনারস আর কাঁঠালের দাপটটাই যেন বেশি। নৌকায় নৌকায় চলছে বেচাকেনা, পণ্য ওঠানামা। সুপ্রিয় বলল, ‘আজ তো বুধবার। বনরূপার হাট। তাই নৌকা আর পণ্যের আনাগোনা বেশি।’
রাঙামাটিতে প্রচুর কাঁঠাল উৎপন্ন হয়। এমনও হয়, বাজারে খুব বেশি কাঁঠাল ওঠায় কখনো কখনো দাম খুব নেমে যায়। অনেকের বোটে আনার ভাড়াও ঠিকমতো ওঠে না। তবে এখন দিন অনেকটাই বদলে গেছে। ঢাকা ও চিটাগাং থেকে অনেক পার্টি আসে। প্রতি বুধবার বনরূপা থেকে কয়েক ট্রাক কাঁঠাল ও আনারস চলে যায় রাঙামাটির বাইরে। উপজাতিয়রা সাধারণত এ ধরনের কোনো ব্যবসা করেন না। কিছু স্থানীয় উপজাতিয়রা অভিযোগ করেন, একসময় রাঙামাটিতে বাঙালি ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট খুব জোরাল ছিল। সব বাঙালি ব্যাপারী একজোট হয়ে শলাপরামর্শ করে একটা দাম ঠিক করে আনারস ও কাঁঠাল কিনত। তারা যা দাম বলত সে দামেই প্রায় সবাই আনারস ও কাঁঠাল বেচতে বাধ্য হতো।
দেখা গেছে, আনারসের দাম চট্টগ্রামে দশ টাকা, সেই আনারসই রাঙামাটিতে বিক্রি হতো টাকায় একজোড়া। এমন দিনও গেছে, পিঠে ঝুড়িভর্তি করে উপজাতি মেয়েরা দশ-বারো কিলোমিটার হেঁটে রাঙামাটিতে আনারস বেচতে নিয়ে এসেছে। এসে দেখে একশ আনারস পঞ্চাশ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে না। তাই কেউ কেউ রাগ করে সেসব আনারস আর ফেরত না নিয়ে কাপ্তাই হ্রদের জলে ফেলে দিয়ে খালি ঝুড়ি নিয়ে আবার দশ-বারো কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরত। তখন তো মোবাইলের যুগ ছিল না। তাই ঢাকা বা চট্টগ্রামে আনারসের দাম কত তা উপজাতিয়রা জানতে পারত না। ফলে বাজারে পণ্য বিক্রি করতে এসে প্রায়ই তাদের ঠকতে হতো। মজার ব্যাপার হলো, তারা যে ঠকছে সেটাও অনেকে বুঝত না। ভাবত ওটাই ন্যায্য দাম। হিসাবও অনেকে ঠিকমতো বুঝত না। অনেক উপজাতি নাগরিকই শত কিংবা হাজার গুনতে পারে না, তারা প্রায়ই কুড়ি হিসাবে টাকা গোনে।
খুব সকালে বনরূপা বাজারের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জনৈক ব্যবসায়ী প্রিয়তোষ চাকমার কাছ থেকে কথাগুলো শুনছিলাম আর প্রায় একশ বছর আগেও তাদের প্রায় একই দশার কথা মনে করে লজ্জিত হচ্ছিলাম। সেকালেও অধিকাংশ উপজাতি মানুষের কাছেই বাঙালি ও মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা ‘শঠ’ হিসাবে পরিচিত ছিল। সে যুগেও এসব ব্যবসায়ী লবণ ও সাবান বিক্রি করত চড়া দামে নতুবা ধান ও অন্য শস্যের বিনিময়ে। সেেেত্রও অধিকাংশ উপজাতিই বিশ্বাস করত, ওটাই বোধহয় ন্যায্য দাম। তবে অতীতে খুব বেশি প্রয়োজন না হলে তারা পণ্য বেচতে বাজারে আসত না। সকালবেলা শোনা এসব কথা ভাবতে ভাবতেই একে একে পার হয়ে গেলাম ডিসি বাংলো ও পর্যটন। পেছনে পড়ে রইল রাঙামাটি শহর আর আকাশে হেলান দেওয়া পাহাড়গুলো।
আমরা যাচ্ছি কাপ্তাইয়ের পথে। তবে কাপ্তাই যাওয়ার পথ থেকে স্পিডবোটটা টার্ন নিল অন্যপথে। একটু এগ্রিয়ে সুপ্রিয় দেখাল বিলাইছড়ি যাওয়ার পথটাও। যেতে যেতে হ্রদের পানিটা যেন টলটলে হয়ে এলো, রাঙামাটির কাছে কর্ণফুলীর সেই ঘোলাটে রূপ নেই। কেমন শান্ত, নির্জন একটা পরিবেশ। বৃষ্টিতে দিনে দিনে লেকের পানি বাড়ছে। স্বচ্ছ সে জলের বুক যেন এক ঢাউস আয়না। সে আয়নার মধ্যে পড়েছে সবুজ অরণ্য আর নীলাভ পাহাড়ের ছায়া। কোনো কোনো পাহাড়কে ন্যাড়া করে তার বুকে জুমচাষ করা হয়েছে। সেসব জুমে চারা গজিয়ে সবে পাহাড়ের গায়ে একটা সবুজ প্রলেপ পড়েছে। ঢেউ ঢেউ সেসব সবুজ ওড়না পরা পাহাড়ের বুকগুলো হ্রদের জলে ছায়া ফেলেছে। হ্রদের বুকে ফিনফিনে বাতাসের ঢেউ অথবা স্পিডবোট থেকে ধেয়ে যাওয়া ঢেউগুলো সেসব ছবিকে রেখায় রেখায় ভেঙে দিচ্ছে। চমৎকার সে দৃশ্য। স্পিডবোট থেকে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের ঢালে ঢালে মাচাং ঘর, উপজাতিপল্লী, নৌকার আনাগোনা। এসব দেখতে দেখতে হ্রদের নির্জনতা ছেড়ে একটা জনপদের কাছাকাছি এসে পড়লাম বলে মনে হলো। সুপ্রিয় জানাল, ওটা নেভাল ক্যাম্প। আমরা জীবতলি ইউনিয়নে এসে পড়েছি। কিন্তু ওটাকে ডানে রেখে স্পিডবোট ছুটে চলল আরো দূরে। এবার আরো বেশি নির্জনতা, পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় আষাঢ়ী মেঘের মাতামাতি। এসব দৃশ্যে মুগ্ধ হতে হতেই আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্যে। এটাই সেই হাজাছড়ি অংচাজাই কারবারিপাড়া, উপজাতি মারমাদের গ্রাম।
স্পিডবোট থেকে নেমে এবার পাহাড় চূড়ায় ওঠার পালা। লাল মাটির বুক বেয়ে ওপরে ওঠার জন্য নির্দিষ্ট কোনো পথ নেই। তাই যে যেভাবে পারি সুবিধামতো হেঁটে ওপরে উঠে এলাম। উঠতে উঠতে মনে হলো আমরা যেন এক ফলবীথিতে প্রবেশ করছি। কী নেই সে পাহাড়ের ঢালে। কাঁঠাল, লিচু, আম, কুল, বেল, বেতফল, আতা, লেবু, নারকেল, পেয়ারা, তেঁতুল সব গাছই আছে। লিচু, আম, তেঁতুলগাছগুলো বেশ বড়, পুরনো। পাহাড়ের চূড়ায় উঠেই একটা বিশাল তেঁতুলগাছ চোখে পড়ল। আহ্, কী চকচক করছে সবুজ পাতাগুলো। গাছের ডালপালাভর্তি ঘন পত্রপল্লবে শীতল ছায়ার আহ্বান। দলের অঞ্জন বললেন, ‘আপনি যে কোনো মারমাপাড়ায় গেলে তেঁতুলগাছের দেখা পাবেন। তারা নতুন কোনো পাহাড়ে বসতি শুরু করার সময় প্রথম যে গাছটি লাগায় সেটি হলো তেঁতুল। শুধু পাড়ায় না, এমনকি অনেক মারমা বাড়িতেও দেখবেন তেঁতুলগাছ আছে। বলতে পারেন এটা ওদের এক ধরনের সংস্কার। ওরা ভূতপ্রেতে খুব বিশ্বাস করে। অনেক মারমাই মনে করে, দেবতাদের মতো ভূতপ্রেতদেরও পুজো দিতে বা সন্তুষ্ট রাখতে হয়। না হলে ওইসব অপদেবতা যে কোনো সময় তি করতে পারে। মারমাদের বিশ্বাস, দেবতাদের পুজো দিতে হয় তাদের কাছ থেকে বর বা আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য। আর অপদেবতাদের পুজো করতে হয় তাদের রোষ থেকে বাঁচার জন্য। পৃথিবীতে শান্তিময় জীবনের জন্য ভালো ও মন্দ এই দুটি জিনিসকেই বশে রাখার প্রয়োজন আছে।’ হয়তো তেঁতুলের সঙ্গে ভূতপ্রেতদের কোনো সম্পর্ক আছে। তাছাড়া মারমারা খুব তেঁতুল খায়। রান্নায় টক একটি অনিবার্য খাবার। ওদের এ সংস্কার আছে কি না জানি না, তবে পাড়াটায় বেশ কয়েকটা প্রাচীন তেঁতুলগাছের দেখা পেলাম।
লেক থেকে পাড়াটা প্রায় চার-পাঁচশ ফুট ওপরে হবে। তাই অত উঁচুতে জলের স্পর্শ পাওয়া কঠিন। কিন্তু কী আশ্চর্যজনকভাবে অত উঁচু পাহাড়ের মাথায় বিশাল দৈত্যের মতো তেঁতুলগাছগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে। শুধু দাঁড়িয়ে রয়েছে বললে ভুল হবে, ঘনপত্রপল্লবে সে উদ্ভিন্ন যৌবনা, থোকা থোকা হৃষ্টপুষ্ট তেঁতুল ফলে গাছটা সালঙ্কারা। পাহাড়ের ঢালে কাঁঠালগাছগুলোও কম তেজি না, সেগুলোতে কাঁঠালও ধরেছে প্রচুর। উঠতে উঠতে শুধু ফলের গাছই নয়, কিছু বাড়ির আঙিনাতে অনেক বাহারি পাতা ও ফুলের গাছও চোখে পড়ল। তবে পাড়াটার কোথাও কোনো সমতল জমি চোখে পড়ল না। পাহাড়ের চূড়া ও ঢালে ঢালে বাঁশ, কাঠ আর ছন/খড় দিয়ে তৈরি মারমাদের মাচাং ঘর। কয়েকটা মাটির দেয়াল দেওয়া টিনের ঘরও অবশ্য রয়েছে সে গাঁয়ে। আর কারবারির (পাড়াপ্রধান) বাড়িটা নতুন করে তৈরি হচ্ছে ইট-সিমেন্ট দিয়ে। কয়েকজন বাঙালি মিস্ত্রি সে ঘর তৈরির কাজ করছে। এ যেন আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের মারমাদেরও আবাসন ব্যবস্থা এবং জীবনধারা ধীরে ধীরে বদলে যাওয়ার ইঙ্গিত।
ছবি : লেখক

No comments:

Post a Comment