Search This Blog

FCO Travel Advice

Bangladesh Travel Advice

AFRICA Travel Widget

Asia Travel Widget

Monday, January 31, 2011

বাহের দেশে হাঁকাও গাড়ি

বাহের দেশে হাঁকাও গাড়ি রাসেদ শাহএইখানে ভোর নামে শিশিরের শব্দে
এইখানে সন্ধ্যারা পাতা ঝরায় শাল-সেগুনের বনে
তবু, কোথাও উধাও হয়েছে আজ নাগরিক মননে_
নিধুয়া প্রান্তর কুয়াশার শরীরে
নতুন করে বানানো খড়ের 'ছই' বসানো এত গরুর গাড়ি যখন শাল-সেগুনের ছোট্ট বনটা ছেড়ে বের হলো অত ভোরে, তখন আমরা নিজেদের পাগলামিতে নিজেরাই মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। ফুলকপি, শিম, মটরশুঁটি ক্ষেত পার হয়ে যখন কৃষকের খোলা পার হতে চলেছে গরুর গাড়ির শোভাযাত্রা, তখন কুয়াশা ভেদ করে যেন ভেসে এল এক সম্ভাষণ : বাহে...কোন্ঠে যাছেন? বিয়াবাড়ি নাকি বাহে?ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়ছে ভোররাত থেকেই। কৃষকের উঠানে মিনারের মতো পাঁজা করা খড়ের স্তূপের আড়াল ভেদ করে শ্মশ্রুমণ্ডিত সরল এক বৃদ্ধের মুখে ফুটে উঠল নরম হাসি। অবাক বিস্ময়ে শহুরে মানুষের কাণ্ডকারখানা দেখে বুঝে উঠল না কিছুই। তাঁর প্রশ্নের তেমন কোনো জবাবও দিল না কেউ, শুধু হাসল গাড়োয়ানরা।রাতভর গান, উল্লাস আর সীমাহীন আড্ডা চলেছে গাছের গুঁড়ি জ্বালানো আগুনের পাশে গোল হয়ে। সাঁওতাল মেয়েরা কোথাও নেচেছে আজ আঁচলে মনসার ফণা তুলে, মাদল বাজিয়ে নেচেছে হাত ধরে সাঁওতাল ছেলেরা। বনকুটিরের পাশে এক ছোট্ট নদী_নাম তার নর্ত। হয়তো বা নদী সে আপন মনে নৃত্যরতা_চলেছিল এঁকেবেঁকে বনের সবুজের সঙ্গে কথা কইতে কইতে। কে গো তুমি অমন নামটি রেখেছিলে মাদলের বোলে। কাল রাতে নর্ত ঘুমাতে পারেনি হঠাৎ বহুদিন পর। বনকুটিরের সামনে গাছের নিচে আগুন জ্বালিয়ে কারা যেন জেগে আছে সারা রাত? এই বন, এই নদী ঘুমাবে কী করে আজ তাদের ঘুম না পাড়িয়ে!চলার শুরুগত বছরের শেষ দিনটিতে ঢাকা থেকে উত্তরের দেশে এসে ভোরবেলা সুপরিসর বাস থেকে নামে ২১ জনের একটি দল। এই পথ আর কিছু দূর গেলে তেঁতুলিয়ার সীমান্ত, তারপর আর কিছু দূর গেলেই হিমালয়! পৌষের মাঝামাঝি সেই হিমালয়ের হিমঝরা ভোরে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি 'সিঙড়া' বনের দুয়ারে। ছোট্ট এ বন দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলায়, বাস থেকে নামতে হয় বীরগঞ্জ পার হয়ে ছয়-সাত কিলোমিটার পর বটতলীতে। বীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরে এ রকম বন আরো অনেক আছে। হয়তো একসময় যুক্ত ছিল সেসব বন একে অপরের সঙ্গে। এসব বনে মূলত শাল-সেগুনেরই বাড়-বাড়ন্ত। শোনা যায়, একসময় বন্য প্রাণীর বেশ আনাগোনা ছিল এখানে। এখন নানা রকম পাখি আর খরগোশ, শেয়াল, বনবেড়াল এসব। এসব বনকে কেন্দ্র করে একসময় রাজমহল পাহাড় থেকে তীর-ধনুক হাতে নেমে এসেছিল যেসব সাঁওতাল, ওঁড়াও, মুণ্ডা, রাজবংশী জনগোষ্ঠী_তাদের প্রধান জীবিকা ছিল শিকার এবং নানা কৃত্যে এই শিকারই ছিল বীরত্বের প্রতীক।দীর্ঘ বৃক্ষরাজির বুকচেরা মসৃণ পথ দিয়ে যেতে যেতে নিশ্চুপে পাখির ডাক শুনি বহু দিন পর নগরের বিদীর্ণ শব্দে অতিষ্ঠ কানে। আমাদের দলের (বিটিইএফ_বাংলাদেশ ট্যুরিজম এঙ্পানশন ফোরাম) এবারের ভ্রমণে উদ্দেশ্য ছিল দুটি : শীতার্ত মানুষের জন্য যৎসামান্য গরম কাপড় বিতরণ এবং এ জনপদে গরুর গাড়িতে চড়ে ইতিহাসের শেষ শোভাযাত্রা করা! প্রথম উদ্দেশ্য ভাগ করে নিয়েছে আমাদের উত্তরের দুই বন্ধু। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য সফল করেছে এক বন্ধুর নেতৃত্বে 'সিঙড়া' বনের পাশের গাঁয়ের বেশ কিছু মানুষ। আমাদের খুব শখ হয়েছিল গরুর গাড়ি ভ্রমণ করি! উত্তরবঙ্গে কোনো গাড়িয়াল ভাইয়ের সঙ্গে ধুধু প্রান্তর দিয়ে চলি চিলমারী বন্দর। কিন্তু হায়, আমাদের জানাই ছিল না যে এই শকটটি আজ বিলীন হতে চলেছে প্রায়! বেশ কয়েকটি উপজেলায় খোঁজ করে কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না একসঙ্গে ৮-১০টি গরুর গাড়ি। যদিও বা কোথাও দুই-তিনটি মেলে, সেগুলোর না আছে টোপর, না আছে সেই আদি কাঠের চাকা। হায়, গরুর গাড়ি চড়ে নাইওর যাওয়ার দিন যে শেষ! এখন গাঁয়ের শেষ বাড়িটির দুয়ার অবধি যে পেঁঁৗছে গেছে অটোরিকশা কিংবা রিকশাভ্যান। সময়ের হিসাবে তাকে অস্বীকার করি কিভাবে? শেষ অবধি পাওয়া গেল এইখানে, এই নর্ত নদীর গাঁয়ে, কিন্তু 'ছই' কই? ছই মানে গাড়ির ওপর যে টোপর থাকে সেই টোপর। নেই তাতে কি_ওরা খড় দিয়ে ছেয়ে, বাতা দিয়ে বেঁধে সুন্দর করে বানিয়ে দিল আটটি গাড়ির 'ছই'। ধুয়ে-মুছে খড় বিছিয়ে সাজিয়ে দিল। আর যদিও বা নামে 'গরুগাড়ি', আসলে গরুর বদলে মোষ। আগে গরুর গাড়ি টানত বলদ, তারা হালও বাইত। এখন হাল চষে পাওয়ার টিলার, কে পোষে আর বলদ! আমাদের ভ্রমণের প্রথম দিন রাতে ডিসেম্বরের শেষ সন্ধ্যায় চলে এল এসব গাড়ি। আর তারা জোয়াল নামিয়ে নতুন বছরের ভোর অবধি গোল হয়ে ঘিরে থাকল কতগুলো ছায়া-শরীর। মহিষরা ওম নিল ধিকিধিকি আগুনের অঁাঁচে।হাঁকাও গাড়ি তুই..প্রতিটি গাড়িতে তিনজন যাত্রী। সকালে আরো তিনজন ঢাকা থেকে এসে যোগ দিয়েছে দলে। গতকাল ছিল ঝকঝকে রোদ, আর আজ দার্জিলিংয়ের ওয়েদার! গরুর গাড়ির বহর একটা গাঁ পেরোতেই পথের ধারে দেখা মিলল স্কুল, লাগোয়া মাঠ, বটের ঝুরি আর বিশাল দিঘি। থামাও গাড়ি। এসে গেল শীতের পিঠা! সঙ্গে গরম ধোঁয়া ওঠা চা। চায়ের ধোঁয়া আর মুখের কুয়াশার ধোঁয়া মেলানোর খেলায় মেতে উঠল আমাদের দলের দুই নবদম্পতি তাদের নতুন জীবনের আনন্দে। গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা তাদের ঘিরে মজা দেখছে। জোয়ালে আবার মহিষ জুত, আবার চলো সামনে। এবার বসতি ছেড়ে বিরান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে পথ। দুই পাশে সরিষা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলুর ক্ষেত। সব যেন কেমন পরিপাটি, চকচকে, প্রাণবন্ত করে সাজানো। শিশিরভেজা পথ দিয়ে যেতে যেতে মনের ভেতর গান আসছে; কিন্তু শীতে জবুথবু হয়ে গলা দিয়ে আর সে গান বের হয় না।গরুর গাড়ি আবার একটা গাঁয়ে ঢুকে পড়ল, আর কোথা থেকে সব ছোট ছোট ছেলেমেয়ে পিলপিল করে বের হয়ে পিছু নিল শোভাযাত্রার। বউরা-মেয়েরা লাউয়ের মাচা থেকে উঁকি দেয়, কেউ কেউ রোয়াকে এসে মুখে অঁাঁচল ঢেকে সলজ্জ হেসে জানতে চায় কোথায় যাচ্ছি, বরযাত্রী নাকি? তবে 'কইনা কই বাহে...'। আমাদের একজন বলে, 'বাহে' মানে কী? আরে 'ভাই', ভাই হে...। আহা, এমন মধুর সম্বোধনে অন্যকে কত সহজে কাছে টানা! 'কইনা'র কথায় আমাদের মেয়েরা অকারণে লজ্জা পেয়ে পুলকিত হয়। ছেলেদেরও কেমন যেন লাগে, পাড়ার দুই পাশ থেকে অমন ভিড় করে আসা মানুষের কৌতুক দৃষ্টির অত কাছ ঘেঁষে পার হতে হতে কারো চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না, অথচ মাটির দিকেও তো আর তাকিয়ে থাকা যায় না! এবার যেন সত্যি সত্যিই নিজেদের বরযাত্রী মনে হতে লাগল। ছোটবেলায় যেমন দুই-একবার গিয়েছিলাম তেমন করে গাঁয়ের বাড়িতে, গাড়ির পেছনে পা ঝুলিয়ে আর আখ চিবাতে চিবাতে। আজ নতুন বছরের নতুন দিনটা কুয়াশার চাদরে থেকেও ঝকঝকে সোনালি আলোয় ভরে গেল!দেয়ালে দেয়ালে লাল রংযেমন সোনালি আলোর সূর্যাস্ত দেখা হলো বছরের শেষ বিকেলে গতকাল বনের পাশে সাঁওতাল গ্রামে। তাদের বাড়ি নিকানো হয়েছে গেরুয়া রঙের মাটির প্রলেপ আর লোকজ নকশায়_ফুল, পাতা, বন্য প্রাণী এসবে। পাড়ার মাঝখানে মাটির চার্চে যিশু আছেন বেশ! আর সব কটা ঘরের মাঝখানে উঠান। দেয়ালে দেয়ালে লাল রঙের আলপনা। সেখানে এসে পড়েছিল শেষ বিকেলের লালচে আলো। সেই গেরুয়া মাটির নকশাকে আবহে রেখে সামনে ফসলের ক্ষেতের ওপর সিঁদুর ছড়িয়ে যখন বিদায় নিল হাস্যোজ্জ্বল সূর্যটা, তখন ভাবতেই পারিনি আজ এমন গুমরে থাকবে সারা দিন। কাল দুপুর অবধি আমরা হেঁটে হেঁটে ঘুরেছি শাল-সেগুনের বুকচেরা পথে, দেখেছি স্নিগ্ধ সাঁওতাল গ্রাম আর পৌষের শীর্ণ নদীর হাঁটু পানি। আর বিকেলে বনের আরেক পথে পাখির ডাক শুনে শুনে অলস হাঁটতে হাঁটতে পেঁৗছে গিয়েছি আরেক সাঁওতাল গ্রামে। 'তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও_/ আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে; দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে/ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে/নেচে চলে_একবার_ দুইবার_তারপর হঠাৎ তাহারে/বনের হিজলগাছ ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে';
গরুর গাড়ি এবার চলতে চলতে ঢলেপড়া দুপুরে এসে দাঁড়াল এক প্রাচীন দিঘির ধারে। তার চারধার উঁচু পাড়। আশপাশে জনমানবের চিহ্ন নেই। ধুধু বিরান প্রান্তরে এই দিঘির গায়ে হেলান দিয়ে আমাদের মধ্যাহ্নভোজন। পাড়গুলো ঘাসের পরিপাটি বুননে সবুজ হয়ে আছে। দিঘির গভীর শীতল জল আমাদের টানছে, ডাকছে, কিন্তু এই হিমশীতল দিনে কেউ সাড়া দিল না। অথচ কাল অনেকেই বলেছিল দিঘি পেলে সাঁতার কাটবে। ধোঁয়া ওঠা তপ্ত খিচুড়ি এই ঠাণ্ডায় অন্য রকম স্বাদ দিল যেন। তারপর আবার যাত্রা। সন্ধ্যার মুখে গাড়ির বহর ফিরে এল বাংলোর হাতায়।
আর আঁধার ঘনিয়ে এলে ভেসে এল মাদলের বোল। লাল ফুলে খোঁপা বেঁধে লালপাড় শাড়ি কোমরে পেঁচিয়ে হাতে হাত ধরে পায়ে পা মিলিয়ে ধামসা নাচে ঘোর লাগিয়ে দিল সাঁওতাল দল। গানের সুর তার সপ্তক ছেড়ে বহুদূর যেতে চায় সেগুনের মাথায় মাথায়। কী মায়ায় নিমতেলের গন্ধ মেশে চুলের বিনুনি থেকে বাতাসের কণায়। রাত ১০টায় বড় রাস্তায় আমাদের বাস এসে দাঁড়াবে। তারই মধ্যে আরো যতটুকু পারা যায় শুষে নাও, আরো যতটুকু পারা যায় দেখে নাও! শালবনের গাঢ় অন্ধকারে সাঁওতালি সুর আর আগুনের আভার মতো সব স্মৃতিময় রং ভাসিয়ে নিয়ে যায় একটু একটু করে সময়ের দায়ে। আমরা ফিরতে থাকি, কিন্তু অস্তিত্ব থাকে সেখানেই, যেখানে প্রকৃতি তার সবুজ বিছিয়ে রেখেছে অকৃপণ আঁচলে। '...তারপর দূরে নিরুদ্দেশে/চলে যায় কুয়াশায়,_তবু জানি কোনো দিন পৃথিবীর ভিড়ে/হারাব না তারে আমি_...।'কিভাবে যাবেন : ঢাকার গাবতলী থেকে ঠাকুরগাঁওগামী নাবিল বা শ্যামলী পরিবহনের বাসে চড়তে হবে। ভাড়া ৩৫০ টাকা। নামতে হবে বীরগঞ্জের বটতলীতে। সেখান থেকে ভ্যানে করে সিঙরা বনের বিশ্রামাগারে (রেস্ট হাউস) যেতে ভাড়া লাগে ১৫ টাকা।
ছবি : হাসিব

No comments:

Post a Comment