Search This Blog

FCO Travel Advice

Bangladesh Travel Advice

AFRICA Travel Widget

Asia Travel Widget

Friday, November 19, 2010

রূপসী ও রহস্যময়ী সুন্দরবন

রূপসী ও রহস্যময়ী সুন্দরবন

আ জা দু র র হ মা ন
বিরলের লিচুবনে ঘুরে ঘুরে এক মনমরা বিকালে সুন্দরবনকে মনে করে আরও গ্রামাঞ্চলে চলে যাই। কোথাও জলাভূমি নেই। বেতনা, কাঁকশিয়ালি, চুনকুঁড়ি খুঁজতে গিয়ে ছ্যাবলাখালের দেখা মেলে। নদী নয়, নদীর কঙ্কাল। চারদিক থেকে করাল থাবা বসিয়েছে মানুষেরা। সাপের মাথায় পা পড়লে যেমন এঁকে বেঁকে কুঁকড়ে যায়, নদীটাও সেরকম কুঁকড়ে আছে। আহ্! কতো নির্মমভাবে মানুষ একে হত্যা করেছে! করুণমুখ পানে চেয়ে মায়া লাগে। নদীর নাম জানতে ইচ্ছে করে না, বরং ওর তলপেট দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে ওপাড়ের অন্য গ্রামে ঢুকে যাই। মাঝে মাঝে ধানী জমিতে সার করে লাগানো লিচুগাছ খানিক মন ভোলালেও সুন্দরবনের ছবি এসে আমাকে নোনা গন্ধের গল্প শোনায়।
সুন্দরবন—আহা মধুময় নীলডুমুর, কলাগাছিয়া। মনে আছে, সাতক্ষীরা পৌঁছে পরদিনই বাসে চেপে চলে গেছি মুন্সীগঞ্জ। তারপর শ্যামলাবাজার থেকে ভাড়ার মোটরসাইকেলে মালিককে পেছনে রেখে নিজেই খাল ধরে বন বরাবর গাবুরার দিকে চলে গেছি। দুপুরবেলা টংদোকানে বসে চা খেতে খেতে শুনেছি বাঘ, চিংড়ি আর কাঁকড়ার গল্প। গত এক বছরে বহুবার সুন্দরবনে যেতে হয়েছে কাজে কিংবা আনন্দে। খেজুরময় সাতক্ষীরার নোনা হাওয়াকে ভালোবেসে বোহেমিয়ান হয়ে চলে গেছি হরিনগর গ্রামে। মনে পড়ে বনঘেঁষা বাঘের ভয় ভরা হরিনগরের মৌয়ালদের কথা। মৌয়াল প্রধান সাঁজুনি সুন্নত গাজীর মুখটা এখনও ঝুলে আছে আমার সামনে।
সুন্দরবনগামী বাসগুলো পদে পদে থামে না বরং ৯০ কিলোমিটার দূরের মুন্সীগঞ্জকে মনে রেখে একটানা দক্ষিণে চলতে থাকে। সাতক্ষীরা থেকে কালীগঞ্জ। তারপর দেবহাটা পার হয়ে শ্যামনগরের শেষপাতে এসে লাস্ট স্টপেজ। গোটাকয়েক ঝাঁপতোলা দোকান এবং ছোট একটা বুনো বাসস্ট্যান্ড নিয়ে শ্যামলাবাজার-মুন্সীগঞ্জ। বাজার আর বনের ফারাক শুধু খোলপেটুয়া নদী। মুন্সীগঞ্জ হরিনগর কলাগাছিয়া নীলডুমুরের মতো গ্রামগুলো এতোই বনবর্তী যে, ক্ষুধার্ত বাঘেরা হামেশাই নদী সাঁতরে গ্রামগুলোতে ঢুকে পড়ে। তারপর সুযোগমত দু’একজনকে হত, আহত করে তাদের হাড় মাংস চিবিয়ে আবার বনে ফিরে যায়। দু’চার ঘর বাদেই পাওয়া যায় বাঘে খাওয়া মানুষের গল্প। ‘বিধবাদের গ্রাম’ একটি অনন্য উদাহরণ। এ গ্রামে যেসব বিধবা আছেন তাদের স্বামীদের কোনো না কোনো সময় বাঘে খেয়েছে। মাসে ছয় মাসে দু’একজনকে বাঘে ধরে, কেউ মারা পড়ে কিংবা কদাচিত্ কেউবা আহত আধখাওয়া হয়ে ফিরে আসে—এরকম ঘটনা এখানে খুব বেশি আমল পায় না।
এত কিছু জেনেও অরণ্য—পিয়াসীরা জীবন হাতে হরদম মুন্সীগঞ্জ কিংবা পার্শ্ববর্তী নীলডুমুর ঘাট থেকে নৌকা ছাড়ে। তারপর যেরকম যার সামর্থ্য ও সাহস, সেইমতো ঢুকে পড়ে ম্যানগ্রোভের রহস্যবনে। বনবাহিত নদীগুলো ডালে ডালে গিয়ে একসময় গভীর বনের অলিগলিতে হারিয়ে গেছে। বুনোগলিতে বয়ে বেড়ানো বাতাস একসময় নদীতে ঢেউ তোলে। বাওয়ালি মাঝি মৌয়ালদের নৌকোগুলো ভয়হীন চলে গেলেও ভয়ভরা চোখে আগন্তুকরা চেয়ে থাকে ঘন হেতাল বনের দিকে। নোনামাটিতে জ্বলে থাকা ম্যানগ্রোভ, থোকা থোকা শ্বাসমূলের ফলার ফাঁকে ঝাঁক ঝাঁক হরিণের পায়ের ছাপ আর বাঘের চামড়ার ডোরাকাটা হলুদ কল্পনারা যেন তাদের একেকটা মর্মাহত বিকালকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
বনজ আলোর অপার্থিব মুগ্ধরসে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে পর্যটকমন। বাঘের কামড়ে দলের কেউ মারা পড়লে বাঘের তল্লাটে সঙ্গী বাওয়ালিরা গাছে লাল কাপড় বেঁধে দেয়। সেসব লাল কাপড়ের সিগনাল এবং কলাগাছিয়ার ফরেস্ট গার্ডদের ঝোলানো সতর্কবাণী সংবলিত সাইনবোর্ড অবহেলা করে পর্যটকরা আরও গভীরে যেতে চায়। ঘোরের মধ্যেই ঢুকে পড়ে নোনামাটির জঙ্গলে। নিশিতে পাওয়া প্রকৃতি-প্রেমীদের সামনে কেওড়া, গরান, গোলপাতা, পশুর, সুন্দরীরা জবান খোলে বোধহয়। তারপর বাঘের জলজ্যান্ত পদছাপ তাদের শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে তোলে। তখন হুঁশ হয়। সুন্দরবনের সব সুন্দরকে একটানে দেখা হয় না। রহস্য আর আকাঙ্ক্ষা বুকে ফিরে আসে বনপিপাসুরা।
বনজীবী ছাড়াও সাতক্ষীরাজুড়ে আছে বিবিধবর্ণের মানুষ। ঘোনার চৌদালি সম্প্র্রদায় কিংবা গাংনিয়ার রাজবংশী অথবা দৌলুইপুরের ভগবানিয়া—কার কথা বলব! লাবসার পাশে বয়ে চলে বেতনা। নরম বেতনার ঢেউয়ে ঢেউয়ে লেখা হয় গাজী-কালু-চম্পাবতী। দেবহাটার মধ্যপথে সখিপুরের দুধ-চায়ের কথা ভাবতে ভাবতে টাউন শ্রীপুরের ইছামতি থেকে দুই বাংলার হাওয়া এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাকে। মন চলে যায় আশাশুনির দরগাপুর পার হয়ে বেহারা গ্রামে। বিচিত্র জাতি, উপজাতি আর প্রাচীন নানাবিধ পুরাকীর্তিতে পরিপূর্ণ এই সুন্দরবনী অঞ্চল—সাতক্ষীরা। আদিবাসীদের মধ্যে মুণ্ডা কিংবা নিদেনপক্ষে গাছিদের কথাই ধরা যাক। খুব সম্ভব বৈশাখের দিকে একবার আশাশুনির পিচপথে ঢুকে পড়েছিলাম। অফুরন্ত খেজুর দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। মোটরসাইকেলে যতোই এগুচ্ছি, ততই পথের দু’পাশে নিয়ম করে দেখা মিলছে শত শত খেজুর গাছের। পাথারের খাঁজে খাঁজেও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে খেজুর গাছ। মাথায় মাথায় ঝুলে আছে কমলা রংয়ের ঝুড়ি ঝুড়ি খেজুরের ঝোপা। অনবরত কমলা থোকা খেজুর দেখতে গিয়ে চোখে হলুদের ঘোর লাগে। এতদিন যেসব পাথারি গাছ চোখে ধরেনি, এখন তারাও হলুদ মাথায় জমির খাঁজে খাঁজে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারপর আনন্দিত মনেই একদিন গাছিদের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। পথের লোকজনকে গাছি বললে উত্তর না দিয়ে মুখপানে চেয়ে থাকে। পরে দু’চারজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল এ অঞ্চলে গাছি মানে শিবলি। একটানা গেরুয়া আবাদের পরে শিবলিপাড়ার ছেলেমেয়ে এবং গ্রাম্য গাছিদের নিয়ে পুকুরপাড়ে আনন্দ-বেদনার গল্পগুলোর সঙ্গে রমজান শিবলির মুখটা এখনও ছবি হয়ে আছে।
সাতক্ষীরার গ্রামগুলো মায়াময়। কোনো কোনো গ্রাম নিবিড় ছায়াঘেরা। যেমন হরিণখোলা কিংবা ভোমরার ঘোনার কথাই ধরা যাক। দ্বিতীয়বারের মতো হরিণখোলা পার হয়ে মুণ্ডাদের গ্রাম আসনানগরে গিয়েছিলাম গত বর্ষায়। নেপাল, গোপাল, তেজান মুণ্ডাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেলা গড়িয়ে গেল। তারপর বেদম কাদাপথে সাতক্ষীরা শহরের দিকে ফিরতে থাকি। পাশের গ্রামের কিছু হিন্দু পোলাপানও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে। একজন বলল, ওরা গুলকে কী বলে জানেন? বলে গিরগিল্লা, আর গুল খাওয়া মানে হলো গিরগিল্লা খাতুন। গিরগিল্লা বলেই একে অপরের গায়ে ধাক্কা মেরে হাসতে লাগল। ওরা ডাকে কেমন করে শোনেন, মনে করেন গোবিন্দকে ডাকবে, বলবে ‘গোবিন্দ কুত কুত’—মানে গোবিন্দ এদিকে আয়। ছেলেগুলো ফের আগের মতো হি হি করে ওঠে।
ওদের কাছ থেকেই জানতে পারলাম মুণ্ডারা ইঁদুরকে বিলখাসি এবং কেঁচোকে ‘উঠোন বরবটি’ বলে। মুণ্ডাপাড়া থেকে আধা কিলোমিটার দূরে বাঁকের মুখের ব্রিজ পেতে গিয়ে মাগরেবের আজান পড়ে গেল। ব্রিজের পর থেকেই মূলত মূলকাদার শুরু। আগেরবার ফেরার পথেই স্থির করেছিলাম, এবারই শেষ। এরকম বিটকেল কাদার পথে আর নয়। কিলো খানেক আসার পর আমরা বাধ্য হয়েই মূল রাস্তা ছেড়ে দিলাম। বাইপাস করে গ্রামের গলিতে ঢুকে পড়লাম। সম্ভবত নিম্নবর্গের হিন্দুপাড়া। উঠোন, গোয়াল, বারান্দা, আঙিনা যেখানে যেরকম সুযোগ টালমাটালে হাঁটছি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ভেতর একতাল চাঁদও উঠেছে। পাড়ার খাঁজে খাঁজে কুয়াশা নয়; সান্ধ্যপূজার ধূপের ধোঁয়া। নীরবতার মধ্যে হঠাত্ হঠাত্ দূরবর্তী লঞ্চের ভেঁপুর মতো উলুধ্বনি শোনা যাচ্ছে । উলুধ্বনির মাঝে মাঝে কেউ শঙ্খ বাজাচ্ছে। সহযাত্রী সাংবাদিক সুমন অনেকটা ভূত দেখার মতো আমাকে থামিয়ে দিল, ‘শুনতে পাচ্ছেন, কে যেন কাঁদছে’। কান্নার সঙ্গে খুব ধীরলয়ে ঢোল, হারমনি বাজছে। কৌতূহল আর ভয় নিয়ে আমরা কান্নার দিকে এগিয়ে গেলাম। কাছাকাছি যাওয়ার পর দেখা গেল প্রায় শ’দুয়েক নারী-পুরুষ মনসামঙ্গল পালা শুনছে। জটলার মাঝখানে লালসালু কাপড়ের রাজপোশাক গায়ে মুকুট মাথায় চাঁদ সওদাগর দাঁড়িয়ে আছে আর তার সামনে দিলীপ কেঁদে কেঁদে পাট করছে।
মনসামঙ্গল পালা
দিলীপের পাট নেয়া কালো ছেলেটা সত্যি সত্যিই কাঁদছে। চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। কোনো মেডিসিন ছাড়া এরকম অভিনয় দিয়ে চোখে পানি আনা এই প্রথম দেখলাম। খানিক আগে আমরা দিলীপের কান্নাই শুনেছিলাম। বটগাছের নিচে পালা হচ্ছে। পাশের ভাঙা ঘরকে ড্রেসিংরুম বানানো হয়েছে। এক মহিলাকে দেখলাম সেজেগুজে বসে আছে মনসাদেবীর পাট করার জন্য। বেহুলার ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য একজন ছোকরাকে পাউডার মাখিয়ে মেয়ে সাজানো হয়েছে । তার পাট বোধহয় পরের সিকোয়েন্সে হবে । সে বসে বসে বিড়ি টানছে।
সুমন ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে নিল। এরপর ড্রেসিংরুমের পাট নেয়া অভিনেতাদের নাম টুকে নিয়ে বলল, ‘চলেন’। আমরা যখন পিচের রাস্তায় উঠলাম তখন রাত আটটা। বৃষ্টি থেমে গেছে। পাথারের মধ্যে সুতোর মতো পিচপথ। চাঁদের আলোর ভিতর হু হু করে হাওয়া বইছে। এবার সুমন নিজেই ড্রাইভ করছে। আজকের অভিজ্ঞতার পর সুমন হয়তো আর আসতে চাইবে না। নানান ওজর দেখাবে। আসার সময় কার্তিক মুণ্ডা আমাকে তার মোবাইল নাম্বার দিয়েছে। বলেছে, ভাদ্র মাসের শেষ সপ্তাহে আমি যেন রিং করি। খুব নাকি মজা হয়। ব্যাপক গান-বাজনার সঙ্গে হাড়িয়া মচ্ছব। কার্তিক হাঁটতে হাঁটতে দুই লাইনের বেশি গাইতে পারল না। বলল, এখন হবে না; হাড়িয়া খেলে দেখবেন এমনি এমনি গান বের হচ্ছে। কী যেন গানটা, মনে পড়েছে
আটোল পাতে গিলেই হামার নাতি
টেংরা মাছের ঝাল লেলায় রাতি।
একটা বুনো হাওয়া এসে উড়ে যায় পাথার থেকে পাথারে। আমরা হরিণখোলার সরু পিচ ছেড়ে সদর পিচে উঠে যাই।

No comments:

Post a Comment