Search This Blog

FCO Travel Advice

Bangladesh Travel Advice

AFRICA Travel Widget

Asia Travel Widget

Sunday, March 20, 2011

হোয়াইকংয়ের কুদুম গুহা

হোয়াইকংয়ের কুদুম গুহা

সেলফোনে ‘দে ছুট’ ভ্রমণ সংঘের বন্ধুদের জানিয়ে দিলাম সামনের ছুটিতে কুদুম গুহায় যাব। বন্ধুদের প্রশ্ন, ওরে বাবা এ আবার কোনো জায়গা। উত্তর না দিয়ে শুধু ভ্রমণের তারিখটি জানিয়ে দিলাম। দুর্গম অঞ্চল, প্রতিনিয়ত বিপদে পড়ার সম্ভাবনা। তাই বাছাই করে শুধু দুঃসাহসী অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বন্ধুদের ‘গুহায়’ যাওয়ার সঙ্গী করলাম। বেশ কয়েকবার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা টাইগার জসিম, নাসিরুদ্দিন কচি ও এমরান এবারের অভিযাত্রী। ২৫ তারিখ রাতে রওনা হয়ে সকাল ১১টায় পৌঁছলাম পর্যটন নগরী কক্সবাজার। রুম বুকিং করা ছিল, তাই বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হয়নি। সে দিনটি নীল জলরাশির নোনা জলে সাঁতার আর বিশালাকৃতির ঢেউয়ে ডুব দিয়ে আনন্দে কাটিয়ে দিলাম। রাতে পূর্ণিমার আলোতে বীচের অ্যাঞ্জেল ড্রপ রেস্টুরেন্টে কাঁকড়া ভাজা খাওয়ার স্বাদ নিলাম। পরের দিন সকালে টেকনাফের হোয়াইকংয়ের উদ্দেশে যাত্রা। কক্সবাজার থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা পথ বাস জার্নি করে পৌঁছলাম হোয়াইকং বাজার। সেখান থেকে সিএনজি করে হাড়িখোলা। হাড়িখোলার কর্তব্যরত পুলিশ বাধা দিল সিকিউরিটি ছাড়া কুদুম গুহায় না যাওয়ার জন্য। কোনোভাবেই তখন তাদের কাছ থেকে অনুমতি মিলল না, যখন বিকল্প চিন্তা শুরু করলাম। কারণ ভ্রমণে গিয়ে অভিযান অসমাপ্ত রেখে ফিরেছি এমন রেকর্ড আমার ঝুলিতে নেই। হাড়িখোলার কিছুক্ষণ অবস্থান করে যা দেখলাম তা রীতিমত শিউরে ওঠার মতো। হাড়িখোলা লোক শাপলাপুর বাজারে গিয়ে পুলিশ স্কটে জনগণ ও মালবাহী গাড়িতে যেতে হয়, অন্যথায় দিন-দুপুরেই নির্ঘাত দুর্ধর্ষ ডাকাতের সম্মুখীন। কুদুম গুহা পর্যবেক্ষণের আকুল বাসনা দেখে পুলিশ ফাঁড়িতে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। নব উদ্দীপনায় ছুটলাম ফাঁড়ির পানে, ফাঁড়ির ইনচার্জ দ্বারা যেন কোনো বাধা না আসে সে জন্য ত্বরিত গতিতে অবহিত করলাম আমার শ্রদ্ধেয় সচিবালয়ের সহকারী কর্মকর্তা শরফুদ্দিন আহম্মেদ রাজু ভাইকে। ফোনে তিনি আমাকে নিরাশ না করে শুধু ফাঁড়ি পৌঁছতে কতক্ষণ সময় লাগবে তা জেনে নিলেন। এরই মধ্যে ফাঁড়ি পৌঁছে ইনচার্জ জাহের সাহেবের শরণাপন্ন হলাম। ঢাকা থেকে এসেছি জেনেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফোর্স রেডি করে আমাদের সঙ্গে গুহা যাত্রায় পাঠিয়ে দিলেন। আমাদের চারজন সদস্যের সঙ্গে চারজন অস্ত্রধারী পোশাক পরা পুলিশ, সঙ্গে আরও দুজন সিভিল পুলিশ। আমাদের ভাবসাবই এখন অন্যরকম। বীরদর্পে চান্দের (স্থানীয় ভাষায়) গাড়িতে চড়ে আবার বাংলাদেশের একমাত্র মাটির গুহা কুদুম অভিমুখে যাত্রা। হাড়িখোলায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে হাতের বামে প্রায় দুই কিলোমিটার পাহাড়, গিরি পথ, বিশালাকৃতির সেগুন, চন্দন বৃক্ষের শীতল ছায়া; কখনও বা ভয়ঙ্কর জঙ্গলের পাশ দিয়ে হেঁটে চলা। হঠাত্ হাতির পায়ের চিহ্ন দেখে থমকে দাঁড়ালাম। পুলিশ সদস্যরা অভয় দিলেন, বন্যহাতি সাধারণত কাউকে ক্ষতি করে না। ওরা মানুষের ভালোমন্দ বোঝে। একজন জানালেন, ইউনিফর্ম পরা পুলিশের ওরা শুঁড় তুলে সালাম জানায় এবং সাধারণ মানুষ মন থেকে হাতিকে মামা বললে ওরা ক্ষতি করে না। ওদের কথায় এখন বন্যহাতি দেখারও স্বাদ জাগল। কিন্তু এক উদ্দেশ্যে বের হয়ে অন্য উদ্দেশ্য যোগ হলে তাতে দুটিই ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা। তাই পরবর্তী ভ্রমণে বন্যহাতি দেখার ইচ্ছা সুপ্ত করলাম। পাহাড় থেকে পাহাড় কাঠের পাটাতনের কয়েকটি ব্রিজ পার হতেই হাজির হলাম এই মাহেন্দ্রক্ষণে। গুহার মুখে এসে আশ্চর্যে আমাদের চোখ বড় হয়ে গেল। অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাঁটু পানিতে গুহার ভেতর প্রবেশ করলাম। পানির ভাপসা গন্ধ, এরপরও আনন্দ। অন্ধকারে বাস করা পাখিদের উড়ে চলা, চামচিকার কিচিরমিচির, ঘুটঘুটে অন্ধকার। সে এক অন্যরকম রোমাঞ্চ। আমাদের সঙ্গে নেয়া টর্চ সেখানে অকেজো। ভাগ্য ভালো পুলিশ সদস্যরা তাদের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টর্চলাইট সঙ্গে নিয়েছিল। গুহার ভেতরের ওপরের অংশে টর্চের আলো পড়তেই বিস্ময়ে অবাক, ওহ্! আল্লাহ এত সুন্দর প্রাকৃতিক নিদর্শন তুমি আমাদের দিয়েছ অথচ তার সদ্ব্যবহার আমরা করতে জানি না। গুহার অন্দকারে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে মনের আনন্দে বের হয়ে এলাম। এবার চারপাশ ঘুরে দেখা হলো পাইথনের খোলস। কথা প্রসঙ্গে জানা হলো পাইথনের অন্যতম প্রিয় খাবার চামচিকা। তাই গুহার ভেতর প্রবেশ মুহূর্তে টর্চ ও শক্ত লাঠি রাখা জরুরি। গলা শুকিয়ে কাঠ, কিন্তু সঙ্গে বিশুদ্ধ পানি নেই। তখন মনে পড়ে গেল ‘দে ছুট’ ভ্রমণ সংঘের প্রথম সদস্য বন্ধু শেখ মো. মোক্তার আলীর কথা। দুর্গম অঞ্চলে ভ্রমণে যাওয়ার প্রাক্কালে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিতে কখনও ভুল হয়নি তার। তাই বন্ধুদের কিঞ্চিত্ ভর্ত্সনা করে মোক্তারের কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম।
যেতে চাইলে
ঢাকা থেকে কক্সবাজার। নিজস্ব বাহনে অথবা লিংক রোড থেকে টেকনাফের গেটলক বাসে। নামতে হবে হোয়াইকং বাজার। স্থানীয় ফাঁড়ি থেকে পুলিশ স্কট নিয়ে যেতে হবে কুদুম গুহা। জনপ্রতি সর্বমোট খরচ যাই হোক কক্সবাজারে কাঁকড়া ভাজার স্বাদ নিতে কিন্তু ভুলবেন না। পরিশেষে বলতে হয়, প্রকৃতির দান কুদুম গুহার প্রতি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি সুদৃষ্টি দেয় তাহলে দার্জিলিংয়ের রক গার্ডেনের চেয়ে আমাদের হোয়াইকংয়ের কুদুম গুহার নয়ন জুড়ানো অপার সৌন্দর্যের প্রাকৃতিক দৃশ্য কোনো অংশে কম হবে কি?
Source: Daily Amardesh

সী মা ন্ত দী পু
বন্যহাতির পাহাড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গুহা



গোটা দুনিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আর কোনো সৈনিক জীবিত আছে কী-না সন্দেহ, তবে সেই যুদ্ধের ক্ষতচিহ্নগুলো এখনও মুছে যায়নি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতির জাদুঘর হয়ে মানুষকে মনে করিয়ে দেয় সেই বিভীষিকার রূপকথা। শ্রদ্ধেয় মরহুম শেখ আইনউদ্দিনের কাছ থেকে এ গুহা সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। তিনি ছিলেন রয়েল ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের একজন সাহসী সৈনিক। গত হয়েছেন ১৯৯৮ সালে। তিনিই আমাকে এক গভীর গুহার খবর দিয়েছিলেন। পরে জেনেছি এ গুহাটিই নাকি ব্রিটিশ সৈন্যদের বাঁচিয়েছিল তখন। দুর্গম এ গুহার অবস্থান এক গভীর জঙ্গলের উঁচু পাহাড়ে। বর্তমান টেকনাফ শহরের কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এ পাহাড়টির নাম নাইক্ষ্যং পাহাড়। নাফ নাদীর মোহনা থেকে মস্তবড় এ পাহাড়ের দিকে তাকালে চমকে ওঠে হৃদয়। পাহাড়টির চূড়া থেকে নদীর বেয়ে চলা যেন প্রকৃতির এক অপরূপ চাহনি। মিয়ানমারের সঙ্গে এই নদী দিয়েই এক সংযোগরেখা অঙ্কন হয়েছে বাংলার।
নাইক্ষ্যংকে চিনি বহুদিনের। মূলত বন্যপ্রাণীর টানেই ভবঘুরের মতো বারবার ছুটে যাওয়া হয় সেখানে। বন্যহাতি, প্যারাইল্লা বানর আর সাম্বার হরিণের জন্য সবাই নাইক্ষ্যংকে আলাদা করে চেনেন। এখন বানর আর হরিণের জাতটির দেখা বেশ কষ্টকর হলেও হাতির পাল দেখা যায় সহজেই। হাতি হিংস্র আর ভয়ঙ্কর বলেই সবাই জানেন। ওই নাইক্ষ্যং-এ যাওয়া হয়েছে বহুবার। কত রকমের পথ বেয়ে যে তাকে উপভোগ করেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু যতবারই গেছি সবসময়ই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই গুহার কথা মনে পড়েছে। চক্কর দিয়েছি, পথের সন্ধান করেছি, তবে খুঁজে পাইনি। সবশেষে শেখ আইনউদ্দিনের কথার সুর ধরে চলতে থাকলাম এবং পথ শেষে ঠিকানা ঠিকই মিলল গুহাটির। বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে একটি দুর্গম পাহাড়ে বিশ্বযুদ্ধের চিহ্ন খুঁজে পেয়ে বহুদিনের দেখার স্বাদ পূরণ হলো। গুহাটি কীভাবে আজও দরজা ফাঁক করে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে মিয়ানমারের দিকে তা ভাবতেই অবাক লাগে। যুদ্ধের দাবানল যখন তুঙ্গে তখন মিয়ানমারের দিক থেকে এক্সিস বাহিনী বাংলার সীমানার দিকে ধেয়ে আসছিল। জার্মানি, ইতালি, জাপানিজসহ অন্যরা এ দলে ছিল। এর আগে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইনের মতো আরও কিছু দেশ এ বাহিনীর কাছে ধরাশায়ী হয়েছিল। সেসময় ভারতবর্ষজুড়ে ব্রিটিশ বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করলেও তাদের সঙ্গে ইউএসএসহ অন্য মিত্ররা মিলে স্পেশাল অ্যালাইড বাহিনী গঠন করেছিল। এক্সিস বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের ভয়ে পাহাড়ি এলাকার অ্যালাইড গ্রুপ নাইক্ষ্যং পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। মিয়ানমারের দিক থেকে নাইক্ষ্যংয়ের দিকে ছুটে আসা এক্সিস সৈনিকদের সামনে তখন শুধুই ছিল নাফ নদী। ঠিক এমন সময় আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা মেরে যুদ্ধের মোড় পুরো ঘুরিয়ে দেয়। যুদ্ধ চলে যায় অ্যালাইডদের হাতে। নাফ থেকে পিছু হঠতে থাকে এক্সিস বাহিনী। এ সময় অ্যালাইডের সৈন্যরা নাইক্ষ্যংয়ের গুহার ভেতর থেকে মুখ খুলে গর্জন ছাড়ে। জয় হয় নাইক্ষ্যংয়ের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এ গুহাটি তাই পাহাড়টিকে এনে দিয়েছে বাড়তি এক মর্যাদা। নাইক্ষ্যংয়ের আশপাশের আরও দুটি আশ্চর্য আকর্ষণ হলো তৈগা চূড়া ও কুদুমের গুহা। ভয়ঙ্কর কুদুম গুহার ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর রয়েছে হাজারও চামচিকার ভিড়।
নাইক্ষ্যং পাহাড়ের চূড়া স্বপ্নের মতো সুন্দর। এখন থেকে মিয়ানমারের পর্বতশ্রেণী দেখার মজা আরও আনন্দের। আর এই দুই পর্বতের মধ্য দিয়ে বেয়ে গেছে এ দেশে সবচেয়ে সুন্দর নদী নাফ। নাফের বেয়ে চলা, সাগরের সঙ্গে তার মিলন দেখলে সবাই পাগল হবেন তার রূপের মোহনায়। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো দু'দেশের জেলেরা এ নদীতে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে মিলেমিশে মাছ ধরে, দেখা হলে কুশল বিনিময় হয়। নদীতে আছে হরেক রকমের পরিযায়ী পাখি। আরও আছে গানজেজ ও ইরাবতি ডলফিনের দল। শুধু এই একটি পাহাড়কে ঘিরেই কত যে স্বপ্ন সমষ্টিবদ্ধ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
খুঁজে পাওয়া নাইক্ষ্যং পাহাড়ের। গুহার দরজায় দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের পর্বতশ্রেণী দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতো। পেয়েছিলাম। সে যুগে জয় হয়েছিল নাইক্ষ্যংয়েরই। পাহাড়টি এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, অ্যালাইড বাহিনী চলে গেছে। তৈরি হয়েছে দুটি দেশের আলাদা মানচিত্র। এখন এর একপাশের পাহারাদার বিডিআর, অন্যপাশে আছে নাসাকা বাহিনী। দু'দেশের সীমানার ভেতর চাইলেই আর কেউ ঢুকতে পারেন না। অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে, আছে আইন মেনে চলার কঠোর সিদ্ধান্ত। তবে সে যুগের আদিপ্রথা এখনও টিকে আছে পাহাড়ি বন্যহাতিদের বেলায়। তাদের কোনো পাসপোর্ট লাগে না। মাঝেমধ্যে মিয়ানমার পাহাড় থেকে হাতির পাল খাবার সন্ধানে চলে আসে নাইক্ষ্যংয়ের দিকে। একটা বিশেষ সময় পার করে আবার ফিরে যায় নিজ দেশে। বন্যপ্রাণীর মতো এই সম্প্রীতি সবার মধ্যে তৈরি হলেই কেবল যুদ্ধের মতো ক্ষতচিহ্নগুলো আর হবে না।
লেখক : বন্য প্রাণী গবেষক ও লেখক
Source: Daily Samakal

জীববৈচিত্র্যে কক্সবাজার

জীববৈচিত্র্যে কক্সবাজার

মোহাম্মদ ইব্রাহিম
নানা প্রজাতির মাছ আর জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এক জনপদের নাম কক্সবাজার। এখানকার জলে স্থলে সর্বত্র নানা জাতের মাছ, শামুক, ঝিনুক, পাখি আর কীটপতঙ্গ। পানির ওপর খেলা করে গাংচিলেরা। প্রকৃতি সেখানে মুহূর্তে মুহূর্তে রং বদলায়।
জেলেরা গভীর সমুদ্রে গিয়ে আহরণ করে নানা প্রজাতির মাছ। এগুলোর কিছু নাম পরিচিত, আর কিছু অপরিচিত। কোরাল, রূপচাঁদা, শাপলা, চিংড়ি, ছুরি, হাঙর, জেলিশিসসহ অসংখ্য প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, পরিবেশের ইকো সিস্টেমের ভারসাম্যহীনতার কারণে অনেক মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া গভীর সমুদ্রে বড় বড় হাঙরের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় অনেক মাছ উপকূলের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এতে সাগরে মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। জেলের জালেও আর আগের মতো মাছ আসে না।
ফিশারিজ সংশ্লিষ্টরা জানান, পারস্পরিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় বঙ্গোপসাগর আগামীতে মত্স্যশূন্য হয়ে পড়তে পারে। কারণ এক সময় (১০-১৫ বছর আগে) ফিশারিঘাটে একেকটি নৌকায় ২০ থেকে ৩০ মণ নানা জাতের সামুদ্রিক মাছ আসত। বর্তমানে একটি নৌকা কয়েক মাসেও ২০ থেকে ৩০ মণ মাছ ধরতে পারে না।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, সমুদ্রজুড়ে আধুনিক ফিশিং ট্রলারের অপ্রতিরোধ্য মত্স্য আহরণের কারণে সাগর মাছশূন্য হয়ে যাচ্ছে। এসব বোট মালিক বেশিরভাগ প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাই এরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না। সমুদ্রসীমার ৪০ ফুট গভীর জলসীমার ভেতরে এসেও এসব ফিশিং বোট মাছ ধরছে। ফলে ছোট আকারের মাছগুলোও এসব ট্রলারের মাধ্যমে মেরে নিয়ে আসা হচ্ছে। বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের ফিশিং গ্রাউন্ডে ১৩০টির বেশি আধুনিক ফিশিং ট্রলার চলছে। বর্তমান সরকারের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে নামে-বেনামে আরও ২০টি ফিশিং ট্রলারের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, থাইল্যান্ডসহ বহু দেশ অত্যাধুনিক ফিশিং বোটে মাছ শিকার নিষিদ্ধ করেছে। কারণ এক সময়ে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমার ফিশিং জোনে যথেচ্ছ মত্স্য আহরণ করায় বর্তমানে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমার ফিশিং গ্রাউন্ড প্রায় মত্স্যশূন্য হয়ে পড়েছে। আধুনিক ফিশিং বোট ব্যবহার করলে যে কোনো সময় আমাদের সমুদ্রসীমা মত্স্যশূন্য হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে মত্স্য আইনের সঠিক প্রয়োগ সব ফিশিং ট্রলারের ওপর কার্যকর প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম
Source: Daily Amardesh

বেড়িয়ে এলাম কক্সবাজার
-

বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিনের জেলা হচ্ছে কক্সবাজার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ সমারোহ এখানে। কয়েকদিন আগে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলাম। এই ভ্রমনে কক্সবাজার সম্পর্কে যা যা জানতে পেরেছি তা সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরছি।

http://i1230.photobucket.com/albums/ee492/Shanto_Balok/Coxsbazarseabeach.jpg

কক্সবাজারের যোগাযোগ ব্যাবস্হা খুব ভাল। সড়ক ও আকাশ পথে যাওয়া গেলেও রেল যোগাযোগ এখনও হয়নি। তবে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ট্রেনে গিয়ে তারপর বাসে যাওয়া যায়। তাছাড়া ঢাকা ও অন্যান্য জেলা থেকে সরাসরি বাসচলাচল করে। কক্সবাজারে রিক্সা-অটোরিক্সা সবই রয়েছে। পর্যটন এলাকা তাই তুলনামূলক ভাড়াটা একটু বেশীই। তবে চালকরা অত্যন্ত নম্র-ভদ্র, অতিথিকে যথাযথ সম্মান দিতে জানেন তাঁরা।

http://i1230.photobucket.com/albums/ee492/Shanto_Balok/CoxsbazarSunset.jpg

কক্সবাজারে থাকা-খাওয়ার সুব্যাবস্হাপনা রয়েছে। নিম্ন আয় থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত সব ধরনের মানুষের জন্য রয়েছে বিভিন্ন রেট এ আবাসিক থাকার ব্যাবস্হা। এখানে যা দেখলাম, বলতে গেলে সব হোটেলেই দরদাম করে ভাড়া ঠিক করা। কলাতলী রোডের বেশীরভাগ হোটেলের জানালা থেকেই সমুদ্র দেখা যায়।

কক্সবাজারে খাবারের দাম তুলনামূলক বেশ বেশী। প্রায় প্রতিটা আবাসিক হোটেলের সাথেই/গ্রাউন্ডে রয়েছে রেষ্টুরেন্ট। ব্যতিক্রমধর্মী কয়েকটি রেষ্টুরেন্ট রয়েছে কলাতলী মোড়ের কাছে। এগুলো উচু করে সমুদ্রের/বিচের উপর নির্মিত। এখানে বসে সমুদ্রের অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগ করার সাথে খাওয়ার মজাটাই অন্যরকম। সব রেষ্টুরেন্টে বলতে গেলে মুরগী-গরু-ইলিশ-চিংড়ি-রুঁপচাদা-লইট্যা কমন আইটেম। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের ভাজি-ভর্তা ও শুটকির আইটেমতো রয়েছেই।

মার্কেট এলাকায় প্রধান ব্যবসা হচ্ছে বার্মিক কাপড়। শহরের মার্কেট এলাকায় রাস্তার দুধার দিয়ে রয়েছে সারিসারি বার্মিজ মার্কেট। এখানে বার্মিজ বিছানার চাদর. গায়ে দেবার চাদর, ড্রেস, তোয়ালে, শীতের পোশাক ছাড়াও পাওয়া যায় বার্মিজ খাবার, শোপিচ ও রুপ সৌন্দর্যের প্রসাধন। তবে এখানে অনেক দরদাম করে জিনিস কিনতে হয়।

দর্শনীয় স্হান:
কক্সবাজারের প্রধান আকর্ষন হচ্ছে সমুদ্র সৈকত। সবচেয়ে জাঁকজমক হচ্ছে লাবনী বিচ এলাকা। পরিস্কার ঝকঝকে পরিবেশ আর নানা সুযোগ-সুবিধা রয়েছে এখানে। বিচের তীর ঘেষে রয়েছে ইজিচেয়ারে শোবার ব্যাবস্হা। চা-কফি-ডাব-মুড়ি-বাদাম সবই পাওয়া যায় এখানে কিন্তু কোন কিছু নিচে ফেলা যাবে না। এছাড়া স্পীডবোট, বিচকার, ঘোড়ায় চড়ার ব্যাবস্হা এসব তো রয়েছেই। তবে বিচে সবচেয়ে বিরক্তিকর পেশাদার ফটোগ্রাফারদের উৎপাত।

http://i1230.photobucket.com/albums/ee492/Shanto_Balok/CoxsbazarSunseteasychair-Final.jpg

***
এছাড়া একটু দূরে ইনানী বিচের সৌন্দর্যও অবশ্যই প্রশংসনীয়। এখানে পানির মধ্যে রয়েছে বড় বড় সব পাথর। ভাটার সময় তাই উকি দেয়া পাথরই সৌন্দর্য ফুঁটিয়ে তোলে এখানকার। ইনানী বিচের লাল ডাবের স্বাদই অন্যরকম। ইনানী যাবার পথে দীর্ঘ সি-ড্রাইভ অবশ্যই মুগ্ধ করবে আপনাকে। রাস্তার একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে সুদীর্ঘ সমুদ্র সৈকত পুরোটা পথ সঙ্গ দিবে আপনাকে।

http://i1230.photobucket.com/albums/ee492/Shanto_Balok/Inani.jpg

***
ইনানী বিচে যাবার পথেই দেখা মেলে হিমছড়ির। এখানে রয়েছে মনোমুগ্ধকর এক ঝর্না। সিড়ি বেয়ে অনেক উঁচু পাহাড়ে উঠে কক্সবাজারের ভিউ দেখার সুযোগ রয়েছে এখানে। সিড়ি দিয়ে উঠতে প্রথম দিকে মনে হয় এতো অল্প, পরে যেন ওঠার পথ আর শেষ হতে চায় না। অবশেষে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বিমোহিত হয়ে যেতে হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে। এছাড়াও এখানে ছোট মার্কেট ও সুন্দর করে সাজানো বিচ রয়েছে যা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষন।

http://i1230.photobucket.com/albums/ee492/Shanto_Balok/Himchorifalls-.jpg

***
এই পথেই রয়েছে সামুদ্রিক জীব-জন্তুর মিউজিয়াম। বেশ কিছু কমন-আনকমন জীবিত-মৃত প্রানী রয়েছে তাদের সংরক্ষনে। মিউজিয়ামটা সম্প্রসারনের কাজ চলছে।

http://i1230.photobucket.com/albums/ee492/Shanto_Balok/Animelmuseum.jpg

বন্যপ্রানীদের নির্বিঘ্নে চলাফেলার মুক্ত পরিবেশ রয়েছে সাফারী পার্কে। সেখানে আমার যাওয়া হয়নি।

***
কক্সবাজারের মহেশখালী বেশ সুন্দর একটা জায়গা। এখানে খুঁজে পাওয়া যায় অন্যরকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তবে এখানকার রিক্সাচালকেরা ধান্দাবাজ। ভাড়া মিটাতে গেলে বলে আপনি খুশি হয়ে যা দিবেন তাই মাথা পেতে নেবো, কোন অসুবিধা নাই। অথচ শেষে বিপদে ফেলবে অনেক টাকা ভাড়া চেয়ে। আমার কাছে ১০০০/= চেয়েছিল আমি ৫০০/= দিয়ে তারপরও না মানায় স্হানীয় লোকদের কাছে বিচার দিয়েছিলাম এবং বিচারে রায় হলো যে, আমি যা ভাড়া দিয়েছি প্রকৃত ভাড়া তার চেয়ে অনেক অনেক কম। একদম মাঠে শুকানো তরতাজা শুটকি পাওয়া যায় এখানে। শুটকির ফিল্ড ছাড়াও এখানে রয়েছে লবনের ফিল্ড। এখানকার মিষ্টি পান অতি বিখ্যাত।

http://i1230.photobucket.com/albums/ee492/Shanto_Balok/Moheshlhali.jpg

***
কক্সবাজারে বেড়াতে গেছে অথচ টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনে বেড়াতে যাননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে আমি টেকনাফ বেড়াতে গেলেও সামুদ্রিক সিগন্যাল না থাকায় সেন্টমার্টিনে যাওয়া হয়নি। টার্মিনাল থেকে সারাদিনই টেকনাফ-কক্সবাজার যাওয়া-আসার বাস রয়েছে। অনেকে মাইক্রোবাস সার্ভিসেও যাতায়াত করেন। টেকনাফ যেন প্রাকৃতিক রুপ-সৌন্দর্যের পুরোটায় কেড়ে নিয়েছে। এখানকার সমুদ্র সৈকত সম্পূর্ন নীলাভ। এতো সুন্দর তা ভাষায় প্রকাশ করে বলা যায় না। টেকনাফের আরেক সৌন্দর্য নাফ নদীতে। এখানে গেলে সুইজারল্যান্ড কিংবা নিউজিল্যান্ডের দেখা প্রাকৃতিক ছবিগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। এখানে আরও রয়েছে মনোমুগ্ধকর এক ঝর্না আর উঁচু পাহাড়ের সাথে রয়েছে বন্যপ্রানীদের অবাধ বিচরন। এই পাহাড়ে রয়েছে বন্য হাতীও।

http://i1230.photobucket.com/albums/ee492/Shanto_Balok/Teknafbeach.jpg

আপনিও বেড়িয়ে আসুন কক্সবাজার, ভাল লাগবে সেটা আমি নিশ্চিত।

সর্বশেষ সম্পাদনা করেছেন শান্ত বালক (১১-১২-২০১০ ২১:৫১)

Source: http://forum.projanmo.com

Thursday, March 10, 2011

কাঁপতে কাঁপতে কাপ্তাই!!!

কাঁপতে কাঁপতে কাপ্তাই!!!

আ হ মে দ কি শো র
পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই যাচ্ছি। কাঁপতে কাঁপতে। কারণ আমাদের হাতে অস্ত্র। মারণাস্ত্র। ভয়ে আছি। রাত ১২টা বাজে। আইসিসি বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১১-এর জন্য চারদিকে সতর্ক প্রহরা, নজরদারি চলছে। যে কোনো সময় ধরা পড়ে যেতে পারি। তবু নিরাপত্তার এই ঘেরাটোপ এড়িয়ে আমাদের যেতে হবে কাপ্তাই। কারণ সেখানে সুইডেন বাংলাদেশ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ১৮ এবং ২০ ফেব্রুয়ারি আমাদের একটি অস্ত্র প্রদর্শনীর কথা ঠিক হয়ে আছে। আমাদের হাফ প্লাটুনের দলে আছেন আমি কিশোর নামের যুবক, ভুঁড়িগির রক ওরফে রকি, পার্ট টাইম ইয়ো এবং ‘আমরা ভালো আমরা কালোর’ সভাপতি ও আহ্বায়ক মাহবুব মুন্না, এলেমদার ওরফে আলমগীর রাসেল, ঐতিহাসিক শামস্ বিশ্বাস এবং নারায়ণগঞ্জ নিবাসী নব্য ভাবুক কবি ইন্দ্রজিত্ ইমন। সবাই আতঙ্কিত। এই আতঙ্ককে বাস্তবে প্রাথমিকভাবে রূপ দিলেন ভুঁড়িগির রকি। রিকশায় চেপে কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার শুরুতেই রকি, মাহবুব মুন্না এবং শামস্ বিশ্বাসকে বহনকারী রিকশার চাকা পাংচার! রিকশাওয়ালা যাবেন না! রকি তাকে অনুনয় করে বোঝাতে সক্ষম হলো যে ভুঁড়িটাতে যে পরিমাণ গ্যাস ছিল, চাকা পাংচারের সঙ্গে টেনশনে সেটাও পাংচার হয়ে গেছে!
আমাদের সঙ্গের অস্ত্রগুলো সাদা কাপড়ে মোড়া। দেখতে অনেকটা কাফনে মোড়া লাশের মতো আকার ধারণ করেছে। শামস্ বিশ্বাস একাই সেটি কাঁধে করে নিয়ে রিকশায় চেপেছেন। পুলিশ ধরলে তাকে ধরবে। শামস্ মনে মনে উত্তরও ঠিক করে রেখেছেন। কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলবেন, ভাই এইটা একটা ইভ টিজারের লাশ। কবর দিতে যাচ্ছি কাপ্তাই!
সবকিছু ঠিকঠাক মতো কাপ্তাইগামী বাসের লাগেজ বক্সে দিয়ে আপাতত আমরা বাসে আরোহণ করতেই শুরু হলো আসল কাঁপাকাঁপি! বাসের ড্রাইভার রিখটার স্কেলের ৪ নম্বর শেকিং এম্পটিটিউড গতিতে বাস টানতে শুরু করলেন। এ পরিবহনের ড্রাইভাররা নাকি এমন স্কেলেই গাড়ি টানেন। শামস্ মন্তব্য করলেন-‘এই পরিবহনের গাড়িতে আসহাব কাহাফ কিংবা রিপ ভ্যান উইঙ্কল ঘুমাইলে হয়তো ইতিহাস অন্যরকম হইতো!’ গাড়ির ভেতরে লাইটস অফ হলো যেই মাত্র, অমনি মুন্না নিখোঁজ! অন্ধকারে তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আরেক পোচ কালি চড়াইলে যে তাকে নিগ্রো বলিয়া চালান যায়!
গাড়ি চলছে, বাসের ভেতরে বাজছে গান। বলাবাহুল্য হিন্দি। এলেমদার আলমগীর রাসেল বাসের হেলপারের উদ্দেশে বলে বসলেন, ‘ভাই বাসররাইতের গান ছাড়া আর কিছু নাই! এমনিতেই যে ভূমিকম্পের স্কেলে গাড়ি টানতে আছেন তাতে অটো মিলন হয়ে যাবেরে ভাই! এই গানের দরকার নাই!’ গান বন্ধ হলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পর শুরু হলো আর কত দিন একা থাকব....
মাঝপথে বিরতি মিলল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। সেখানে ১০ টাকা দামের পরোটা আর ষাট টাকা দামের ভাজি খেয়ে সবার ‘দশেহাল’ অবস্থা। চায়ের পরিবর্তে ‘ছা’ খেয়ে তো শামস্ বিশ্বাস এবং রক রক রকি যথাক্রমে নিতম্ব এবং ভুঁড়ির ওজন কিছুটা হালকা করে এলেন। মাহবুব মুন্নাকে নোকিয়া ১১০০ টর্চ মেরে ফের শনাক্ত করে বাসে ওঠানো হলো। সে কালো এবং ভালো ছেলের মতোই বাসে উঠে আবহাওয়ার সতর্কবাণী দিতে লাগলেন একের পর এক। যা অন্ধকার ছাপিয়ে নাকের কাছে ফকফকে সাদা হয়ে বাতাসে ভেসে রইল!
বাসের ড্রাইভার একের পর এক ওভার টেকিং করে এবং সব যাত্রীকে নির্ঘুম আতঙ্কিত একটি রাত উপহার দিয়ে পৌঁছে গেলেন কাপ্তাই। আমরা বাস থেকে জিনিসপত্র নামাতে নামাতে দেখি সুইডেন বাংলাদেশ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের বেশ কয়েকজন ছাত্র আমাদের গার্ড অব অনার এবং শেল্টার দিতে লগ গেটে দাঁড়িয়ে। অস্ত্র এবং আনুষঙ্গিক বয়ে নিয়ে তারা পৌঁছে দিলেন কাছেই বিএফআইডিসির রেস্ট হাউসে। সেখানের কেয়ারটেকার পাওয়ারফুল চশমা পরিহিত চার চোখ মিলন বড়ুয়া আমার পূর্বপরিচিত। সরকারি রেস্ট হাউসের ততোধিক সরকারি কাস্টমসে বিশেষজ্ঞ তিনি। তাকে চারবার না ডাকলে তিনি সাড়া দেন না! আমাদের বরাদ্দ রুম দেখিয়ে দিলেন মিলন। একতলার দুটো রুমের বরাদ্দ হয়েছে আমাদের। সবকিছু ভালোই কেবল পুলসিরাত পাড়ি দিয়ে বাথরুমে যেতে হয়। মানে রুমের ভেতরে একটা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে টয়লেট করতে যেতে হবে এই আরকি!
আমরা অস্ত্রের হেফাজত করে বেরুলাম নাস্তা করতে। পেটে ভূমিকম্পে নাড়িভুঁড়ি নড়ে চড়ে হয়ে গেছে। সেটাকে ঠিক করা চাই। কাপ্তাইতে ভালো খাবার হোটেল নেই বললেই চলে। ঠিক তেমনি থাকার জন্যও। ফরেস্টের রেস্ট হাউসগুলোই ভরসা। যদিও অধিকাংশ সময় তা সরকারি লোকেদের বুকিং এ থাকে। তবে আগে থেকে জানালে ব্যবস্থা হতে সময় নেয় না। বাজারে নাস্তা করতে গিয়ে ডুবো তেলে ভাজা পরোটা আর ডিম দেখে সবাই তাই খেতে চাইল। কিন্তু অর্ডার দিলেও যখন আসতে দেরি হচ্ছে, তখন আমাদের হয়ে একজন হোটেল স্টাফকে যেই ওই হা ... পো... বলে ডাক দিলেন অমনি সব হাজির। সার্ভ করতে করতে হা... পো... জানালো তার আসল নাম কুদ্দুস!
আমরা খেয়ে-দেয়েই শুক্রবারকে কাজে লাগাতে ছুটে গেলাম কাপ্তাইর বিখ্যাত বাংলাদেশের একমাত্র পানি বিদ্যুত্ প্রকল্প দেখতে। সেখানে সেনাবাহিনীর জনৈক উচ্চপদস্থ অফিসারের বদৌলতে দুটি জিপে আমরা ছুটলাম মনুষ্য সৃষ্ট কৃত্রিম কাপ্তাই বাঁধ দেখতে। ১৯৫৬ সালে তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তান সরকার আমেরিকার আর্থিক সহায়তায় এই বাঁধ নির্মাণ করে। এটির কাজ শেষ হয় ১৯৬২ সালে। প্রায় ৬৭০ মিটার দীর্ঘ বাঁধটির ১৬টি স্পিলওয়ে গেট আছে, যা প্রায় সাড়ে বাহান্নো লাখ কিউসেক পানি পরিবাহিত করে বিদ্যুত্ উত্পাদনে। বাঁধের আশপাশে ছবি তোলা বিধিবদ্ধভাবে নিষিদ্ধ। যদিও আমাদের কয়েকজন ভাবছিলাম কেন গুগল আর্থ আছে না!
কাপ্তাই লেক দেখতে ইংরেজি এইচ অক্ষরের মতো। কাপ্তাই লেকের এই বৈশিষ্ট্যের দু’টি হাতের একটি কর্ণফুলী নদী, সুভলংয়ের কাছে একটি ক্যানিওন/ফাঁকায় মিলেছে। কর্ণফুলীর একটি পুরনো অংশ, কাসালং, মাইনী, চেঙ্গি এবং রিখ্যয়ং নদীই মূলত কাপ্তাই লেকের পানির ব্যবস্থা করে। বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম লেক তৈরি হলে পানিতে ডুবে যায় হাজারো একর কৃষি জমি। লেকের পানিতে ডুবে যায় সমৃদ্ধ চাকমা রাজার বাড়ি। এই নিয়ে হাহাকার আজও নাকি প্রবহমান।
সবাই জানালো ক্লান্তি নেই। আর তাই কাপ্তাই ড্যাম থেকে ফিরে হালকা রেস্ট নিয়ে ছুটলাম চিত্মরমে। কাপ্তাই মূল শহর থেকে সামান্য দক্ষিণে ওয়াগ্গাছড়া পেরুলেই নয়নাভিরাম এই গ্রামটি। এখানেই পার্বত্য অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো বৌদ্ধ বিহার জুমল্যান্ড চিদমুরঙ ক্যায়াঙ অবস্থিত। পার্বত্য আদিবাসীদের প্রিয় বৈসাবি উত্সবে এখানে মেলাসহ নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। অনুষ্ঠানের নিমিত্তে এখানে একটি স্থায়ী বেদী আছে। সেখানে বৈসাবি উত্সবে, বৈশাখে মারমা/চাকমা মেয়েরা দল বেঁধে নাচের সঙ্গে গেয়ে ওঠে—‘মুই তোমারে লই বেরেম, তোমারে মুই সোনেম গান; হাজি হাজি নাজি নাজি, সোনেম পজ্জন নানাগান... (তোমাদের নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াব, গান শোনাবো, হেসে খেলে গান গেয়ে, তোমাদের শোনাবো রূপকথার কাহিনী)’ রেস্ট হাউসে ফিরে আসার আগে বাজার থেকে গরুর দুধের চা আর গরম গরম পিঁয়াজু খেতে ভুললাম না। রাতে সুইডেন পলিটেকনিকের অসাধারণ সুন্দর ক্যাম্পাসের মাঠে আড্ডা জমলো। আমাদের আড্ডায় দারুণ সঙ্গ দিল পূর্ণিমার চাঁদ।
এ সুযোগে অস্ত্র প্রদর্শনের স্থানটি বেছে নিলাম। মাঠের আড্ডায় সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র শুভ আমাদের শোনালো নূপুর ভাবীর কথা। তাকে নিয়ে প্রচলিত মিথটি সংবেদনশীল হওয়ায় তা অনুল্লেখই রাখলাম। নূপুর ভাবীর অস্বাভাবিক মৃত্য হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর এই ক্যাম্পাস এবং এর আশপাশের অঞ্চলে প্রায়ই রাতে সাদা শাড়ি পরা নারী দেহের চলাচল এবং নূপুরের শব্দ পাওয়া যায়! ঘটনা শুনে আমরা রেস্ট হাউসে ফিরছি এ সময় আমাদের মাঝে প্রথম নূপুরের শব্দ শুনলেন কবি ইন্দ্রজিত্ ইমন। এমনিতেই বেচারা ফেসবুকের নূপুরদের নিয়ে টানা-হেঁচড়ায় আছেন এর মাঝে কাপ্তাইয়ের নূপুর ভাবী তার আত্মায় কাপন লাগিয়ে দিয়ে গেল! নূপুর ভাবীর ভয়েই কিনা জানি না, রাতে ৬ জনে একরুমে জড়ো হয়ে সবাই মিলে কার্ড খেলতে বসেছি ওমনি শুরু হলো নূপুরের আওয়াজ, তাও যেন কাচের তৈরি! ভয়ে ভয়ে সবাই ঘুমুতে গেলাম। সকালে কেয়ারটেকার মিলন বড়ুয়া জানাল রাতে কাচের জানালা ভালো করে বন্ধ করে শুতে না হলে হনুমানেরা দলবেঁধে জানালার ধারে বসে গান ধরে। হায় এই কি তবে নূপুর ভাবী মিস্ট্রি!!
শনিবার আমাদের অস্ত্র প্রদর্শনীর কথা থাকলেও ভারত-বাংলাদেশের ম্যাচের কারণে তা পিছিয়ে পরের দিন রোববার অর্থাত্ ২০ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত হয়। সকাল-সকাল তাই মাইক্রোবাস ভাড়া করে কাপ্তাই রাঙামাটির অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য সংবলিত বাইপাস সড়ক হয়ে রাঙামাটি ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম।
বাইপাস ঝাগড়াবিল বড়াদম সড়কের প্রতিটি পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অসাধারণ এক পাহাড়ি সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্য গিলে খেতে খেতে চলেছি। মাঝে মাঝে চলা থামিয়ে সেইসব অসাধারণ সুন্দরকে সাধারণ ক্যামেরায় ধরে রাখার অতি আন্তরিক চেষ্টা। রকি’তো পা ছড়িয়ে বসে গেল রাস্তার ওপর। তাকে অনুসরণ করে অন্যরা। আওলাদপাড়ায় ঢোকার মুখে ব্রিজে সেকি উল্লাস সবার। গাড়িতে গান বাজছে-ন চাং যেবার এ জাগান ছাড়ি, ইদু আগং জনমান পুরি, এ জাগাগান রইয়েদে। ম মানান জুড়ি। (এদেশ ছেড়ে আমি যেতে চাই না, এখানে আমি রয়েছি সারা জনম ধরে, এ আবাস ভূমিতেই, আমার মনপ্রাণ মিলেছে এখানে, ঠিক এখানে) মাইক্রোবাস রাঙামাটি শহরতলীর ভেতর দিয়ে আসামবস্তি, ভেদভেদি, কলেজগেট, বনরূপা হয়ে রাজবাড়ি ঘাটে। রাজবাড়ি ঘুরে বেড়াতে যাওয়ার আগে রাজবন বৌদ্ধ বিহার, চতুর্থমহারাজিক স্বর্গ আর কঠিন চিবরদানের স্থানটি দেখে নিলাম। সেখানে যুগ যুগ ধরে বাদাম বিক্রেতা মুসলিম এক লোকের সঙ্গে খাতির হয়ে গেল কবি ও কার্টুনিস্ট ইমনের। তার বাদাম মানুষ না বিহারের বানরগুলো খায়, তা নিয়ে এন্তার গবেষণা করে ফেলল সে।
আমাদের অনেকের ভাগ্যেই রাজার বাড়ির সেই অপরূপ আঙিনা আর জৌলুস দেখার সৌভাগ্য হবে না। গত বছর (১১ নভেম্বর ২০১০) রাজার বাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পুড়ে যাওয়ার আগে একবার ঘুরে গিয়েছিলাম। সেই সময় তোলা কয়েকটি ছবি স্মৃতি হিসেবে আমাদের গাইড ও বন্ধু অশোক চক্রবর্তীকে উপহার হিসেবে দিলাম। পুড়ে ছাই রাজবাড়ীর আঙিনায় দেখলাম জনৈক চাকমা ‘প্রবেশ নিষেধ’ লেখা একটি নোটিশ ঝুলাচ্ছেন। সেই সুযোগে রাজবাড়ির দোড়গোড়ায় সিমেন্টের সিংহের পিঠে চড়ে নিতে ভোলেনি মুন্না ও শামস্। রাজবাড়ির সামনে ফতে খাঁর কামানটি দেখে ইতিহাসের মজার বিষয়টি জানাল শামস্-শাহ সুজাউদ্দৌলা, ভাই আওরঙ্গজেবের ধাওয়া খেয়ে আরাকানের কাছে চাকমা রাজা ধামানার আশ্রিত হন। সে সময় সখ্যের নিদর্শন হিসেবে সুজার কন্যার সঙ্গে ধামানার পুত্র ধরম্যার বিয়ে দেয়া হয়। ১৬৬১-এর ধরম্যা রাজা হওয়ার পর অনেক চাকমা প্রভাবশালীরা মুসলমান নাম ধারণ করেন। যেমন জুবল খাঁ, জল্লাল খাঁ, ফতে খাঁ। আর তাই ফতে খাঁকে মুসলমান ভাবার কোনো কারণ নেই।
অশোকদা আগে থেকেই আমাদের জন্য একটি বোট ঠিক করে রেখেছিলেন। সেই বোটে রওনা হলাম অপরূপা ‘শিলার ডাক’ খ্যাত শুভলং ঝরনা দেখতে। সেই পথে যেতে মনের ভেতর থেকে কে যেন গেয়ে উঠল—‘কর্ণফুলী দুলি দুলি কদু যেবে কনা যেদুং চাং, মুই ত সমারে, মরে নেযানা।।’ (কর্ণফুলী দুলে দুলে কোথায় যাবে বলো না, আমিও যাব তোমার সাথে, আমাকে নাও না তোমার সাথে)। শুভলং ঝরনায় বৃষ্টির মতো ঝিরঝিরে পানি পড়ছে তাতে কি। আমরা ঝরনা ছুঁয়ে দেখতে উঠে গেলাম হাজার ফুট ওপরে। ভিজিয়ে নিলাম তৃপ্তিকে। থেকে বোটে ছুটলাম পর্যটনের ঝুলন্ত ব্রিজ দর্শনে। সেখানে ডারউইনের প্রতি কৃতজ্ঞতা শুভলং প্রদর্শনপূর্বক ঝুল তার ধরে টেনে টুনে ঝুলে বেশ ফটোসেশন হলো।
কাপ্তাই ফিরে রেস্ট হাউসে বিশ্রাম নিয়ে ছুটলাম আগামীকালের অস্ত্র প্রদর্শনীর জন্য প্রিন্সিপ্যাল জনাব বারী স্যারের সঙ্গে আলাপ করতে। তিনি খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে সাহায্য ও পরামর্শ দিলেন। ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টার মধ্যে আমরা আমাদের সিআরএনবির (কার্টুনিস্ট রাইটস নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ) অস্ত্র প্রদর্শনী মেলে ধরলাম ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীদের জন্য। হ্যাঁ, আমাদের আঁকা কার্টুন। ইভ টিজিং নামক সামাজিক অভিশাপের বিরুদ্ধে অন্যরকম এক অস্ত্রের প্রদর্শনী দেখল পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ের বিএসপিআই সাধারণ শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীরা। প্রদর্শনী উদ্বোধন করলেন অধ্যক্ষ। দুশো পাতার ভিজিটরস বুকে মতামতে মুহূর্তেই ভরে গেল সব পাতা। সেখানে বেলী নামের এক শিক্ষার্থী লিখেছেন—‘আপনাদের কার্টুন নামের এই অস্ত্রের আঘাতে পরাজিত হোক নারীর প্রতি সব অবিচার, সে হোক ইভ টিজিং নামের পাশবিকতা!’
কোলাহল মুখরিত যান্ত্রিক নগরীতে ফিরে এলাম আবারও, তখন ঊষার আলো ফুটছে কেবল আর মনের মধ্যে এক বুক আশায় সামাজিক সব অনাচারের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছেরা সাহস হয়ে আঁকড়ে ধরে আছে আমাদের অস্ত্রগুলোকে—আমাদের আঁকা ইভ টিজিং বিরোধী কার্টুনগুলোকে।

Source: Daily Amardesh

Tuesday, March 8, 2011

মৌয়ালদের সঙ্গে সুন্দরবন

মৌয়ালদের সঙ্গে সুন্দরবন

০০ লেখা মুস্তাফিজ মামুন

সুন্দরবনের অফুরন্ত সম্পদের একটি মধু। সাতক্ষীরা রেঞ্জের বিভিন্ন বনে পয়লা এপ্রিল থেকে শুরু হয় মধু সংগ্রহ অভিযান। বহুকাল ধরে মৌয়ালরা নিজস্ব পদ্ধতিতে বাঘের ভয়কে জয় করে মধু নিয়ে আসেন সুন্দরবনের গহীন থেকে। সুন্দরবন ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে মৌয়ালদের মধু সংগ্রহ দেখা হতে পারে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।

রহস্যে ঘেরা সুন্দরবন। এ বনের একেকটি রেঞ্জ পর্যটকদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আমেজে ধরা দেয়। জালের মতো বিছানো লবণাক্ত নদী আর খালের পাড়ে ঠাসবুনোট জঙ্গল। সুন্দরবনের সুন্দরী, বাইন, পশুর, গেওয়া, কেওড়া, হেতাল, কাঁকড়া, গর্জন, ধুন্দল আরো কতশত গাছ। গ্রীষ্মের শুরুতে এসব গাছে ফুল ফোটে, ঘ্রাণ ছড়ায় জঙ্গলের বাতাসে বাতাসে।

মৌমাছিরা এসব ফুল থেকে মধু নিয়ে চাক বাঁধে গাছে গাছে। গাছের ডালে জমা হয় প্রকৃতির অমূল্য দান মধু।

পশ্চিম সুন্দরবনের লাগোয়া লোকালয়ে এই মধুর উৎসকে কেন্দ্র করে লোকেরা বাস গড়েছে বহুকাল ধরে। যুগ যুগ ধরে জঙ্গলের এই মধু 'মৌয়াল' নামের এক শ্রেণীর পেশাদারের জীবিকা নির্বাহের খোরাক জুগিয়ে আসছে।

বন বিভাগ তিন মাসের জন্য মৌয়ালদের বনের ভেতরে ঢুকে মধু সংগ্রহের অনুমতি দিয়ে থাকে। সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জ কার্যালয় থেকে মেলে এ অনুমতি। পয়লা এপ্রিল যাত্রা শুরুর আগে মৌয়ালদের বনের রাজস্ব আদায়সহ কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই নৌকা ছুটাতে হয় বনের উদ্দেশে। যাত্রার শুরুতে একটি প্রার্থনা সভার মাধ্যমে মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ শেষে নিরাপদে ফিরে আসার আকুতি জানান উপরওয়ালার কাছে। প্রার্থনা শেষে প্রত্যেক মৌয়ালের হাতে বেঁধে দেওয়া হয় লাল কাপড়। তাদের বিশ্বাস, এ কাপড় বিপদ-আপদ বিশেষ করে বনের রাজার হাত থেকে রক্ষা করবে তাদের। প্রার্থনা শেষে মৌয়ালরা তাদের নৌকা নিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে অপেক্ষা করেন। বন কর্মকর্তা আকাশে গুলি ছোঁড়েন, মৌয়ালরা জোরসে বৈঠায় হাত লাগান। কার আগে কে পেঁৗছুতে পারেন বনের পানে। লোনা পানি কেটে বৈঠা টানেন জোরেসোরে।

সাত থেকে তেরজন মৌয়াল থাকেন সাধারণত একেকটি দলে। বনে পৌঁছে একজনকে নৌকা পাহারায় রেখে সবাই ঢুকে পড়েন ভেতরে। গামছা দিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে নেন হুল ফোটার ভয়ে। মৌয়ালদের চোখ থাকে গাছে, গাছের ডালে ডালে। সবাই-ই ডালে ডালে খুঁজে ফেরেন মধু ভরা মৌচাক। তবে, চাক ভাঙার সিদ্ধান্তটি নেন দলনেতা, মৌয়ালরা যাকে বলেন বহরদার। সবার হাতে দা, ধামা। বহরদার অভিজ্ঞ মৌয়াল। বাতাসের গতি ও মৌমাছির উপস্থিতি ইত্যাদি লক্ষ্য করে মৌচাকের অবস্থান খুঁজে বের করেন তিনি। সাধারণত তারা মৌচাকের অস্তিত্ব টের পান গাছের পাতায় মৌমাছির মল কিংবা মৌমাছির উড়াউড়ি দেখে। বহরদারের অনুমতি মিললে গাছে চড়ে মৌচাকে আগুনের ধোঁয়া দেন একজন, একজন দা দিয়ে কাটেন চাক, নিচে বেতের তৈরি ধামা পেতে কাটা চাক ধরেন অরেকজন। এভাবেই জঙ্গলে জঙ্গলে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন মৌয়ালরা। সারা দিনের সংগ্রহ নিয়ে সন্ধ্যায় নৌকায় ফেরেন তারা। মাটির বড় মটকিতে পুরে ফেলেন দিন শেষের সংগ্রহ।

মৌয়ালদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সুন্দরবনের ভেতরে এসব রোমাঞ্চকর মধু সংগ্রহের দৃশ্য দেখার ব্যবস্থা করেছে বেসরকারী ভ্রমণ সংস্থা বেঙ্গল টু্যরস। সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে মৌয়ালদের মধু সংগ্রহ দেখতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন অভিজ্ঞ এ ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে। প্রতিবছরের মতো এবারও বেঙ্গল টু্যরস মধু সংগ্রহের বিশেষ প্যাকেজের ব্যবস্থা করেছে। যে কেউ তাই কাছে থেকে দেখে আসতে পারেন সুন্দরবনের মৌয়ালদের জীবনযাপন ও মধু সংগ্রহের রোমাঞ্চকর সব দৃশ্য। ৩১ মার্চ থেকে শুরু হবে এ ভ্রমণ। ৪ রাত ৩ দিনের এ প্যাকেজে জনপ্রতি খরচ হবে ৮ হাজার ৫০০ টাকা, বিদেশিদের জন্যে ১০ হাজার ৫০০ টাকা। ঢাকা থেকে তাপনিয়ন্ত্রিত বাসে করে সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালিনী। সেখান থেকে বেঙ্গলের নিজস্ব জলযানে চেপে পশ্চিম সুন্দরবনের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো আর মধু সংগ্রহ দেখা। যোগাযোগ :বাড়ি-৪৫, রোড-২৭, বস্নক-এ, বনানি, ঢাকা। ফোন :৮৮৫৭৪২৪, ৮৮৩৪৭১৬।

কিছু তথ্য

সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের জন্য সাধারণত মৌয়ালরা প্রতিবারে পনের দিনের অনুমতি পান। সুন্দরবনের সবচেয়ে ভালো মানের মধু হলো খোলসী ফুলের 'পদ্ম মধু'। মানের দিক থেকে এরপরেই গরান ও গর্জন ফুলের 'বালিহার মধু'। মৌসুমের একেবারে শেষে আসা কেওড়া ও গেওয়া ফুলের মধু অপেক্ষাকৃত কম সুস্বাদু। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে ঐতিহ্যবাহী মৌয়াল পেশা এখন হুমকির মুখে। আরো আছে নানারকম সাপ আর বাঘের ভয়। প্রতিবছর গড়ে আট থেকে দশজন মৌয়াল বাঘের আক্রমণের শিকার হন। মৌয়ালরা তাদের সংগৃহীত মধু বিক্রির পসরা সাজান সাতক্ষীরার গাবুরা গ্রামে। খাঁটি মধু চেনার সহজ উপায় হলো, এক টুকরা কাপড় কিংবা কাগজ মধুতে ডুবিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেখা। মধু ভেজানো কাপড় টুকরা ভালোভাবে জ্বললে মধু খাঁটি, না জ্বললে ভেজাল।