ঘরগুলো মাটির ওপর ছনে ছাওয়া। মাটির দেয়াল লেপাপোছা। তার ওপর রংবেরঙের আলপনা আঁকা। বাড়ির উঠোন নিকানো। কোনো কোনো বাড়িতে একচিলতে ফুলের বাগান। সাঁওতাল নারী-পুরুষ সবাই পরিশ্রমী এম আহসানুল হক খোকন নাম সাহানাপাড়া। বরেন্দ্রর ধাপকাটা বিস্তীর্ণ প্রান্তর যেন আরেক দেশ। সেচের অভাবে একসময় এখানে ফসল ফলত না। এখন বরেন্দ্র সবুজ সুন্দর। সাঁওতালরাই বরেন্দ্রর রুক্ষভূমিতে প্রথম লাঙল দিয়েছে। আবাদকেন্দ্রিক সংস্কৃতি আছে তাদের, যদিও এখন তারা খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। সাঁওতালদের অনেক পল্লী আছে বরেন্দ্রে, আমরা গিয়েছিলাম ছোট্ট গ্রাম সাহানাপাড়ায়।
সেবার ফেব্রুয়ারিতে খুব শীত পড়েছিল। ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে চারদিক_১০ হাত দূরের জিনিসও ঠিকমতো ঠাহর করা যায় না। ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে রাজশাহী ফটোগ্রাফিক সোসাইটির দূরযাত্রায় (আউটিং) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক সফিকুন্নবী সামাদী, আলোকচিত্রী তানভীর, মাসুম, রাসেল, মনোজ ও কৌশিকসহ রওনা হলাম একটি মাইক্রোবাসে করে। সকাল ৬টা নাগাদ রাজশাহীর কোর্ট এলাকা ছাড়িয়ে দামকুড়াহাট এলাকায় পেঁৗছে নাশতা করলাম। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়ক ধরে গোদাগাড়ী উপজেলার সীমানায় পেঁৗছতে বেশি সময় লাগল না। এরপর মহাসড়ক ছেড়ে পিচঢালা পথে বাঁক নিলাম। আধঘণ্টা চলার পর গাড়ি মেঠোপথে নামল। সকাল ৮টায় সাহানাপাড়ার তেমাথায় থামল গাড়ি। পল্লীর লোকজন চোখ বড় করে দেখল আমাদের।
একটা দোকানে গিয়ে চায়ের কথা বললাম। লোকজন কাছে এল। কেউ কেউ ওদের বাড়িতে যেতে বলল। মানুষের তো এমনই হওয়ার কথা_নাইবা হলো চেনাজানা, তাই বলে আতিথ্য দেওয়া যাবে না? তাঁরা বলল তাঁদের সমাজ-সংস্কৃতির কথা_তাঁরা উৎসবপ্রিয়। উৎসবে দেব-দেবীর গুণকীর্তন করে, পান-ভোজন আর নৃত্য করে। প্রধান উৎসব হলো 'সোহরাই', যা পৌষ-মাঘে হয়। এ ছাড়া চৈত্র মাসে বোঙ্গাবুঙ্গি, বৈশাখে হোম, জ্যৈষ্ঠে এরোবা সর্দার, আষাঢ় মাসে হাড়িয়া, ভাদ্রে ছাতা, আশ্বিনে দিবি, কার্তিকে নওয়াই, আরো আছে অগ্রহায়ণসংক্রান্তি।
তারা নিজেদের হর হোপেন বা হর-কো-মান বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। তাঁদের কিংবদন্তির আদিভূমি হিহিড়ি পিহিড়। আরো প্রচলিত আছে, তাঁদের বসতি ছিল বিহারের হাজারীবাগ মালভূমির উত্তর-পশ্চিমে চায়ে-চম্পা নগরীতে। সাঁওতালদের মধ্যে ১২টি গোত্র আছে_মুরমু তুদু, সরেন, হেমব্রম, হাঁসদাক, মারুডি, কেসকু, বেসরা, বাসকি, পাঁওরিয়া, বেদিয়া ও চোড়ে।
চা-নাশতা খেয়ে পল্লীর ঘরদোর দেখতে বেরোলাম। ঘরগুলো মাটির ওপর ছনে ছাওয়া। মাটির দেয়াল লেপাপোছা। তার ওপর রংবেরঙের আলপনা আঁকা। বাড়ির উঠোন নিকানো। উঠোনের এক কোণে আছে ছোট্ট একটি মাটির ঢিবি। এটি তাঁদের গৃহদেবতা আবে বোঙ্গা। কোনো কোনো বাড়িতে একচিলতে ফুলের বাগান। সাঁওতাল নারী-পুরুষ সবাই পরিশ্রমী। এক গৃহকর্ত্রী ঘরে এসে বসতে খুব অনুরোধ করলেন। নাম বললেন চান্দসুরুজ টুডু। মুড়ি-মুড়কি দিয়ে আপ্যায়ন করালেন।
বাড়ির আঙিনায় পাকা পেঁপে সাবাড় করতে দেখলাম নীলগলা বসন্ত পাখিকে। ধারেকাছেই লেজঝোলা পাখি হাঁড়িচাচা পেঁপের বাকি অংশটায় ভাগ বসাতে ডাক ছাড়ছে। শজনে ফুলের মধু নিতে ব্যস্ত হয়েছে নীলটুনি। বেগুনিডানা মৌটুসিও আছে দলে। পাখি দেখার শখ আছে জেনে একজন তাঁর বাঁশঝাড়ে নিয়ে গেলেন। আমগাছের ঘন ঝোপে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে দেখলাম খুঁড়লে পেঁচাকে। দেখা পেলাম সিপাহি বুলবুল ও চোখ গেল কোকিলের। বাঁশঝাড় থেকে বেরিয়ে কুলগাছে পেলাম লালপুচ্ছ বুলবুলি ও তৌফিক। হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের সীমানা পেরিয়ে ধানি জমিতে গেলাম। ট্রাক্টরে মাটি ওল্টানো, টিউবওয়েলে পানি সেচ ও ইরি ধান রোপণের কর্মযজ্ঞ চলছে এখানে। জমির আইল ধরে জল-কাদা এড়িয়ে ধাপ জমির উঁচু স্থানে গেলাম। কিছুদূর এগিয়ে পেলাম উত্তর সাহানাপাড়া। পাড়ার শুরুতেই বয়সী বটবৃক্ষ। গাছে পূজা দেওয়ার চিহ্ন দেখলাম। সদ্য কাটা গমক্ষেতে ফিঙে ও ল্যাঞ্জা লটেরা পেলাম অনেক। মান্দারগাছের লাল ফুলে বুলবুলি ও খয়রালেজ গোশালিক দেখলাম। একটি শিমুলগাছে নজর আটকাল পাঁচ ডোরাকাটা কাঠবিড়ালিতে। অদূরে কুলগাছের কাঁটাময় ডালে পাট দিয়ে তৈরি তার বাসাও দেখলাম। হুদহুদ দেখলাম খোলা মাঠে। এ পাখিটা এত সুন্দর, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মাঠ পেরিয়ে বড় একটা দিঘির কাছে চলে এলাম। দিঘির চারপাশ শিশুগাছে ঘেরা। ডাক শুনলাম সবুজ বাঁশপাতি ও লালপাড় ঘুঘুর।
সাঁওতালরা ভালো শিকারি, তীর-ধনুকে ওস্তাদ। তবে পাখিরাও চতুর। ঠিক সময়ে উড়াল দেয়। কিছু বনছাতারের চ্যাক-চ্যাক-চ্যাক কর্কশ আওয়াজে কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। আমাদের দেখে বোধ হয় বিরক্ত হয়েছে। দিঘি পেরিয়ে দূরে ধু-ধু প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি বটগাছ। ২০ মিনিট হেঁটে তবেই তার ছায়ায় পেঁৗছানো গেল। এটা সাঁওতাল পল্লীর করবস্থান। কবরগুলোতে ক্রুশ চিহ্ন দেওয়া। মেঠোপথ ধরে প্রায় আধা ঘণ্টা হেঁটে গ্রামের সেই তেমাথায় পেঁৗছা গেল। আরেক প্রস্থ চা-নাশতা এবং গ্রামবাসীর উপহার কুল (বরই) খেলাম। বেলা ২টার মধ্যে আমরা সাহানাপাড়া ছাড়লাম।
ছবি : লেখকSource: Kalerkantho
No comments:
Post a Comment