বাঁশের ওপর বসে আছে একটি কুচকুচে কালো পানকৌড়ি_রোদ মাখছে গায়ে। আরো কয়েকটিকে পানিতে খুব ডুব মারতে দেখলাম। আমাদের উল্টো দিক থেকে একঝাঁক ছোট বেলেহাঁস ভেসে এল। ওগুলো খুব চতুর। স্থানীয়ভাবে ওগুলোকে বলে ভিলভিলে বা তালের আঁটি। পানির নিচে সবুজ বরণ পাটা শ্যাওলা ফখরে আলম কোটচাঁদপুরের বলুহর বাসস্ট্যান্ড থেকে সামান্য পথ এগিয়ে গিয়ে দেখি, দুই ধারে নিম আর নিম। নিমবৃক্ষের বাতাস গায়ে মেখে সকাল ৭টায় পেঁৗছি ফিশারিঘাটে। সঙ্গে নিয়েছি খাবার আর ছিপ-বড়শি। জেলেপাড়ায় গিয়ে ২০০ টাকায় নৌকা ভাড়া করি মাঝি বাদে। আমার সঙ্গী আলোকচিত্রী ফিরোজ গাজী বৈঠা নেয় হাতে। বাঁওড়ের পানি কেটে এগোতে থাকি। সকালের সোনারং রোদ কুয়াশার চাদর ফুঁড়ে পানিতে এসে ঝিলিমিলি তুলেছে। বাঁওড়ের পানি কাচের মতো স্বচ্ছ।
বলুহর গ্রাম ছেড়ে সামনে এগোই। এক জায়গায় দেখলাম অনেক বাঁশ পোঁতা। বাঁশের ওপর বসে আছে একটি কুচকুচে কালো পানকৌড়ি_রোদ মাখছে গায়ে। আরো কয়েকটিকে পানিতে খুব ডুব মারতে দেখলাম। আমাদের উল্টো দিক থেকে একঝাঁক ছোট বেলেহাঁস ভেসে এল। ওগুলো খুব চতুর। স্থানীয়ভাবে ওগুলোকে বলে ভিলভিলে বা তালের আঁটি। পানির নিচে সবুজ বরণ পাটা শ্যাওলা। মাঝেমধ্যে ওই শ্যাওলা বৈঠা জড়িয়ে ধরছে যেন কতকালের দোস্তি! বলুহরের শেষ মাথায় কয়েকজন জেলে ঘুনি (মাছ ধরার এক ধরনের বাঁশের তৈরি যন্ত্র) ঝাড়ছেন। নৌকা নিয়ে তাদের কাছে গিয়ে দেখি, ঘুনির মধ্যে বন্দি রুপালি চান্দা, কালো চিংড়ি, গুতেল, তিতপুঁটি, চেলা, ট্যাপা_আরো কত মাছ! জেলেদের অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি উপচে পড়ছে মাছে। কতগুলো আবার নাচতে লেগেছে।
আবার নৌকা ভাসাই। আরেক কোমর (বাঁশ পুঁতে জেলেদের তৈরি করা মাছের নিরাপদ আশ্রয়স্থল) দেখি। সেখানে এক তরুণ তালের ডোঙায় বসে ছিপ ফেলে ফাতনার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে তিন-চার কেজি ওজনের একটি রুই মাছ ধরে বসল। তাজা রুইয়ের লাফালাফিতে আনন্দ পেলাম খুব। কিনতে চাইলাম। কিন্তু বিক্রি করবে না। জেদ করে আমরাও হুইলের বড়শিতে টোপ গেঁথে পানিতে ফেলি। এক ঘণ্টার মধ্যে এক হালি দুই-আড়াই কেজি ওজনের রুই মাছ ধরি। ফিরোজের ভাঁড় শূন্য, চেয়ে মিটিমিটি হাসি। হঠাৎই ফিরোজ হুইলে টান দেয়। অবাক কাণ্ড! এক টানে দুটি বড় সাইজের রায়েক বাটা উঠে আসে। রুপার মতো চকচকে বাটার শরীরের মাঝখানে কালো দাগ। এ দাগের কারণেই সম্ভবত এর আরেক নাম দাগবাটা। একসঙ্গে জোড়া মাছ দেখে লাফিয়ে উঠি। এই মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। আমাদের নৌকার কিনারে এসে রুপালি রঙের একঝাঁক চেলা ইতিউতি করছিল। আমি ওই মাছের ঝাঁকে খাবার ছুড়ে মারি, তাদের খেলা দেখি। ছাতা দিয়ে দু-একটিকে ধরেও ফেলি।
এরপর মাছ ধরা বাদ দিয়ে বাঁওড় দেখতে থাকি। যশোর ছাড়া দেশের আর কোথাও কিন্তু বাঁওড় নেই। নদী এর পথ পরিবর্তন করে একটি খাত রেখে যায়, যে খাত ভরাট হয়নি, এখনো যেখানে পানি আছে_তাকেই বাঁওড় বলে। আর বাঁওড়ের শিরোমণি হলো বলুহর বাঁওড়, ইউ আকৃতির। সাড়ে ৯ কিলোমিটার লম্বা, দুই মানুষ সমান গভীর, সিকি মাইল প্রস্থ। বাঁওড়ের মাঝে গমারী গ্রাম। আর বাঁওড়ের দুই পাশে বলুহর, রামচন্দ্রপুর, সিঙ্গিয়া, রহমতপুর ও বজরাপুর। জেলেদের কাছ থেকে জানলাম, বাঁওড়ে মাছ ধরার ৩৬টি কোমর আছে। ১৮টি মাছ ধরার দল আছে, যাদের 'সাভার' বলা হয়। মৎস্য বিভাগের এই মাছের ৪০ শতাংশের ভাগ পায় স্থানীয় জেলেরা।
রামচন্দ্রপুর গ্রামটি অন্য রকম_গাছে ভরা। সেই সঙ্গে আছে হলুদে সয়লাব সরিষাক্ষেত, ভুট্টাক্ষেত, বাঁওড়পাড়ে কচুক্ষেত আর বোরোর বীজতলা। দুপুর নাগাদ কাগমারী দ্বীপ গ্রামের কাছে আসি। ঘাটে গোসল করতে এসেছে গাঁয়ের মানুষ। মেয়েদের গোসল করতে দেখে সেই গানটি মনে পড়ল, জলেতে নামিয়া কন্যা গাত্র মাজন করে...। গোসল শেষে মেয়েদের মাটির কলসে রান্নার পানি নিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখে নায়িকা শাবানার কথা মনে পড়ে গেল। অনেক ছবিতেই তাঁকে এ রূপে দেখেছি। মাঝবয়সী এক লোককে দেখি কচুরিপানার মধ্যে বসে আছে, ছিপ দিয়ে মাছ ধরছে। খতিয়ে দেখতে গিয়ে ঠাহর করি, সে কচুরিপানার দামের ওপর বসে ভাসছে। কয়েকটি কৈ, মাগুর পেয়েছে; কিন্তু মন ভরেনি। আরো পাওয়ার কথা ছিল। বাঁওড়ের নিচের এ অংশ রহমতপুরে আছে বিরাট কোমর। তা সত্ত্বেও সে বেশি কিছু পায়নি। কোমরের একটি বাঁশের গিরায় পাখির বাসা। কোন পাখির তা বুঝে উঠতে পারছি না। তবে ছোট ছোট দুটি ডিম পাখির চোখের মতোই জেগে আছে।
ফিরোজের আর হাত চলে না। বৈঠা বাইতে বাইতে ঝিম ধরেছে। নৌকা ধীরে চলছে। এর মধ্যে চাষি বিপদে পড়েছে তার দুরন্ত গরুটিকে নিয়ে। ঠাণ্ডা পানিতে সে নামতে চায় না। চাষি তাকে নামিয়েই ছাড়বে_কত দিন গা ধোয় না কে জানে! অনেক কসরতে নামিয়ে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে ডলতে থাকে। কাগমারীর কয়েকটি দস্যি শিশু ঝাঁপিয়ে সাঁতার কাটছে। তারা মাঝবাঁওড়ে আমাদের নৌকার কাছে এসে বলে, 'বিটারা, মাছ পাইছ?' নৌকা ধরে পানিতে শরীর ডুবিয়ে আমাদের সঙ্গে তারা ভেসে চলেছে। বিস্কুট, পাউরুটি দিই। কাগমারীর ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে ডাঙ্গায় নামি। গ্রামটির দুই পাশে বাঁওড়। গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানলাম, বাঁওড়টি আসলে কপোতাক্ষের খাত। কপোতাক্ষ মহেশপুর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কোটচাঁদপুর আর বলুহর বাঁওড়কে ফেলে রেখে চৌগাছা ঝিকরগাছা দিয়ে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাগরদাঁড়ি ছুঁয়ে সাতক্ষীরায় গেছে। আবার নৌকায় চেপে বজরাপুর গ্রামের দিকে যাই। বাঁওড়ের কূলে ঘন সবুজ নেপিয়ার ঘাস। কেউ কেউ গরুকে খাওয়ায়, কেউ বা বিক্রি করে। এক আঁটি ১০ টাকা। লম্বা সবুজ ঘাস বাতাসে দুলছে। এর মধ্যে বিকেলও ফুরাতে চলল। বাঁওড়ের জলে সূর্য লাল আলো বিছিয়েছে। সোনারং ধরেছে বলুহর। আমাদের নৌকা রংধনুর মতো রেখা তৈরি করে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনে তাকিয়ে এর রূপ দেখে মুগ্ধ হই। পানকৌড়িরা ছোঁ মারার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। মুখে মাছ নিয়ে ঘরে ফিরছে কানি ও দাঁড়বক। বকে সাদা হওয়া বাঁশবাগান দেখি। মনে হয়, এটি ওদের অভয়ারণ্য। তালের ডোঙা চালিয়ে অতি দ্রুত এক জেলে বৈঠা মেরে এগিয়ে চলেছে। কাদা দিয়ে ডোঙার পেছন আটকে রেখে সেখানে ঘুনিঝাড়া মাছ রেখেছে। তার সময় নেই। সন্ধ্যার আগেই ঘুনি ঝাড়তে হবে। নতুন ঘুনি পাততে হবে। নৌকা যাচ্ছে ফিশারিঘাটের দিকে। সূর্য যত পশ্চিমে হেলছে, মাথার ওপর বকের মালা ততই বড় হচ্ছে। নৌকার মালিক নিকুঞ্জ ঘাটে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁকে নৌকা বুঝিয়ে দিয়ে ঘাটের কাছে মৎস্য বিভাগের বিশ্রামখানায় (রেস্ট হাউস) গিয়ে উঠি। এর পেছনে বড় আমবাগান। রাতের রূপ দেখব বলে সেদিন আর ঘরে ফিরি না।
কিভাবে যাবেন
ঢাকার গাবতলী থেকে বাসে ঝিনাইদহ যেতে হবে। ভাড়া ৩০০ টাকা। ঝিনাইদহ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ১৫ টাকা বাস ভাড়ায় কালীগঞ্জ। কালীগঞ্জ থেকে আবার জীবননগরের বাসে ১৫ কিলোমিটার দূরে কোটচাঁদপুর বলুহর বাসস্ট্যান্ড। বাসস্ট্যান্ড থেকে ফিশারিঘাট ভ্যান ভাড়া ১০ টাকা।
ছবি : ফিরোজ গাজী
Daily Kalerkantho
No comments:
Post a Comment