পাহাড়ে পুকুর আছে জাকারিয়া সবুজপাহাড়ে যতবার গেছি পুকুরপাড়ার গল্প শুনেছিই। শেষে এই ২৩ ডিসেম্বর রাতে রাকিবকে সঙ্গে নিয়ে বান্দরবান রওনা হলাম। রিপন যোগ দিল চট্টগ্রাম থেকে এসে। পাঁচ দিনের ট্যুর বলে ব্যাকপ্যাকের আকারও হয়েছে দশাসই। জাদিপাড়ার এক মারমা দোকানে নাস্তা সেরে রুমাগামী মিনিবাসে চড়ে বসলাম। বাসটি আমাদের নিয়ে যাবে কৈক্ষ্যংঝিরি ঘাট অবধি। সেখান থেকে নৌকায় যেতে হবে রুমাবাজার।রুমাবাজারে কেনাকাটারুমাবাজারে পেঁৗছে দেখি আড়াইটা বাজে। আমাদের চেনা গাইড শাপুল বড়ুয়াকে পেয়ে খুশি হয়ে গেলাম। বড় ভালো মানুষ শাপুলদা। রুমা থানা এবং আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে আর দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সারতে বিকেল নেমে এল। ইচ্ছা ছিল প্রথম রাত বগামুখপাড়ায় থাকব, কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়ায় রুমাবাজারের লাইরনপী পাহাড়ে নাথান বমের লাইমি হিল সাইড রিসোর্টে থাকলাম। ডরমিটরিতে প্রতি বিছানা ৫০০ টাকা। এখানে রাতের আকাশ তারাভরা, সকালে বিস্তীর্ণ প্রান্তর কুয়াশায় ঢাকা। সাধারণত বিকেল ৪টার পর ওপরের দিকে যাওয়ার অনুমতি দেয় না নিরাপত্তা বাহিনী। সন্ধ্যাবেলায় তেল, লবণ, মসলা, পেঁয়াজ, ডাল, আলু, শুঁটকিসহ বেশ কিছু শুকনো খাবার কিনে নিলাম বাজার থেকে। চার দিনের প্রয়োজনীয় সব কিছু দিয়ে আরেকটি ব্যাগ পুরিয়ে ফেললাম। শাপলুদা আছে, তাই ভয় পেলাম না।মেন্দুইপাড়ার পথেপরদিন সকালবেলায় হাঁটা শুরু করলাম মেন্দুইপাড়ার পথে। লাইরনপী পার হতে বেশ ঘাম ঝরাতে হয়। পাহাড় প্রথম পরীক্ষা নেয় লাইরনপীতেই। এর পর ঝিরি ধরে হেঁটে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর বগামুখে পেঁৗছে ঝটপট রান্নার আয়োজন করে ফেলি। জুমের চাল কিনলাম এক বাড়ি থেকে। এখানে আছে মারমাপাড়া। ঝিরির পানিতে গোসল সেরে নিয়ে খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়েই আবার হাঁটা। পাহাড় শুরু হয়ে গেল। কম করেও দেড় ঘণ্টা শুধু ওপরেই উঠলাম। গোধূলির সোনা রঙে অবশ্য মন রাঙানো ছিল। পাহাড়ের ধূসর, নীলচে ও ছাই রং লাল আভায় মিশে এক অপার্থিব পরিবেশ তৈরি করেছে। দূর পাহাড়ের ওপারে একসময় সূর্যটা টুপ করে ডুব দিল। টর্চের আলোয় বাকি পথটুকু হেঁটে আমরা যখন মেন্দুইপাড়ায় পেঁৗছলাম তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। এ পাড়ায় মুরংদের বাস। আমরা লাংরাম মুরং নামে এক যুবকের বাসায় আশ্রয় নিলাম। পাড়ার পোলাপানদের সঙ্গে মুড়ি, বিস্কুট ও ক্যান্ডি খেয়ে চমৎকার সময় কাটালাম। পাহাড়ে সবচেয়ে সুন্দর এর মানুষগুলো। এদের থেকে অনেক শেখার আছে। এরা নিজের খাবার, পোশাক, আবাস সব নিজেরা তৈরি করে_চাওয়া কম, হিংসা বুঝি নেই। বছরখানেক আগে শাপুলদার ফেলে যাওয়া একটা ছুরি লাংরাম সযত্নে রেখে দিয়েছে ফেরত দেওয়ার জন্য। রাতে ওর কাছ থেকে চাল আর পাহাড়ি কচু পেয়ে খাওয়াটাও জমল বেশ। ঘরের মধ্যেই চুলো, শীতের কাছে হার মেনে সেটা জ্বালিয়ে রেখেই এর আশপাশে সবাই ঘুমে গেলাম।এবার পুকুরপাড়াসকালের খাওয়া সেরে নিয়ে পুকুরপাড়ার দিকে হাঁটা দিলাম। পথ খুবই দুর্গম। কোথাও খাড়া পাহাড় তো কোথাও ঝিরির বুকে বড় বড় পাথর আর জলপ্রপাত। ঝিরির ঠাণ্ডা পানি পার হতে গেলে পা দুটো বুঝি জমে যায়! কোনো জায়গা ঘন গাছপালায় ঢাকা সুড়ঙ্গের মতো। বিশ্রাম নিয়ে এগিয়ে চললাম। বেলা ১২টার দিকে পাড়ায় পেঁৗছলাম। বিশাল পুকুরটা দেখে ঘোর লেগে গেল। পুকুরটির নাম রাইক্ষ্যং লেক। পুকুরের এধার-ওধার দিয়ে পাহাড় উঠে গেছে। জল গাঢ় নীল, আকাশকেও টেক্কা দেয় বুঝি! নেরুহা ত্রিপুরার বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। আমাদের অভ্যর্থনা জানাল বাঁশের ভেতর তৈরি করা পিঠা দিয়ে। দুপুরের খাওয়া চুকিয়ে কাছের আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করে আসলাম। পাড়াতেই সব জিনিসপত্র রেখে এর পর গেলাম রাইক্ষ্যংঝিরি দেখতে। এক ঘণ্টার পথ। সে এক আরেক অপরূপ জগৎ। পাথরের ধাপে ধাপে শুভ্র ফেনিল জলধারা বয়ে চলেছে। সবুজ-শান্ত প্রকৃতির মধ্যে পানির গর্জন, নাম না জানা ফুলে ফুলে প্রজাপতির ওড়াউড়ি, ঝিঁঝিঁপোকার ডাক আর শেষ বিকেলের মিষ্টি রোদ আমাদের পেয়ে বসল। জায়গামতো বসলে আর উঠতে ইচ্ছে করে না। গোসল করার লোভটা সামলাতে পারলাম না এই শীতেও। সন্ধ্যাবেলায় পাড়ায় ফিরে মোরগ পুড়িয়ে ফেলল রাকিব। বাতাস বইল হিম হিম। আকাশে চাঁদ আর লাখো তারার মেলা বসল। নেরুহার ছেলেমেয়ে হাঁস্তেরুং, রুঁস্তেরু, হাঁনোরু, ক্লিন্টদের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতে উঠলাম।কেওক্রাডং-বগালেক হয়ে ফেরাপরদিন সকালবেলায় মেন্দুইপাড়ার উদ্দেশে ফিরতি পথ ধরলাম। পেঁৗছলাম দুপুরে। এ পাড়াতেই রাতটা থেকে যাওয়ার স্থির করলাম। পাহাড়ে একমাত্র মুরংরাই তাদের আদি সংস্কৃতি এখনো ধরে রেখেছে। পরদিন সূর্য ওঠার আগে রওনা দিয়ে সাইকতপাড়া-হারমুনপাড়া-দার্জিলিংপাড়া হয়ে কেওক্রাডংয়ে উঠলাম। এরপর চলে গেলাম বগালেক। ১০ ঘণ্টার এই হাঁটায় শুকনো খাবার আর ঝিরির পানি খুব কাজে দিল। বগালেকে সিয়াম বমের বাসায় উঠলাম। সন্ধ্যাবেলায় লেকের স্বচ্ছ টলটলে পানিতে গোসল সারতেই ক্লান্তি পালাল। পরদিন ফিরে এসেছিলাম রুমাবাজার।যেভাবে যাবেন ও যেখানে থাকবেনঢাকার ফকিরাপুল, কমলাপুর থেকে এস আলম, ইউনিকসহ আরো কিছু পরিবহনের বাসে বান্দরবান যাওয়া যায়। ভাড়া ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। বান্দরবান থেকে কৈক্ষ্যংঝিরি বাস ভাড়া ৭০ টাকা। নৌকা ভাড়া ২০ টাকা। গাইডকে দিতে হয় দুই থেকে তিন হাজার টাকা। রাতে থাকতে হয় পাড়ার কোনোবাড়িতে। রান্নাবান্নার হাঁড়ি-পাতিল তাদের কাছ থেকে নেওয়া যায়। তবে রাঁধতে হয় নিজেদেরই। ঘরে থাকার কোনো ভাড়া নেই। খুশি হয়ে সবাই কিছু ধরে দেয়।সঙ্গে নেবেন : অবশ্যই মাথাল ও টর্চলাইট নেবেন। ক্যামেরা নিতে ভুলবেন না। শীত হলে হালকা একটা কম্বল নেবেন। আরো নেবেন পাহাড়ি পথে হাঁটার উপযোগী স্যান্ডেল বা কেডস, টয়লেট টিস্যু, মশানিরোধক ক্রিম ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র।
ছবি : লেখকSource: Daily Kalerkantho
No comments:
Post a Comment