ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের রাজধানী তাবরিজ। এ শহর ঐতিহাসিকভাবে স্বাধীনতার ধারক এবং বহু স্বাধীনতাপ্রেমী ও মুক্তিযোদ্ধার আবাসস্থল। সাত্তার খান, বাকের খান, সেকাতুল ইসলাম ও শেখ মুহাম্মাদ খেয়াবানীর মতো বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা যাঁরা শাসনতান্ত্রিক বিপ্লবে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, তাঁরা এ অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন।
তাবরিজ শহর ৩৮ ০২ উত্তর অক্ষাংশ ও ৪৬ ২৫ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত একটি বৃহৎ শিল্প, ব্যবসা ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র। শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ১,৩৪০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত।
জলবায়ু
তাবরিজ নিম্ন আর্দ্রতাসম্পন্ন মহাদেশীয় জলবায়ু এলাকায় অবস্থিত। এখানকার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ২৮৫ মিলিমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে অনেক উঁচুতে অবস্থিত বিধায় একদিকে এ শহরের শীতকাল দীর্ঘ এবং শীতে প্রচন্ড ঠান্ডা বিরাজ করে, অন্যদিকে গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড গরম অনুভূত হয়।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন ও শিল্পসমৃদ্ধ শহর বিধায় এ শহরের সড়ক যোগাযোগ অত্যন্ত উন্নত। শহরটি ইরানের রাজধানীর সাথে ৬১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়ক দ্বারা যুক্ত যা ইরান ও আজারবাইজনের সীমান্ত সংলগ্ন সুদূর জুলফা এবং ইরান ও তুরস্কের মধ্যে সংযোগ সাধন করেছে। অন্য আরও কয়েকটি মহাসড়কের মাধ্যমে তাবরিজের প্রতিবেশী প্রদেশ, যেমন আরদেবিল, কুর্দিস্থান ও পশ্চিম আজারবাইজনের রাজধানীর সাথে সংযুক্ত। এছাড়া তেহরান-আংকারা ও তেহরান-মস্কো রেলপথটি তাবরিজ শহরের ওপর দিয়ে গিয়েছে। রেলপথটি কাজভীন, যানজান ও তাবরিজ অতিক্রমের পর সুফিয়ান নামক স্থানে বিভক্ত হয়ে একটি অংশ জুলফা হয়ে মস্কো এবং অন্য অংশ তুরস্কের মধ্যদিয়ে ইউরোপীয় রেল নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত। ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিমানসংস্থা ‘হোমা' তেহরান-তাবরিজ রুটে দৈনিক ফ্লাইট পরিচালনা করে এবং আকাশপথে তেহরান থেকে মাত্র আধ ঘণ্টায় তাবরিজ পৌঁছতে পারে।
ভাষা ও ধর্ম
পূর্ব আজারবাইজানের অন্যান্য অংশের ন্যায় তাবরিজের অধিবাসীরা আজারী ভাষায় কথা বলে। ১৯৫০ সালে সাফাভী বংশের রাজত্ব শুরু হলে তুর্কী ভাষা আজারী ভাষার স্থান দখল করে। সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ফলে তুর্কী ভাষা ফার্সী, আরবী, আর্মেনীয় ও জর্জিয়ান ভাষা দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং তাবরিজীরা বর্তমানে নব্য আজারী ভাষায় কথা বলে।
তাবরিজের সংখ্যাগুরু অধিবাসী শিয়া মুসলিম, আর সামান্য সংখ্যক খ্রিস্টান- যারা মূলত আর্মেনীয় বংশোদ্ভূত।
শহরের নামকরণ
এ শহরের নামকরণ সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ নানা মতে বিভক্ত। কোনো কোনো ইতিহাস গ্রন্থে এ শহরের আদি নাম ‘তাওরী', আবার অন্য ইতিহাস গ্রন্থে ‘তাওরিজ' নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ শহরের মধ্যযুগীয় ও আজারী নাম ‘তাওরী' যার মূল ‘তাও' অর্থাৎ তাপ বা গরম এবং ‘রি' অর্থ নদী বা ঝর্ণা। এতে এ শহরে যে অনেক উষ্ণ প্রস্রবণের অস্তিত্ব ছিল এটার প্রমাণ পাওয়া যায়।
কেউ কেউ আর্মেনীয় রাজা খসরু- যিনি পার্থিয়ান রাজা চতুর্থ আরদাভান-এর সময় রাজত্ব করেন তিনি এ শহরের পত্তন করেছেন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, তিনি আর্মেনিয়ার নিকটবর্তী এট্রোপাটেন (আজারবাইজান) রাজ্যে দাভরেজ শহর নির্মাণ করেন যা কালের বিবর্তনে ‘তাভরিজ', ‘তাওরিজ' ও ‘তাবরিজ' নাম ধারণ করে।
স্থাপত্য নিদর্শন
সমৃদ্ধ অতীতের অধিকারী তাবরিজ শহরে অনেক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে উপর্যুপরি বৈদেশিক আক্রমণ ও দখলদারিত্ব, তৎকালীন সরকারের উদাসীনতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন : ভূমিকম্প ও বন্যার কারণে বহু নিদর্শন ধ্বংস হয়ে গেছে। কালের বিবর্তনে এখনও যেগুগো টিকে আছে সেগুলো ইলখানী, সাফাভী ও ক্বাজার রাজত্বকালে নির্মিত হয়। কোনো কোনো স্থাপত্য অতুলনীয় নির্মাণশৈলীর নিদর্শন। প্রধান কয়েকটি স্থাপত্য নিদর্শন সম্পর্কে নিচে বর্ণনা করা হলো :
কাবুদ (নীল) মসজিদ
কাবুদ মসজিদ তাবরিজের একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা। এ মসজিদ বাইর ও ভিতরের অপূর্ব নীল-সবুজ কারুকার্যময় টাইলস-এর জন্য প্রসিদ্ধ এবং এটি ‘টারকুইজ অব ইসলাম' নামে পরিচিত। দৃষ্টিনন্দন টাইল্স ও ক্যালিগ্রাফী আচ্ছাদিত মসজিদটি একটি অনন্য অট্টালিকা। এটি ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে রাণী জেহান বেগমের নির্দেশে জাহানশাহ কারা কউনলুর সময় নির্মিত হয়। এ অট্টালিকায় রয়েছে সুউচ্চ প্রবেশপথ যার চৌকাঠ সুদৃশ্য কারুকার্য খচিত টাইল্স ও ক্যালিগ্রাফীসমৃদ্ধ, দু'টি মিনার ও গম্বুজ প্রবেশপথ ও নামাযের হল ঘর আচ্ছাদিত করে রেখেছে।
অর্গ বা আলী শাহ মসজিদ
এ মসজিদটি তাবরিজ শহরের অন্যতম প্রাচীন এবং উল্লেখযোগ্য স্থাপনা যা ইসলামী স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন।
জামে মসজিদ
এ মসজিদটি ইলখানী শাসনামলে নির্মিত তাবরিজ শহরের একটি অত্যন্ত প্রাচীন নজরকাড়া অট্টালিকা। মসজিদটির উঁচু চত্বর এ সময়েই নির্মিত হয়।
ওস্তাদ ও শগের্দ (শিক্ষক ও ছাত্র) মসজিদ
যেহেতু এ মসজিদের ভিতর ও বাইরের ক্যালিগ্রাফী বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার আবদুল্লাহ সিরাজী এবং তাঁর এক ছাত্রের তৈরি সেজন্য একটি ‘ওস্তাদ ও শগের্দ' মসজিদ নামে খ্যাত। এ মসজিদের গম্বুজটি গোটা নামায ঘর আচ্ছাদিত করে রেখেছে যার সারল্য একে বাড়তি সৌন্দর্য দান করেছে।
এ শহরে আরও অনেক প্রসিদ্ধ মসজিদ রয়েছে যার মধ্যে শাহজাদা মসজিদ, মাক্ববারহ (মাযার) মসজিদ ও যাহিরিয়া মসজিদ উল্লেখযোগ্য।
শু'আরা গোরস্থান
এ কবরস্থানে অনেক ইরানী কবি, সূফী, বিজ্ঞানী ও দ্বীনী আলেম শায়িত আছেন। আসাদী তুসি, খাকানী শেরভানী, জাহির ফারিয়াবী, কাতরান তাবরিজী, মুহাম্মাদ শিরিন মাগরেবী, হোমাম তাবরিজী, সালমান সাফাভী, ফালাকী শেরভানী, কাজী বেইজাভী ও সমকালীন প্রসিদ্ধ কবি মুহাম্মাদ হোসাইন শাহরিয়ারকে এখানে দাফন করা হয়েছে। এ শহরে ছয়টি গীর্জা রয়েছে যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো সাধু সেরকির চার্চ, যা তাবরিজের আর্মেনীয়ান এলাকা বারন আভাক্-এ অবস্থিত। এটি ১৮৪৫ সালে সংস্কার করা হয়। এরপর সেন্ট মেরী চার্চ যার নির্মাণকাজ ১৭৪৫ সালে সম্পন্ন হয়। এটি সবচেয়ে প্রাচীন চার্চ। আর আছে আবল মেরী চার্চ যা ১৯১০ সালে নির্মিত হয়।
গোলেস্তান উদ্যান
এটি তাবরিজ শহরের অন্যতম প্রধান বিনোদন কেন্দ্র যা ৫৩ হাজার বর্গমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। এ উদ্যানটি প্রায় ৬০ বছর আগে একটি পুরনো সমাধিস্থলে নির্মিত হয়েছিল। এ উদ্যানে রয়েছে সবুজ বৃক্ষরাজিতে ঘেরা অনেকগুলো বড় বড় পুকুর।
আজারবাইজান যাদুঘর
১৯৬২ সালে নীল মসজিদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় এ জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়। এটি ৩০০ বর্গমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। এতে তিনটি প্রধান হল রয়েছে যেগুলোতে ঐতিহাসিক নিদর্শনাবলী, ইরানের বিভিন্ন উপজাতির পোশাক, প্রসিদ্ধ ইরানী ক্যালিগ্রাফারদের ক্যালিগ্রাফি, চিত্রকর্ম, ঘোষণাপত্র, দলিলাদি ও শাসনতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃবৃন্দের ব্যক্তিগত ব্যবহার্য দ্রব্যাদি প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে।
এ শহরের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ভবনের মধ্যে রয়েছে তাবরিজ লাইব্রেরি, তুমানিয়ান স্কুল, রেল স্টেশন ও পৌরভবন।
বাজার
তাবরিজ বাজার প্রাচীন সৌন্দর্য, বাণিজ্যিক গুরুত্ব ও বিশালাকারের জন্য ইরানের অন্যতম বৃহৎ ও সুন্দর বাজারগুলোর অন্যতম বলে পরিণত হয়। স্থাপত্যশৈলী, অসংখ্য সরাইখানা, প্রশস্ত চত্বর, মসজিদ ও স্কুল-এর সৌন্দর্য এবং গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
এ বাজারের প্রকৃত ইতিহাস ও উৎপত্তি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। তথাপি এর ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহ, যেমন জামে মসজিদ, তালেবিয়াহ স্কুল ও সাদেক্বিয়াহ স্কুলের নির্মাণশৈলী এগুলোর প্রাচীনত্বের ইংগিতবহ।
কুটিরশিল্প
ইরানের প্রসিদ্ধ কার্পেট (গালিচা) প্রস্তুতকারী শহরগুলোর মধ্যে তাবরিজ অন্যতম। গালিচা থেকে তাবরিজের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্পের পরিচয় মেলে। ইরানের রফতানিকৃত গালিচার মধ্যে সিংহভাগই তাবরিজের তৈরি।
সূত্র : মাহজুবা, অনুবাদ : ড. মোঃ আলতাফ হোসেন
Source: Daily Sangram, 26th january-2011
No comments:
Post a Comment