শরণখোলা রেঞ্জের আরণ্যক সৌন্দর্য
টিএম মিজানুর রহমান শরণখোলা (বাগেরহাট)
বিশ্ববিখ্যাত বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ও নয়নাভিরাম প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জকে ঘিরে রয়েছে পর্যটন শিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, ব্যাপক প্রচার ও সদিচ্ছার অভাব এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়হীনতার কারণে এই অপার সম্ভাবনাময় খাতটি বিকশিত হতে পারছে না। তবে সাইনবোর্ড-শরণখোলা আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ায় শরণখোলা রেঞ্জ ভিত্তিক পর্যটন শিল্পকে ঘিরে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য এই সুন্দরবনকে এরই মধ্যে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উপকমিটি (ইউনেস্কো) বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। সুন্দরবনকে আকর্ষণীয় করে বিশ্বের বুকে পরিচিত করে তুলতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন সুন্দরবনে পর্যটকদের নিয়ে কাজ করলেও তাদের রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। এরপরও সরকার সুন্দরবনে পর্যটনখাতে প্রতিবছর মোটা অংকের রাজস্ব আয় করছে। সরকারের সদিচ্ছা, বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ ও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় সম্ভব হলে এ খাতের রাজস্ব বেড়ে যেতে পারে কয়েকগুণ। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ হবে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।
সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির ছোট-বড় বৃক্ষ, ১৬৫ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৩ প্রজাতির পরাশ্রয়ী অর্কিড রয়েছে। সুন্দরী এ বনের প্রধানতম বৃক্ষ, যা মোট বনাঞ্চলের ৭৩ ভাগ। এছাড়া কেওড়া, বাইন, পশুর, ধুন্দল, কাঁকড়া, পশুর, গরান, হেতাল ও গোলপাতা উল্লেখযোগ্য। এ বনের ২৬৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, ১৮৬ প্রজাতির পাখি ও ২১০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। বন্যপ্রাণীর মধ্যে বিশ্বনন্দিত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী চিত্রল হরিণ, লোনাপানির ভয়ঙ্কর কুমির, বানর, শূকর ও গুইসাপ প্রধান।
এসব বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ সংরক্ষণ, বৃদ্ধি, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৭৭ সালে সুন্দরবনের ৩টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য চিহ্নিত করা হয়। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের পাশাপাশি এসব অভায়রণ্য জনসাধারণের জন্য বন্যপ্রাণীর বিচরণ পর্যবেক্ষণ ও উপভোগের জন্য উন্মুক্ত। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ও সমুদ্রের বিশাল জলরাশির কারণে সুন্দরবনের পূর্ব অভায়ারণ্য সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সুন্দরবনের এ অংশের নৈসর্গিক দৃশ্য ও ভয়াবহ নিস্তব্ধতার সঙ্গে সরকারি ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার সমন্বয়ে গড়ে উঠতে পারে পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।
এ অংশটি সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত। সমগ্র সুন্দরবনের সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় অঞ্চল কটকা ও কচিখালী নিয়ে এ অংশ গঠিত। কটকা, কচিখালী ছাড়াও শরণখোলা রেঞ্জের সুপতি, বাদামতলা, জামতলা, তিনকোনা আইল্যান্ড ও জেলে পল্লী দুবলা পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় স্থান।
কটকা : সুন্দরবন পূর্ব অভয়ারণ্যের পশ্চিমাংশে সাগর তীরে অবস্থিত কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্র। এখানকার নৈসর্গিক ও মনোরম পরিবেশ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। ঘন বনানীর ছায়ায় নির্মিত বিশ্রামাগারের বারান্দায় বসে চোখের সামনে উত্তাল সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ পর্যটকদের উচ্ছ্বসিত করে তোলে। বিকালে বিশ্রামাগারের চারপাশে হাজার হাজার চিত্রল হরিণের ছোটাছুটি, বানরের কোলাহল আর সকালে নদীর পাড়ে কুমিরের রোদ পোহানোর দৃশ্য যেন স্বপ্ন ও সত্যির অপূর্ব সমন্বয়। এখানে বিশ্রামাগার প্রান্তিকে ৪ শয্যাবিশিষ্ট ২টি কক্ষ রয়েছে। বরাদ্দপ্রাপ্তি ও রাজস্ব প্রদান সাপেক্ষ এটা ব্যবহার করা যায়।
কচিখালী : সুন্দরবনের পূর্ব অভয়ারণ্যের দক্ষিণ-পূর্বপ্রান্তে সাগর তীরে গড়ে উঠেছে কচিখালী কেন্দ্র। সুন্দরবনের ভ্রমণকারী এবং পর্যটকদের জন্য এখানে গড়ে উঠেছে একটি বড় ধরনের বিশ্রামাগার। এক শয্যাবিশিষ্ট তিনটি ও দুই শয্যাবিশিষ্ট একটি বেডরুম, ড্রইংরুম ও ডাইনিং রুমের সমন্বয়ে এ বিশ্রামাগারটি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। প্রতি শীত মৌসুম অর্থাত্ অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি এখানে কৌতূহলী পর্যটকদের ভিড় থাকে। তারা এখানকার সাগরপাড় আর ছন ক্ষেতের ভেতর খুঁজে ফেরে বহু প্রত্যাশিত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দর্শন। ঝাঁক বাঁধা চিত্রল হরিণ ছুটে বেড়িয়ে বন্ধুদের জানিয়ে দেয় পর্যটকদের আগমন বার্তা।
জামতলা : কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্রের নিকটবর্তী পর্যটকদের একটি আকর্ষণীয় স্থান জামতলা। জামতলায় রয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। যেখান থেকে বিস্তীর্ণ ছন ক্ষেতে হাজার হাজার হরিণের ছোটাছুটি, আবার কখনও রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখা যেতে পারে।
বাদামতলা : কচিখালী আর কটকার ঠিক মধ্যবর্তী স্থানের নাম বাদামতলা। বাদামতলা অত্যন্ত নির্জন এক সমুদ্র সৈকত। সেখানে আছড়ে পড়া সামুদ্রিক ঢেউ পর্যটকদের মন কেড়ে নেয়। শীতকালে বাদামতলার সৈকতে অজস্ত্র বাঘের পায়ের ছাপ দেখা যায়। কচিখালী ও জামতলা থেকে পায়ে হেঁটে বাদামতলা পৌঁছানো সম্ভব।
দুবলার চরে মত্স্যপল্লী : সাগরদ্বীপ দুবলাসহ সন্নিবেশিত ১০টি চরে মাছ আহরণের মৌসুমে ৩০ থেকে ৪০ হাজার মত্স্যজীবী ভিড় জমায়। অক্টোবরে এরা আসা শুরু করলেও নভেম্বরে রাসমেলা নামক এক ধর্মীয় উত্সবের মধ্য দিয়ে তাদের বছরের কাজ শুরু হয়। দুশ’ বছরের ঐতিহ্যলালিত এ রাস উত্সবেও দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক ও দর্শনার্থী ভিড় জমায়।
যোগাযোগ : শরণখোলা রেঞ্জের সম্ভাবনা সুন্দরবনের অপরূপ প্রকৃতি, জীববৈচিত্র, গভীর সমুদ্রের অপরূপ দৃশ্য ছাড়াও যোগাযোগ ও যাতায়াতের জন্য এ রেঞ্জ বিশেষ উপযোগী। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বাগেরহাট থেকে বাসযোগে শরণখোলা উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজারে আসতে হবে। মংলা বন্দরের তুলনায় এখানে সাশ্রয়ী ভাড়ায় বিভিন্ন ধরনের লঞ্চ ও ট্রলার ভাড়া পাওয়া যায়। আগে থেকে বনবিভাগের অনুমতি প্রাপ্তিসাপেক্ষে শরণখোলা থেকে কচিখালী ও কটকায় যেতে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় লাগে। শরণখোলা থেকে এর দূরত্ব যথাক্রমে ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার। শরণখোলা রেঞ্জের কটকা ও কচিখালীতে আরামপ্রদ বিশ্রামাগারে পর্যটকরা যেমন রাতযাপন করতে পারেন, তেমনি ইচ্ছা করলে একদিনের মধ্যে সমগ্র এলাকা ঘুরে ফিরে আসতে পারেন, যা নির্ভর করবে পর্যটকদের প্রস্তুতি ও সামর্থ্যের উপর।
প্রস্তাবনা : স্থানীয় বিশেষজ্ঞ ও পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলে শরখোলা রেঞ্জকে আকর্ষণীয় করতে বেশ কিছু প্রস্তাবনা পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে রয়েছে শরণখোলা রেঞ্জ অফিস থেকে পর্যটকদের বনে প্রবেশের রাজস্ব গ্রহণ ও অনুমতি প্রদানের ব্যবস্থা। শরণখোলা রেঞ্জভিত্তিক পর্যটকদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নিরাপদ জলযানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রস্তাবিত সাইনবোর্ড-শরণখোলা আঞ্চলিক মহাসড়কের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। বনদস্যু ও জলদস্যুদের কবল থেকে পর্যটকদের নিরাপদ রাখতে সন্নিবেশিত নিরাপদ রুট চিহ্নিত করতে হবে। নিরাপদ রুটে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সার্বক্ষণিক টহল জোরদার করতে হবে। সুন্দরবনের আকর্ষণীয় জায়গা চিহ্নিত করে পরিবেশ উপযোগী অবকাঠামো ও চিত্তবিনোদনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ রেঞ্জের উজ্জ্বলতম পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ বৃদ্ধি করতে হবে। সুপতি স্টেশনে এবং কচিখালী থেকে জামতলা পর্যন্ত উডেন ট্রেইল তৈরি করে গভীর বনে পর্যটকদের নিরাপদ পথ চলার ব্যবস্থা করতে হবে। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস বা তেরাবেকা টহল ফাঁড়ি সংলগ্ন এলাকায় মংলা করমজলের মতো টুরিস্ট স্পট স্থাপন করতে হবে। এমন অভিমত দিয়েছেন সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জভিত্তিক পর্যটন কেন্দ্রের দাবিতে আন্দোলনরত শরণখোলা উন্নয়ন ফোরামের প্রধান সমন্বয়ক, সাংবাদিক আসাদুজ্জামান মিলন।
সুন্দরবন পূর্ব-বিভাগের ডিএফও মিহির কুমার দে বলেন, বর্তমানে সুন্দরবন থেকে প্রতিবছর পর্যটন খাতে সরকার এক কোটি টাকা রাজস্ব আয় করছে। ব্যাপকভিত্তিক প্রচারণা ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারলে রাজস্ব কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে শরণখোলা রেঞ্জ হতে পারে অপার সম্ভাবনাময় এক পর্যটক কেন্দ্র।
এ ব্যাপারে শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার জহিরুল ইসলাম জানান, সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জকে পর্যটন কেন্দ্রের আওতায় আনার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তবে এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য এই সুন্দরবনকে এরই মধ্যে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উপকমিটি (ইউনেস্কো) বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। সুন্দরবনকে আকর্ষণীয় করে বিশ্বের বুকে পরিচিত করে তুলতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন সুন্দরবনে পর্যটকদের নিয়ে কাজ করলেও তাদের রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। এরপরও সরকার সুন্দরবনে পর্যটনখাতে প্রতিবছর মোটা অংকের রাজস্ব আয় করছে। সরকারের সদিচ্ছা, বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ ও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় সম্ভব হলে এ খাতের রাজস্ব বেড়ে যেতে পারে কয়েকগুণ। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ হবে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।
সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির ছোট-বড় বৃক্ষ, ১৬৫ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৩ প্রজাতির পরাশ্রয়ী অর্কিড রয়েছে। সুন্দরী এ বনের প্রধানতম বৃক্ষ, যা মোট বনাঞ্চলের ৭৩ ভাগ। এছাড়া কেওড়া, বাইন, পশুর, ধুন্দল, কাঁকড়া, পশুর, গরান, হেতাল ও গোলপাতা উল্লেখযোগ্য। এ বনের ২৬৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, ১৮৬ প্রজাতির পাখি ও ২১০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। বন্যপ্রাণীর মধ্যে বিশ্বনন্দিত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী চিত্রল হরিণ, লোনাপানির ভয়ঙ্কর কুমির, বানর, শূকর ও গুইসাপ প্রধান।
এসব বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ সংরক্ষণ, বৃদ্ধি, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৭৭ সালে সুন্দরবনের ৩টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য চিহ্নিত করা হয়। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের পাশাপাশি এসব অভায়রণ্য জনসাধারণের জন্য বন্যপ্রাণীর বিচরণ পর্যবেক্ষণ ও উপভোগের জন্য উন্মুক্ত। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ও সমুদ্রের বিশাল জলরাশির কারণে সুন্দরবনের পূর্ব অভায়ারণ্য সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সুন্দরবনের এ অংশের নৈসর্গিক দৃশ্য ও ভয়াবহ নিস্তব্ধতার সঙ্গে সরকারি ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার সমন্বয়ে গড়ে উঠতে পারে পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।
এ অংশটি সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত। সমগ্র সুন্দরবনের সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় অঞ্চল কটকা ও কচিখালী নিয়ে এ অংশ গঠিত। কটকা, কচিখালী ছাড়াও শরণখোলা রেঞ্জের সুপতি, বাদামতলা, জামতলা, তিনকোনা আইল্যান্ড ও জেলে পল্লী দুবলা পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় স্থান।
কটকা : সুন্দরবন পূর্ব অভয়ারণ্যের পশ্চিমাংশে সাগর তীরে অবস্থিত কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্র। এখানকার নৈসর্গিক ও মনোরম পরিবেশ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। ঘন বনানীর ছায়ায় নির্মিত বিশ্রামাগারের বারান্দায় বসে চোখের সামনে উত্তাল সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ পর্যটকদের উচ্ছ্বসিত করে তোলে। বিকালে বিশ্রামাগারের চারপাশে হাজার হাজার চিত্রল হরিণের ছোটাছুটি, বানরের কোলাহল আর সকালে নদীর পাড়ে কুমিরের রোদ পোহানোর দৃশ্য যেন স্বপ্ন ও সত্যির অপূর্ব সমন্বয়। এখানে বিশ্রামাগার প্রান্তিকে ৪ শয্যাবিশিষ্ট ২টি কক্ষ রয়েছে। বরাদ্দপ্রাপ্তি ও রাজস্ব প্রদান সাপেক্ষ এটা ব্যবহার করা যায়।
কচিখালী : সুন্দরবনের পূর্ব অভয়ারণ্যের দক্ষিণ-পূর্বপ্রান্তে সাগর তীরে গড়ে উঠেছে কচিখালী কেন্দ্র। সুন্দরবনের ভ্রমণকারী এবং পর্যটকদের জন্য এখানে গড়ে উঠেছে একটি বড় ধরনের বিশ্রামাগার। এক শয্যাবিশিষ্ট তিনটি ও দুই শয্যাবিশিষ্ট একটি বেডরুম, ড্রইংরুম ও ডাইনিং রুমের সমন্বয়ে এ বিশ্রামাগারটি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। প্রতি শীত মৌসুম অর্থাত্ অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি এখানে কৌতূহলী পর্যটকদের ভিড় থাকে। তারা এখানকার সাগরপাড় আর ছন ক্ষেতের ভেতর খুঁজে ফেরে বহু প্রত্যাশিত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দর্শন। ঝাঁক বাঁধা চিত্রল হরিণ ছুটে বেড়িয়ে বন্ধুদের জানিয়ে দেয় পর্যটকদের আগমন বার্তা।
জামতলা : কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্রের নিকটবর্তী পর্যটকদের একটি আকর্ষণীয় স্থান জামতলা। জামতলায় রয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। যেখান থেকে বিস্তীর্ণ ছন ক্ষেতে হাজার হাজার হরিণের ছোটাছুটি, আবার কখনও রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখা যেতে পারে।
বাদামতলা : কচিখালী আর কটকার ঠিক মধ্যবর্তী স্থানের নাম বাদামতলা। বাদামতলা অত্যন্ত নির্জন এক সমুদ্র সৈকত। সেখানে আছড়ে পড়া সামুদ্রিক ঢেউ পর্যটকদের মন কেড়ে নেয়। শীতকালে বাদামতলার সৈকতে অজস্ত্র বাঘের পায়ের ছাপ দেখা যায়। কচিখালী ও জামতলা থেকে পায়ে হেঁটে বাদামতলা পৌঁছানো সম্ভব।
দুবলার চরে মত্স্যপল্লী : সাগরদ্বীপ দুবলাসহ সন্নিবেশিত ১০টি চরে মাছ আহরণের মৌসুমে ৩০ থেকে ৪০ হাজার মত্স্যজীবী ভিড় জমায়। অক্টোবরে এরা আসা শুরু করলেও নভেম্বরে রাসমেলা নামক এক ধর্মীয় উত্সবের মধ্য দিয়ে তাদের বছরের কাজ শুরু হয়। দুশ’ বছরের ঐতিহ্যলালিত এ রাস উত্সবেও দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক ও দর্শনার্থী ভিড় জমায়।
যোগাযোগ : শরণখোলা রেঞ্জের সম্ভাবনা সুন্দরবনের অপরূপ প্রকৃতি, জীববৈচিত্র, গভীর সমুদ্রের অপরূপ দৃশ্য ছাড়াও যোগাযোগ ও যাতায়াতের জন্য এ রেঞ্জ বিশেষ উপযোগী। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বাগেরহাট থেকে বাসযোগে শরণখোলা উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজারে আসতে হবে। মংলা বন্দরের তুলনায় এখানে সাশ্রয়ী ভাড়ায় বিভিন্ন ধরনের লঞ্চ ও ট্রলার ভাড়া পাওয়া যায়। আগে থেকে বনবিভাগের অনুমতি প্রাপ্তিসাপেক্ষে শরণখোলা থেকে কচিখালী ও কটকায় যেতে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় লাগে। শরণখোলা থেকে এর দূরত্ব যথাক্রমে ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার। শরণখোলা রেঞ্জের কটকা ও কচিখালীতে আরামপ্রদ বিশ্রামাগারে পর্যটকরা যেমন রাতযাপন করতে পারেন, তেমনি ইচ্ছা করলে একদিনের মধ্যে সমগ্র এলাকা ঘুরে ফিরে আসতে পারেন, যা নির্ভর করবে পর্যটকদের প্রস্তুতি ও সামর্থ্যের উপর।
প্রস্তাবনা : স্থানীয় বিশেষজ্ঞ ও পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলে শরখোলা রেঞ্জকে আকর্ষণীয় করতে বেশ কিছু প্রস্তাবনা পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে রয়েছে শরণখোলা রেঞ্জ অফিস থেকে পর্যটকদের বনে প্রবেশের রাজস্ব গ্রহণ ও অনুমতি প্রদানের ব্যবস্থা। শরণখোলা রেঞ্জভিত্তিক পর্যটকদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নিরাপদ জলযানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রস্তাবিত সাইনবোর্ড-শরণখোলা আঞ্চলিক মহাসড়কের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। বনদস্যু ও জলদস্যুদের কবল থেকে পর্যটকদের নিরাপদ রাখতে সন্নিবেশিত নিরাপদ রুট চিহ্নিত করতে হবে। নিরাপদ রুটে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সার্বক্ষণিক টহল জোরদার করতে হবে। সুন্দরবনের আকর্ষণীয় জায়গা চিহ্নিত করে পরিবেশ উপযোগী অবকাঠামো ও চিত্তবিনোদনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ রেঞ্জের উজ্জ্বলতম পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ বৃদ্ধি করতে হবে। সুপতি স্টেশনে এবং কচিখালী থেকে জামতলা পর্যন্ত উডেন ট্রেইল তৈরি করে গভীর বনে পর্যটকদের নিরাপদ পথ চলার ব্যবস্থা করতে হবে। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস বা তেরাবেকা টহল ফাঁড়ি সংলগ্ন এলাকায় মংলা করমজলের মতো টুরিস্ট স্পট স্থাপন করতে হবে। এমন অভিমত দিয়েছেন সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জভিত্তিক পর্যটন কেন্দ্রের দাবিতে আন্দোলনরত শরণখোলা উন্নয়ন ফোরামের প্রধান সমন্বয়ক, সাংবাদিক আসাদুজ্জামান মিলন।
সুন্দরবন পূর্ব-বিভাগের ডিএফও মিহির কুমার দে বলেন, বর্তমানে সুন্দরবন থেকে প্রতিবছর পর্যটন খাতে সরকার এক কোটি টাকা রাজস্ব আয় করছে। ব্যাপকভিত্তিক প্রচারণা ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারলে রাজস্ব কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে শরণখোলা রেঞ্জ হতে পারে অপার সম্ভাবনাময় এক পর্যটক কেন্দ্র।
এ ব্যাপারে শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার জহিরুল ইসলাম জানান, সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জকে পর্যটন কেন্দ্রের আওতায় আনার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তবে এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
No comments:
Post a Comment