হোয়াইকংয়ের কুদুম গুহা
সেলফোনে ‘দে ছুট’ ভ্রমণ সংঘের বন্ধুদের জানিয়ে দিলাম সামনের ছুটিতে কুদুম গুহায় যাব। বন্ধুদের প্রশ্ন, ওরে বাবা এ আবার কোনো জায়গা। উত্তর না দিয়ে শুধু ভ্রমণের তারিখটি জানিয়ে দিলাম। দুর্গম অঞ্চল, প্রতিনিয়ত বিপদে পড়ার সম্ভাবনা। তাই বাছাই করে শুধু দুঃসাহসী অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বন্ধুদের ‘গুহায়’ যাওয়ার সঙ্গী করলাম। বেশ কয়েকবার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা টাইগার জসিম, নাসিরুদ্দিন কচি ও এমরান এবারের অভিযাত্রী। ২৫ তারিখ রাতে রওনা হয়ে সকাল ১১টায় পৌঁছলাম পর্যটন নগরী কক্সবাজার। রুম বুকিং করা ছিল, তাই বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হয়নি। সে দিনটি নীল জলরাশির নোনা জলে সাঁতার আর বিশালাকৃতির ঢেউয়ে ডুব দিয়ে আনন্দে কাটিয়ে দিলাম। রাতে পূর্ণিমার আলোতে বীচের অ্যাঞ্জেল ড্রপ রেস্টুরেন্টে কাঁকড়া ভাজা খাওয়ার স্বাদ নিলাম। পরের দিন সকালে টেকনাফের হোয়াইকংয়ের উদ্দেশে যাত্রা। কক্সবাজার থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা পথ বাস জার্নি করে পৌঁছলাম হোয়াইকং বাজার। সেখান থেকে সিএনজি করে হাড়িখোলা। হাড়িখোলার কর্তব্যরত পুলিশ বাধা দিল সিকিউরিটি ছাড়া কুদুম গুহায় না যাওয়ার জন্য। কোনোভাবেই তখন তাদের কাছ থেকে অনুমতি মিলল না, যখন বিকল্প চিন্তা শুরু করলাম। কারণ ভ্রমণে গিয়ে অভিযান অসমাপ্ত রেখে ফিরেছি এমন রেকর্ড আমার ঝুলিতে নেই। হাড়িখোলার কিছুক্ষণ অবস্থান করে যা দেখলাম তা রীতিমত শিউরে ওঠার মতো। হাড়িখোলা লোক শাপলাপুর বাজারে গিয়ে পুলিশ স্কটে জনগণ ও মালবাহী গাড়িতে যেতে হয়, অন্যথায় দিন-দুপুরেই নির্ঘাত দুর্ধর্ষ ডাকাতের সম্মুখীন। কুদুম গুহা পর্যবেক্ষণের আকুল বাসনা দেখে পুলিশ ফাঁড়িতে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। নব উদ্দীপনায় ছুটলাম ফাঁড়ির পানে, ফাঁড়ির ইনচার্জ দ্বারা যেন কোনো বাধা না আসে সে জন্য ত্বরিত গতিতে অবহিত করলাম আমার শ্রদ্ধেয় সচিবালয়ের সহকারী কর্মকর্তা শরফুদ্দিন আহম্মেদ রাজু ভাইকে। ফোনে তিনি আমাকে নিরাশ না করে শুধু ফাঁড়ি পৌঁছতে কতক্ষণ সময় লাগবে তা জেনে নিলেন। এরই মধ্যে ফাঁড়ি পৌঁছে ইনচার্জ জাহের সাহেবের শরণাপন্ন হলাম। ঢাকা থেকে এসেছি জেনেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফোর্স রেডি করে আমাদের সঙ্গে গুহা যাত্রায় পাঠিয়ে দিলেন। আমাদের চারজন সদস্যের সঙ্গে চারজন অস্ত্রধারী পোশাক পরা পুলিশ, সঙ্গে আরও দুজন সিভিল পুলিশ। আমাদের ভাবসাবই এখন অন্যরকম। বীরদর্পে চান্দের (স্থানীয় ভাষায়) গাড়িতে চড়ে আবার বাংলাদেশের একমাত্র মাটির গুহা কুদুম অভিমুখে যাত্রা। হাড়িখোলায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে হাতের বামে প্রায় দুই কিলোমিটার পাহাড়, গিরি পথ, বিশালাকৃতির সেগুন, চন্দন বৃক্ষের শীতল ছায়া; কখনও বা ভয়ঙ্কর জঙ্গলের পাশ দিয়ে হেঁটে চলা। হঠাত্ হাতির পায়ের চিহ্ন দেখে থমকে দাঁড়ালাম। পুলিশ সদস্যরা অভয় দিলেন, বন্যহাতি সাধারণত কাউকে ক্ষতি করে না। ওরা মানুষের ভালোমন্দ বোঝে। একজন জানালেন, ইউনিফর্ম পরা পুলিশের ওরা শুঁড় তুলে সালাম জানায় এবং সাধারণ মানুষ মন থেকে হাতিকে মামা বললে ওরা ক্ষতি করে না। ওদের কথায় এখন বন্যহাতি দেখারও স্বাদ জাগল। কিন্তু এক উদ্দেশ্যে বের হয়ে অন্য উদ্দেশ্য যোগ হলে তাতে দুটিই ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা। তাই পরবর্তী ভ্রমণে বন্যহাতি দেখার ইচ্ছা সুপ্ত করলাম। পাহাড় থেকে পাহাড় কাঠের পাটাতনের কয়েকটি ব্রিজ পার হতেই হাজির হলাম এই মাহেন্দ্রক্ষণে। গুহার মুখে এসে আশ্চর্যে আমাদের চোখ বড় হয়ে গেল। অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাঁটু পানিতে গুহার ভেতর প্রবেশ করলাম। পানির ভাপসা গন্ধ, এরপরও আনন্দ। অন্ধকারে বাস করা পাখিদের উড়ে চলা, চামচিকার কিচিরমিচির, ঘুটঘুটে অন্ধকার। সে এক অন্যরকম রোমাঞ্চ। আমাদের সঙ্গে নেয়া টর্চ সেখানে অকেজো। ভাগ্য ভালো পুলিশ সদস্যরা তাদের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টর্চলাইট সঙ্গে নিয়েছিল। গুহার ভেতরের ওপরের অংশে টর্চের আলো পড়তেই বিস্ময়ে অবাক, ওহ্! আল্লাহ এত সুন্দর প্রাকৃতিক নিদর্শন তুমি আমাদের দিয়েছ অথচ তার সদ্ব্যবহার আমরা করতে জানি না। গুহার অন্দকারে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে মনের আনন্দে বের হয়ে এলাম। এবার চারপাশ ঘুরে দেখা হলো পাইথনের খোলস। কথা প্রসঙ্গে জানা হলো পাইথনের অন্যতম প্রিয় খাবার চামচিকা। তাই গুহার ভেতর প্রবেশ মুহূর্তে টর্চ ও শক্ত লাঠি রাখা জরুরি। গলা শুকিয়ে কাঠ, কিন্তু সঙ্গে বিশুদ্ধ পানি নেই। তখন মনে পড়ে গেল ‘দে ছুট’ ভ্রমণ সংঘের প্রথম সদস্য বন্ধু শেখ মো. মোক্তার আলীর কথা। দুর্গম অঞ্চলে ভ্রমণে যাওয়ার প্রাক্কালে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিতে কখনও ভুল হয়নি তার। তাই বন্ধুদের কিঞ্চিত্ ভর্ত্সনা করে মোক্তারের কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম।
যেতে চাইলে
ঢাকা থেকে কক্সবাজার। নিজস্ব বাহনে অথবা লিংক রোড থেকে টেকনাফের গেটলক বাসে। নামতে হবে হোয়াইকং বাজার। স্থানীয় ফাঁড়ি থেকে পুলিশ স্কট নিয়ে যেতে হবে কুদুম গুহা। জনপ্রতি সর্বমোট খরচ যাই হোক কক্সবাজারে কাঁকড়া ভাজার স্বাদ নিতে কিন্তু ভুলবেন না। পরিশেষে বলতে হয়, প্রকৃতির দান কুদুম গুহার প্রতি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি সুদৃষ্টি দেয় তাহলে দার্জিলিংয়ের রক গার্ডেনের চেয়ে আমাদের হোয়াইকংয়ের কুদুম গুহার নয়ন জুড়ানো অপার সৌন্দর্যের প্রাকৃতিক দৃশ্য কোনো অংশে কম হবে কি?
Source: Daily Amardesh
Source: Daily Samakal
যেতে চাইলে
ঢাকা থেকে কক্সবাজার। নিজস্ব বাহনে অথবা লিংক রোড থেকে টেকনাফের গেটলক বাসে। নামতে হবে হোয়াইকং বাজার। স্থানীয় ফাঁড়ি থেকে পুলিশ স্কট নিয়ে যেতে হবে কুদুম গুহা। জনপ্রতি সর্বমোট খরচ যাই হোক কক্সবাজারে কাঁকড়া ভাজার স্বাদ নিতে কিন্তু ভুলবেন না। পরিশেষে বলতে হয়, প্রকৃতির দান কুদুম গুহার প্রতি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি সুদৃষ্টি দেয় তাহলে দার্জিলিংয়ের রক গার্ডেনের চেয়ে আমাদের হোয়াইকংয়ের কুদুম গুহার নয়ন জুড়ানো অপার সৌন্দর্যের প্রাকৃতিক দৃশ্য কোনো অংশে কম হবে কি?
Source: Daily Amardesh
সী মা ন্ত দী পু
বন্যহাতির পাহাড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গুহা
গোটা দুনিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আর কোনো সৈনিক জীবিত আছে কী-না সন্দেহ, তবে সেই যুদ্ধের ক্ষতচিহ্নগুলো এখনও মুছে যায়নি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতির জাদুঘর হয়ে মানুষকে মনে করিয়ে দেয় সেই বিভীষিকার রূপকথা। শ্রদ্ধেয় মরহুম শেখ আইনউদ্দিনের কাছ থেকে এ গুহা সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। তিনি ছিলেন রয়েল ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের একজন সাহসী সৈনিক। গত হয়েছেন ১৯৯৮ সালে। তিনিই আমাকে এক গভীর গুহার খবর দিয়েছিলেন। পরে জেনেছি এ গুহাটিই নাকি ব্রিটিশ সৈন্যদের বাঁচিয়েছিল তখন। দুর্গম এ গুহার অবস্থান এক গভীর জঙ্গলের উঁচু পাহাড়ে। বর্তমান টেকনাফ শহরের কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এ পাহাড়টির নাম নাইক্ষ্যং পাহাড়। নাফ নাদীর মোহনা থেকে মস্তবড় এ পাহাড়ের দিকে তাকালে চমকে ওঠে হৃদয়। পাহাড়টির চূড়া থেকে নদীর বেয়ে চলা যেন প্রকৃতির এক অপরূপ চাহনি। মিয়ানমারের সঙ্গে এই নদী দিয়েই এক সংযোগরেখা অঙ্কন হয়েছে বাংলার।
নাইক্ষ্যংকে চিনি বহুদিনের। মূলত বন্যপ্রাণীর টানেই ভবঘুরের মতো বারবার ছুটে যাওয়া হয় সেখানে। বন্যহাতি, প্যারাইল্লা বানর আর সাম্বার হরিণের জন্য সবাই নাইক্ষ্যংকে আলাদা করে চেনেন। এখন বানর আর হরিণের জাতটির দেখা বেশ কষ্টকর হলেও হাতির পাল দেখা যায় সহজেই। হাতি হিংস্র আর ভয়ঙ্কর বলেই সবাই জানেন। ওই নাইক্ষ্যং-এ যাওয়া হয়েছে বহুবার। কত রকমের পথ বেয়ে যে তাকে উপভোগ করেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু যতবারই গেছি সবসময়ই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই গুহার কথা মনে পড়েছে। চক্কর দিয়েছি, পথের সন্ধান করেছি, তবে খুঁজে পাইনি। সবশেষে শেখ আইনউদ্দিনের কথার সুর ধরে চলতে থাকলাম এবং পথ শেষে ঠিকানা ঠিকই মিলল গুহাটির। বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে একটি দুর্গম পাহাড়ে বিশ্বযুদ্ধের চিহ্ন খুঁজে পেয়ে বহুদিনের দেখার স্বাদ পূরণ হলো। গুহাটি কীভাবে আজও দরজা ফাঁক করে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে মিয়ানমারের দিকে তা ভাবতেই অবাক লাগে। যুদ্ধের দাবানল যখন তুঙ্গে তখন মিয়ানমারের দিক থেকে এক্সিস বাহিনী বাংলার সীমানার দিকে ধেয়ে আসছিল। জার্মানি, ইতালি, জাপানিজসহ অন্যরা এ দলে ছিল। এর আগে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইনের মতো আরও কিছু দেশ এ বাহিনীর কাছে ধরাশায়ী হয়েছিল। সেসময় ভারতবর্ষজুড়ে ব্রিটিশ বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করলেও তাদের সঙ্গে ইউএসএসহ অন্য মিত্ররা মিলে স্পেশাল অ্যালাইড বাহিনী গঠন করেছিল। এক্সিস বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের ভয়ে পাহাড়ি এলাকার অ্যালাইড গ্রুপ নাইক্ষ্যং পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। মিয়ানমারের দিক থেকে নাইক্ষ্যংয়ের দিকে ছুটে আসা এক্সিস সৈনিকদের সামনে তখন শুধুই ছিল নাফ নদী। ঠিক এমন সময় আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা মেরে যুদ্ধের মোড় পুরো ঘুরিয়ে দেয়। যুদ্ধ চলে যায় অ্যালাইডদের হাতে। নাফ থেকে পিছু হঠতে থাকে এক্সিস বাহিনী। এ সময় অ্যালাইডের সৈন্যরা নাইক্ষ্যংয়ের গুহার ভেতর থেকে মুখ খুলে গর্জন ছাড়ে। জয় হয় নাইক্ষ্যংয়ের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এ গুহাটি তাই পাহাড়টিকে এনে দিয়েছে বাড়তি এক মর্যাদা। নাইক্ষ্যংয়ের আশপাশের আরও দুটি আশ্চর্য আকর্ষণ হলো তৈগা চূড়া ও কুদুমের গুহা। ভয়ঙ্কর কুদুম গুহার ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর রয়েছে হাজারও চামচিকার ভিড়।
নাইক্ষ্যং পাহাড়ের চূড়া স্বপ্নের মতো সুন্দর। এখন থেকে মিয়ানমারের পর্বতশ্রেণী দেখার মজা আরও আনন্দের। আর এই দুই পর্বতের মধ্য দিয়ে বেয়ে গেছে এ দেশে সবচেয়ে সুন্দর নদী নাফ। নাফের বেয়ে চলা, সাগরের সঙ্গে তার মিলন দেখলে সবাই পাগল হবেন তার রূপের মোহনায়। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো দু'দেশের জেলেরা এ নদীতে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে মিলেমিশে মাছ ধরে, দেখা হলে কুশল বিনিময় হয়। নদীতে আছে হরেক রকমের পরিযায়ী পাখি। আরও আছে গানজেজ ও ইরাবতি ডলফিনের দল। শুধু এই একটি পাহাড়কে ঘিরেই কত যে স্বপ্ন সমষ্টিবদ্ধ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
খুঁজে পাওয়া নাইক্ষ্যং পাহাড়ের। গুহার দরজায় দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের পর্বতশ্রেণী দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতো। পেয়েছিলাম। সে যুগে জয় হয়েছিল নাইক্ষ্যংয়েরই। পাহাড়টি এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, অ্যালাইড বাহিনী চলে গেছে। তৈরি হয়েছে দুটি দেশের আলাদা মানচিত্র। এখন এর একপাশের পাহারাদার বিডিআর, অন্যপাশে আছে নাসাকা বাহিনী। দু'দেশের সীমানার ভেতর চাইলেই আর কেউ ঢুকতে পারেন না। অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে, আছে আইন মেনে চলার কঠোর সিদ্ধান্ত। তবে সে যুগের আদিপ্রথা এখনও টিকে আছে পাহাড়ি বন্যহাতিদের বেলায়। তাদের কোনো পাসপোর্ট লাগে না। মাঝেমধ্যে মিয়ানমার পাহাড় থেকে হাতির পাল খাবার সন্ধানে চলে আসে নাইক্ষ্যংয়ের দিকে। একটা বিশেষ সময় পার করে আবার ফিরে যায় নিজ দেশে। বন্যপ্রাণীর মতো এই সম্প্রীতি সবার মধ্যে তৈরি হলেই কেবল যুদ্ধের মতো ক্ষতচিহ্নগুলো আর হবে না।
লেখক : বন্য প্রাণী গবেষক ও লেখকনাইক্ষ্যংকে চিনি বহুদিনের। মূলত বন্যপ্রাণীর টানেই ভবঘুরের মতো বারবার ছুটে যাওয়া হয় সেখানে। বন্যহাতি, প্যারাইল্লা বানর আর সাম্বার হরিণের জন্য সবাই নাইক্ষ্যংকে আলাদা করে চেনেন। এখন বানর আর হরিণের জাতটির দেখা বেশ কষ্টকর হলেও হাতির পাল দেখা যায় সহজেই। হাতি হিংস্র আর ভয়ঙ্কর বলেই সবাই জানেন। ওই নাইক্ষ্যং-এ যাওয়া হয়েছে বহুবার। কত রকমের পথ বেয়ে যে তাকে উপভোগ করেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু যতবারই গেছি সবসময়ই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই গুহার কথা মনে পড়েছে। চক্কর দিয়েছি, পথের সন্ধান করেছি, তবে খুঁজে পাইনি। সবশেষে শেখ আইনউদ্দিনের কথার সুর ধরে চলতে থাকলাম এবং পথ শেষে ঠিকানা ঠিকই মিলল গুহাটির। বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে একটি দুর্গম পাহাড়ে বিশ্বযুদ্ধের চিহ্ন খুঁজে পেয়ে বহুদিনের দেখার স্বাদ পূরণ হলো। গুহাটি কীভাবে আজও দরজা ফাঁক করে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে মিয়ানমারের দিকে তা ভাবতেই অবাক লাগে। যুদ্ধের দাবানল যখন তুঙ্গে তখন মিয়ানমারের দিক থেকে এক্সিস বাহিনী বাংলার সীমানার দিকে ধেয়ে আসছিল। জার্মানি, ইতালি, জাপানিজসহ অন্যরা এ দলে ছিল। এর আগে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইনের মতো আরও কিছু দেশ এ বাহিনীর কাছে ধরাশায়ী হয়েছিল। সেসময় ভারতবর্ষজুড়ে ব্রিটিশ বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করলেও তাদের সঙ্গে ইউএসএসহ অন্য মিত্ররা মিলে স্পেশাল অ্যালাইড বাহিনী গঠন করেছিল। এক্সিস বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের ভয়ে পাহাড়ি এলাকার অ্যালাইড গ্রুপ নাইক্ষ্যং পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। মিয়ানমারের দিক থেকে নাইক্ষ্যংয়ের দিকে ছুটে আসা এক্সিস সৈনিকদের সামনে তখন শুধুই ছিল নাফ নদী। ঠিক এমন সময় আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা মেরে যুদ্ধের মোড় পুরো ঘুরিয়ে দেয়। যুদ্ধ চলে যায় অ্যালাইডদের হাতে। নাফ থেকে পিছু হঠতে থাকে এক্সিস বাহিনী। এ সময় অ্যালাইডের সৈন্যরা নাইক্ষ্যংয়ের গুহার ভেতর থেকে মুখ খুলে গর্জন ছাড়ে। জয় হয় নাইক্ষ্যংয়ের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এ গুহাটি তাই পাহাড়টিকে এনে দিয়েছে বাড়তি এক মর্যাদা। নাইক্ষ্যংয়ের আশপাশের আরও দুটি আশ্চর্য আকর্ষণ হলো তৈগা চূড়া ও কুদুমের গুহা। ভয়ঙ্কর কুদুম গুহার ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর রয়েছে হাজারও চামচিকার ভিড়।
নাইক্ষ্যং পাহাড়ের চূড়া স্বপ্নের মতো সুন্দর। এখন থেকে মিয়ানমারের পর্বতশ্রেণী দেখার মজা আরও আনন্দের। আর এই দুই পর্বতের মধ্য দিয়ে বেয়ে গেছে এ দেশে সবচেয়ে সুন্দর নদী নাফ। নাফের বেয়ে চলা, সাগরের সঙ্গে তার মিলন দেখলে সবাই পাগল হবেন তার রূপের মোহনায়। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো দু'দেশের জেলেরা এ নদীতে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে মিলেমিশে মাছ ধরে, দেখা হলে কুশল বিনিময় হয়। নদীতে আছে হরেক রকমের পরিযায়ী পাখি। আরও আছে গানজেজ ও ইরাবতি ডলফিনের দল। শুধু এই একটি পাহাড়কে ঘিরেই কত যে স্বপ্ন সমষ্টিবদ্ধ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
খুঁজে পাওয়া নাইক্ষ্যং পাহাড়ের। গুহার দরজায় দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের পর্বতশ্রেণী দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতো। পেয়েছিলাম। সে যুগে জয় হয়েছিল নাইক্ষ্যংয়েরই। পাহাড়টি এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, অ্যালাইড বাহিনী চলে গেছে। তৈরি হয়েছে দুটি দেশের আলাদা মানচিত্র। এখন এর একপাশের পাহারাদার বিডিআর, অন্যপাশে আছে নাসাকা বাহিনী। দু'দেশের সীমানার ভেতর চাইলেই আর কেউ ঢুকতে পারেন না। অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে, আছে আইন মেনে চলার কঠোর সিদ্ধান্ত। তবে সে যুগের আদিপ্রথা এখনও টিকে আছে পাহাড়ি বন্যহাতিদের বেলায়। তাদের কোনো পাসপোর্ট লাগে না। মাঝেমধ্যে মিয়ানমার পাহাড় থেকে হাতির পাল খাবার সন্ধানে চলে আসে নাইক্ষ্যংয়ের দিকে। একটা বিশেষ সময় পার করে আবার ফিরে যায় নিজ দেশে। বন্যপ্রাণীর মতো এই সম্প্রীতি সবার মধ্যে তৈরি হলেই কেবল যুদ্ধের মতো ক্ষতচিহ্নগুলো আর হবে না।
Source: Daily Samakal
No comments:
Post a Comment