বেড়া নো : ঘুরে আসুন শ্রীমঙ্গল
আতাউর রহমান কাজল
চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল। পাহাড়, অরণ্য, হাওর আর সবুজ চা-বাগান ঘেরা শ্রীমঙ্গল। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য আর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে যাওয়ার এখনি সময়। প্রকৃতির সুরম্য নিকেতন শ্রীমঙ্গলে দেখার আছে চা-বাগানের পর চা-বাগান, চা প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র, লাউয়াছড়া রেইনফরেস্ট, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ, চা গবেষণা কেন্দ্র, লাউয়াছড়া ইন্সপেকশন বাংলো, খাসিয়া পুঞ্জি, মণিপুরীপাড়া, হাইল-হাওর, ডিনস্টন সিমেট্রি, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান নির্মাই শিববাড়ি, টি-রিসোর্ট, ভাড়াউড়া লেক, হাজার প্রজাতির গাছ-গাছালি, দিগন্তজোড়া হাওর প্রভৃতি।
চা শিল্পের জন্য শ্রীমঙ্গলের সুনাম ও পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে শ্রীমঙ্গলের অবস্থান। ৪২৫ দশমিক ১৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জনপদের সঙ্গে রেল ও সড়কপথে যোগাযোগ রয়েছে সারা দেশের। ভ্রমণবিলাসীদের কাছে এ এলাকাটি যেন তীর্থস্থান।
কী কী দেখবেন
চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) : চারদিকে সবুজের সমারোহ। যেদিকে চোখ যায়, চা-বাগান আর চা-বাগান। এরই মাঝে দাঁড়িয়ে আছে দেশের একমাত্র চা গবেষণা ইনস্টিটিউট। এ ক্যাম্পাসে আছে সারিবদ্ধ পাম, ইউক্যালিপটাস ইত্যাদি বৃক্ষের শোভা। লেকের জলে ফুটন্ত লাল জলপদ্ম। এছাড়াও এখানে রয়েছে একটি চা প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র। পরিচালকের অনুমতি সাপেক্ষে চা কারখানাসহ পুরো এলাকাটি আপনি দেখে নিতে পারেন। টি রিসোর্ট : শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়কের পাশে ভাড়াউড়া চা-বাগান সংলগ্ন ২৫.৮৩ একর জায়গার ওপর টি রিসোর্টের অবস্থান। অন্যান্য সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য সুইমিংপুলসহ একটি অত্যাধুনিক টেনিস কোর্ট ও একটি ব্যাডমিন্টন কোর্টও রয়েছে এখানে। ২ রুম বিশিস্ট কটেজের ভাড়া ৩ হাজার টাকা এবং ৩ রুমবিশিষ্ট কটেজের ভাড়া ৪ হাজার টাকা। ভিআইপি রুম ২ হাজার টাকা এবং আইপি রুম দেড় হাজার টাকা।
সিতেশবাবুর চিড়িয়াখানা : দুর্দান্ত সাহসী বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবিদ সিতেশরঞ্জন দেব। এ মানুষটির সখ্য বনের পশু-পাখিদের সঙ্গে। সেই সখ্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ শহরের মিশন রোড এলাকায় তার নিজ বাসভবনে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা মিনি-চিড়িয়াখানাটি।
লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক : শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ন্যাশনাল পার্ক লাউয়াছড়ার অবস্থান। শ্রীমঙ্গল থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে অথবা বাসে চড়ে আপনি আসতে পারেন এই বনে। এখানে একটি পিকনিক স্পট আছে। এর নাম শ্যামলী। শ্যামলী থেকে আর কিছুদূর পথ গেলে লাউয়াছড়া বন বিট অফিস ও ইন্সপেকশন বাংলো চোখে পড়বে। বন বিট কার্যালয়ের সামনে দেখতে পাবেন দক্ষিণ এশিয়ার বিরল প্রজাতির ‘আফ্রিকান টিক ওক’ বৃক্ষ যা দীর্ঘকাল থেকে ক্লোরোফর্ম বৃক্ষ নামে পরিচিত। এখানে পৌঁছার পর আপনি ইচ্ছে করলে হারিয়ে যেতে পারেন ঘন সবুজ অরণ্যে। দেখতে পাবেন উল্লুক, বনমোরগ, খরগোশ, বানর, হনুমান, হরিণ, ভল্লুক, চিতাবাঘসহ নানা প্রজাতির পশুপাখি। এসব প্রাণী দেখতে বনের একটু গভীরে যেতে হবে। ভেতরে যেতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ইকো-ট্যুর গাইডের সাহায্য নিতে পারেন।
ভাড়াউড়া লেক : শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ২ কিলোমিটার দূরে জেমস ফিনলে কোম্পানির চা-বাগান ভাড়াউড়ায় রয়েছে একটি লেক। লেকে রয়েছে জলপদ্মের মেলা। চা -বাগানের বুকে এই লেকটির আকর্ষণ কম নয়। এখানে আছে বানর আর হনুমানের বিচরণ। শীতে দলবেঁধে আসে অতিথি পাখি। পাহাড়ের কাছাকাছি গেলেই দেখতে পাবেন একসঙ্গে অনেক বানর। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখুন। দেখবেন বানরগুলো আপনাকে ভেংচি কাটছে।
নির্মাই শিববাড়ি : আজ থেকে প্রায় ৫৫২ বছর আগে ১৪৫৪ খ্রিস্টাব্দে শ্রীমঙ্গলের বালিশিরা পরগণার শঙ্করসেনা গ্রামে নির্মাই শিববাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। চতুর্দশ শতাব্দীতে বালিশিরা অঞ্চলে ত্রিপুরার মহারাজা রাজত্ব করতেন। প্রবল শক্তিশালী এ রাজার বিরুদ্ধে ‘কুকি’ সামন্তরাজা প্রায়ই বিদ্রোহ ঘোষণা করতেন। এরকম কোনো একদিন কুকিরাজার বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে মহারাজা একদল সৈন্য পাঠান বিদ্রোহ দমন করতে। তুমুল এ যুদ্ধে কুকিরা পরাজিত হলেও মহারাজার প্রধান সেনাপতি রণক্ষেত্রে নিহত হন। বিয়ের অল্প ক’বছরের মধ্যেই স্বামীহারা হন মহারাজা কন্যা নির্মাই। তখনকার দিনে ভারতবর্ষে সহমরণ প্রথা চালু ছিল। কিন্তু রাজকন্যা সহমরণে রাজি না হয়ে স্বামী নিহত হওয়ার স্থানে এসে শিবের আরাধনা শুরু করেন এবং সিদ্ধিও লাভ করেন। তার নামেই শিববাড়ির নামকরণ করা হয় নির্মাই শিববাড়ি। ঐতিহাসিক এই স্থানটি ধর্মীয় পৌরাণিক কাহিনী, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আচার-আচরণে একটি অন্যতম তীর্থস্থানের মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে লাইটেস, কার ও টেম্পোযোগে ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই এখানে পৌঁছা যায়।
হাইল-হাওর : শ্রীমঙ্গল শহরের পশ্চিম প্রান্তে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আছে এককালে বৃহত্তর সিলেটের মত্স্যভাণ্ডার বলে খ্যাত বিখ্যাত হাইল-হাওর। এই হাওরে শীত মৌসুমে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে আসে অতিথি পাখিরা। তারা দল বেঁধে হাওরে সাঁতার কেটে বেড়ায়। নৌকায় চড়ে অতিথি পাখিদের সাঁতার কাটা, জলকেলি ও জেলেদের মা ছধরার দৃশ্য দেখতে পারেন। হাওরের বাইক্কা বিলে নির্মিত পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে উঠে অতিথি পাখিদের দেখতে পারবেন। শীত মৌসুমে বাইক্কা বিলে হাজার হাজার পাখির অবাধ বিচরণের দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে।
মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি : বনবাদাড় আর গাছপালার সবুজ সমুদ্রের বুক চিরে চলে যাওয়া সড়ক আর রেলপথ পেরুলেই রয়েছে খাসিয়া আদিবাসী সম্প্রদায়ের একটি পুঞ্জি। এ পুঞ্জির নাম মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি। মাটির সিঁড়ি বেয়ে আপনি উঠে যেতে পারেন টিলা-পাহাড়ের মাথায়। ছোট ছোট অনেক টিলার উপর তারা গড়ে তুলেছেন নিজ নিজ বসতবাড়ি। তাদের ভাষায় একে বলে পুঞ্জি। খাসিয়া সম্প্রদায় গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বাস করে এখানে। প্রতিটি পুঞ্জিতে একজন করে মন্ত্রী (খাসিয়াদের প্রধান) থাকেন। পুঞ্জির মানুষের জীবনযাত্রাকে জানতে হলে মন্ত্রীর অনুমতি প্রয়োজন। খাসিয়ারা থাকে শহরের যান্ত্রিক জীবন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা মেজাজে, ভিন্ন পরিবেশে। একটু চোখ ফেরালেই দেখতে পাবেন পানের বরজ। খাসিয়া পুঞ্জি ঘুরে আপনি সহজেই খাসিয়াদের স্বতন্ত্র এবং বিচিত্র জীবনধারা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। মাগুরছড়া পরিত্যক্ত গ্যাসকূপ : ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন গভীর রাতে এ গ্যাসকূপে ড্রিলিংয়ের সময় অগ্নিবিস্ফোরণে আশপাশের খাসিয়া পুঞ্জি, চা-বাগান, রেললাইন, সবুজ বনাঞ্চল সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এই গ্যাসকূপটি এখন পরিত্যক্ত এবং সংরক্ষিত এলাকা। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। গত ৮ বছর ধরে এ এলাকাটিতে আবার সজীবতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে বন বিভাগ। আগুনে পোড়া গাছগুলো এখনও কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মাগুরছড়ায়। দর্শনার্থীরা এ এলাকায় বেড়াতে এসে অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করে মাগুরছড়ার দৃশ্যাবলি। অগ্নিকাণ্ডের কারণে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিলুপ্ত জীববৈচিত্র্য অচিরেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে কিনা এ নিয়েও রয়েছে সংশয়। মাগুরছড়ার এ এলাকাকে এখন অনুপম পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা যায়। শ্রীমঙ্গল থেকে সড়কপথে এখানে আসতে নয়ন ভোলানো প্রাকৃতিক দৃশ্য এই পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এখন প্রয়োজন কেবল উদ্যোগ আর আন্তরিকতার।
ডিনস্টন সিমেট্রি : শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ডিনস্টন চা-বাগানে এর অবস্থান। শতাধিক বছর আগে শ্রীমঙ্গলের ডিনস্টন চা-বাগানে ডিনস্টন সিমেট্রি’র গোড়াপত্তন হয়। ১৮৮০ সালে শ্রীমঙ্গল অঞ্চলে ব্রিটিশদের দ্বারা বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হওয়ার পর সুদূর ব্রিটেন থেকে এখানে টি প্ল্যান্টারদের আগমন ঘটতে থাকে। সেই যুগে যেসব বিদেশি এই অঞ্চলে মারা যান, সেসব বিদেশিকে সমাহিত করা হয় শ্রীমঙ্গলের ডিনস্টন সিমেট্রিতে। উঁচু-নিচু পাহাড় টিলায় ঘেরা চিরসবুজ চা-বাগানের মাঝে অবস্থিত এই সিমেট্রিতে বিদেশিদের কবর রয়েছে ৪৬টি।
কীভাবে আসবেন : প্রতিদিন ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গলের পথে তিনটি আন্তঃনগর ট্রেন যাত্রা করে। ৫ ঘণ্টায় আপনি পৌঁছে যাবেন শ্রীমঙ্গল। পারাবত এক্সপ্রেস সকাল সাড়ে ৬টায়, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস দুপুর ২টায় এবং উপবন রাত সাড়ে ১০টায়। ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গলের চেয়ারকোচের ভাড়া ১৩৫ টাকা, ১ম চেয়ার ২০০ টাকা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচে ৩০০ টাকা এবং স্লিপিং কোচে ৩৬০ টাকা। টিকিট সংগ্রহ করা যাবে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে। বাসে যেতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে। বাস ভাড়া ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এসি বাসে খরচ পড়বে ২৫০ টাকা।
কোথায় থাকবেন : শ্রীমঙ্গল শহরে ২০টিরও বেশি আবাসিক হোটেল রয়েছে। ভালো দেখে যে কোনো একটিতে উঠতে পারেন। ভাড়া মোটামুটি কম। শ্রীমঙ্গল শহরের উল্লেখযোগ্য হোটেলগুলো হলো—টি টাউন রেস্ট হাউস, হোটেল সন্ধ্যা, এলাহী প্লাজা, হোটেল বিরতি, আল-রহমান, হোটেল মুক্তা ও হোটেল নীলিমা। এছাড়াও সরকারি ও আধা-সরকারি সংস্থাগুলোর বেশকিছু বাংলো রয়েছে এখানে। কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি সাপেক্ষে এখানে উঠতে পারেন। শ্রীমঙ্গলের সব দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখতে হলে অন্তত ৩-৪ দিন সময় নিয়ে এলেই ভালো হয়। সপরিবারে যেতে পারেন আবার বন্ধু-বান্ধব মিলে একত্রেও যেতে পারেন। শহরে খাওয়া-দাওয়ার জন্য অনেক হোটেল রয়েছে। নূর ফুডস, শাহ হোটেল, নোয়াখালী হোটেলের যে কোনো একটিতে আপনি স্বল্প খরচে খাওয়ার কাজ সেরে
নিতে পারেন।
চা শিল্পের জন্য শ্রীমঙ্গলের সুনাম ও পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে শ্রীমঙ্গলের অবস্থান। ৪২৫ দশমিক ১৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ জনপদের সঙ্গে রেল ও সড়কপথে যোগাযোগ রয়েছে সারা দেশের। ভ্রমণবিলাসীদের কাছে এ এলাকাটি যেন তীর্থস্থান।
কী কী দেখবেন
চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) : চারদিকে সবুজের সমারোহ। যেদিকে চোখ যায়, চা-বাগান আর চা-বাগান। এরই মাঝে দাঁড়িয়ে আছে দেশের একমাত্র চা গবেষণা ইনস্টিটিউট। এ ক্যাম্পাসে আছে সারিবদ্ধ পাম, ইউক্যালিপটাস ইত্যাদি বৃক্ষের শোভা। লেকের জলে ফুটন্ত লাল জলপদ্ম। এছাড়াও এখানে রয়েছে একটি চা প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র। পরিচালকের অনুমতি সাপেক্ষে চা কারখানাসহ পুরো এলাকাটি আপনি দেখে নিতে পারেন। টি রিসোর্ট : শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়কের পাশে ভাড়াউড়া চা-বাগান সংলগ্ন ২৫.৮৩ একর জায়গার ওপর টি রিসোর্টের অবস্থান। অন্যান্য সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য সুইমিংপুলসহ একটি অত্যাধুনিক টেনিস কোর্ট ও একটি ব্যাডমিন্টন কোর্টও রয়েছে এখানে। ২ রুম বিশিস্ট কটেজের ভাড়া ৩ হাজার টাকা এবং ৩ রুমবিশিষ্ট কটেজের ভাড়া ৪ হাজার টাকা। ভিআইপি রুম ২ হাজার টাকা এবং আইপি রুম দেড় হাজার টাকা।
সিতেশবাবুর চিড়িয়াখানা : দুর্দান্ত সাহসী বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবিদ সিতেশরঞ্জন দেব। এ মানুষটির সখ্য বনের পশু-পাখিদের সঙ্গে। সেই সখ্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ শহরের মিশন রোড এলাকায় তার নিজ বাসভবনে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা মিনি-চিড়িয়াখানাটি।
লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক : শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ন্যাশনাল পার্ক লাউয়াছড়ার অবস্থান। শ্রীমঙ্গল থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে অথবা বাসে চড়ে আপনি আসতে পারেন এই বনে। এখানে একটি পিকনিক স্পট আছে। এর নাম শ্যামলী। শ্যামলী থেকে আর কিছুদূর পথ গেলে লাউয়াছড়া বন বিট অফিস ও ইন্সপেকশন বাংলো চোখে পড়বে। বন বিট কার্যালয়ের সামনে দেখতে পাবেন দক্ষিণ এশিয়ার বিরল প্রজাতির ‘আফ্রিকান টিক ওক’ বৃক্ষ যা দীর্ঘকাল থেকে ক্লোরোফর্ম বৃক্ষ নামে পরিচিত। এখানে পৌঁছার পর আপনি ইচ্ছে করলে হারিয়ে যেতে পারেন ঘন সবুজ অরণ্যে। দেখতে পাবেন উল্লুক, বনমোরগ, খরগোশ, বানর, হনুমান, হরিণ, ভল্লুক, চিতাবাঘসহ নানা প্রজাতির পশুপাখি। এসব প্রাণী দেখতে বনের একটু গভীরে যেতে হবে। ভেতরে যেতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ইকো-ট্যুর গাইডের সাহায্য নিতে পারেন।
ভাড়াউড়া লেক : শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ২ কিলোমিটার দূরে জেমস ফিনলে কোম্পানির চা-বাগান ভাড়াউড়ায় রয়েছে একটি লেক। লেকে রয়েছে জলপদ্মের মেলা। চা -বাগানের বুকে এই লেকটির আকর্ষণ কম নয়। এখানে আছে বানর আর হনুমানের বিচরণ। শীতে দলবেঁধে আসে অতিথি পাখি। পাহাড়ের কাছাকাছি গেলেই দেখতে পাবেন একসঙ্গে অনেক বানর। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখুন। দেখবেন বানরগুলো আপনাকে ভেংচি কাটছে।
নির্মাই শিববাড়ি : আজ থেকে প্রায় ৫৫২ বছর আগে ১৪৫৪ খ্রিস্টাব্দে শ্রীমঙ্গলের বালিশিরা পরগণার শঙ্করসেনা গ্রামে নির্মাই শিববাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। চতুর্দশ শতাব্দীতে বালিশিরা অঞ্চলে ত্রিপুরার মহারাজা রাজত্ব করতেন। প্রবল শক্তিশালী এ রাজার বিরুদ্ধে ‘কুকি’ সামন্তরাজা প্রায়ই বিদ্রোহ ঘোষণা করতেন। এরকম কোনো একদিন কুকিরাজার বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে মহারাজা একদল সৈন্য পাঠান বিদ্রোহ দমন করতে। তুমুল এ যুদ্ধে কুকিরা পরাজিত হলেও মহারাজার প্রধান সেনাপতি রণক্ষেত্রে নিহত হন। বিয়ের অল্প ক’বছরের মধ্যেই স্বামীহারা হন মহারাজা কন্যা নির্মাই। তখনকার দিনে ভারতবর্ষে সহমরণ প্রথা চালু ছিল। কিন্তু রাজকন্যা সহমরণে রাজি না হয়ে স্বামী নিহত হওয়ার স্থানে এসে শিবের আরাধনা শুরু করেন এবং সিদ্ধিও লাভ করেন। তার নামেই শিববাড়ির নামকরণ করা হয় নির্মাই শিববাড়ি। ঐতিহাসিক এই স্থানটি ধর্মীয় পৌরাণিক কাহিনী, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আচার-আচরণে একটি অন্যতম তীর্থস্থানের মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে লাইটেস, কার ও টেম্পোযোগে ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই এখানে পৌঁছা যায়।
হাইল-হাওর : শ্রীমঙ্গল শহরের পশ্চিম প্রান্তে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আছে এককালে বৃহত্তর সিলেটের মত্স্যভাণ্ডার বলে খ্যাত বিখ্যাত হাইল-হাওর। এই হাওরে শীত মৌসুমে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে আসে অতিথি পাখিরা। তারা দল বেঁধে হাওরে সাঁতার কেটে বেড়ায়। নৌকায় চড়ে অতিথি পাখিদের সাঁতার কাটা, জলকেলি ও জেলেদের মা ছধরার দৃশ্য দেখতে পারেন। হাওরের বাইক্কা বিলে নির্মিত পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে উঠে অতিথি পাখিদের দেখতে পারবেন। শীত মৌসুমে বাইক্কা বিলে হাজার হাজার পাখির অবাধ বিচরণের দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে।
মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি : বনবাদাড় আর গাছপালার সবুজ সমুদ্রের বুক চিরে চলে যাওয়া সড়ক আর রেলপথ পেরুলেই রয়েছে খাসিয়া আদিবাসী সম্প্রদায়ের একটি পুঞ্জি। এ পুঞ্জির নাম মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি। মাটির সিঁড়ি বেয়ে আপনি উঠে যেতে পারেন টিলা-পাহাড়ের মাথায়। ছোট ছোট অনেক টিলার উপর তারা গড়ে তুলেছেন নিজ নিজ বসতবাড়ি। তাদের ভাষায় একে বলে পুঞ্জি। খাসিয়া সম্প্রদায় গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বাস করে এখানে। প্রতিটি পুঞ্জিতে একজন করে মন্ত্রী (খাসিয়াদের প্রধান) থাকেন। পুঞ্জির মানুষের জীবনযাত্রাকে জানতে হলে মন্ত্রীর অনুমতি প্রয়োজন। খাসিয়ারা থাকে শহরের যান্ত্রিক জীবন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা মেজাজে, ভিন্ন পরিবেশে। একটু চোখ ফেরালেই দেখতে পাবেন পানের বরজ। খাসিয়া পুঞ্জি ঘুরে আপনি সহজেই খাসিয়াদের স্বতন্ত্র এবং বিচিত্র জীবনধারা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। মাগুরছড়া পরিত্যক্ত গ্যাসকূপ : ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন গভীর রাতে এ গ্যাসকূপে ড্রিলিংয়ের সময় অগ্নিবিস্ফোরণে আশপাশের খাসিয়া পুঞ্জি, চা-বাগান, রেললাইন, সবুজ বনাঞ্চল সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এই গ্যাসকূপটি এখন পরিত্যক্ত এবং সংরক্ষিত এলাকা। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। গত ৮ বছর ধরে এ এলাকাটিতে আবার সজীবতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে বন বিভাগ। আগুনে পোড়া গাছগুলো এখনও কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মাগুরছড়ায়। দর্শনার্থীরা এ এলাকায় বেড়াতে এসে অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করে মাগুরছড়ার দৃশ্যাবলি। অগ্নিকাণ্ডের কারণে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিলুপ্ত জীববৈচিত্র্য অচিরেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে কিনা এ নিয়েও রয়েছে সংশয়। মাগুরছড়ার এ এলাকাকে এখন অনুপম পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা যায়। শ্রীমঙ্গল থেকে সড়কপথে এখানে আসতে নয়ন ভোলানো প্রাকৃতিক দৃশ্য এই পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এখন প্রয়োজন কেবল উদ্যোগ আর আন্তরিকতার।
ডিনস্টন সিমেট্রি : শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ডিনস্টন চা-বাগানে এর অবস্থান। শতাধিক বছর আগে শ্রীমঙ্গলের ডিনস্টন চা-বাগানে ডিনস্টন সিমেট্রি’র গোড়াপত্তন হয়। ১৮৮০ সালে শ্রীমঙ্গল অঞ্চলে ব্রিটিশদের দ্বারা বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হওয়ার পর সুদূর ব্রিটেন থেকে এখানে টি প্ল্যান্টারদের আগমন ঘটতে থাকে। সেই যুগে যেসব বিদেশি এই অঞ্চলে মারা যান, সেসব বিদেশিকে সমাহিত করা হয় শ্রীমঙ্গলের ডিনস্টন সিমেট্রিতে। উঁচু-নিচু পাহাড় টিলায় ঘেরা চিরসবুজ চা-বাগানের মাঝে অবস্থিত এই সিমেট্রিতে বিদেশিদের কবর রয়েছে ৪৬টি।
কীভাবে আসবেন : প্রতিদিন ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গলের পথে তিনটি আন্তঃনগর ট্রেন যাত্রা করে। ৫ ঘণ্টায় আপনি পৌঁছে যাবেন শ্রীমঙ্গল। পারাবত এক্সপ্রেস সকাল সাড়ে ৬টায়, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস দুপুর ২টায় এবং উপবন রাত সাড়ে ১০টায়। ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গলের চেয়ারকোচের ভাড়া ১৩৫ টাকা, ১ম চেয়ার ২০০ টাকা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচে ৩০০ টাকা এবং স্লিপিং কোচে ৩৬০ টাকা। টিকিট সংগ্রহ করা যাবে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে। বাসে যেতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে। বাস ভাড়া ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এসি বাসে খরচ পড়বে ২৫০ টাকা।
কোথায় থাকবেন : শ্রীমঙ্গল শহরে ২০টিরও বেশি আবাসিক হোটেল রয়েছে। ভালো দেখে যে কোনো একটিতে উঠতে পারেন। ভাড়া মোটামুটি কম। শ্রীমঙ্গল শহরের উল্লেখযোগ্য হোটেলগুলো হলো—টি টাউন রেস্ট হাউস, হোটেল সন্ধ্যা, এলাহী প্লাজা, হোটেল বিরতি, আল-রহমান, হোটেল মুক্তা ও হোটেল নীলিমা। এছাড়াও সরকারি ও আধা-সরকারি সংস্থাগুলোর বেশকিছু বাংলো রয়েছে এখানে। কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি সাপেক্ষে এখানে উঠতে পারেন। শ্রীমঙ্গলের সব দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখতে হলে অন্তত ৩-৪ দিন সময় নিয়ে এলেই ভালো হয়। সপরিবারে যেতে পারেন আবার বন্ধু-বান্ধব মিলে একত্রেও যেতে পারেন। শহরে খাওয়া-দাওয়ার জন্য অনেক হোটেল রয়েছে। নূর ফুডস, শাহ হোটেল, নোয়াখালী হোটেলের যে কোনো একটিতে আপনি স্বল্প খরচে খাওয়ার কাজ সেরে
নিতে পারেন।
No comments:
Post a Comment