Search This Blog

FCO Travel Advice

Bangladesh Travel Advice

AFRICA Travel Widget

Asia Travel Widget

Tuesday, November 9, 2010

সাকিন সুন্দরবন

সাকিন সুন্দরবন
- মাহবুব লীলেন

- দেও দিকিনি। এইটাতে কিছু চার দেও তো

বাপ্পী ভাই একটা গামলা ছুঁড়ে মারল লোকটার নৌকায়। গামলাটা তার কোলের কাছে পড়লেও অনেকক্ষণ সেদিকে তাকালই না লোকটা। হাঁটুতে মাথা গুঁজে থাকলেও বাপ্পী ভাইর তার দিকে তাকিয়ে থাকা অনুভব করছিল সে। এবার বাপ্পী ভাইর দিকে তাকিয়ে গামলাটা টেনে নিজের গামলা থেকে বেছে বেছে কেজি দেড়েক চিংড়ি আর বারোয়ারি মাছ তুলে দিয়ে বাপ্পী ভাইর হাতে দেবার জন্য যখন উঠে দাঁড়াল তখনই- অ্যাহ। এইটাতে কী হবে? ওর ওখান থেকেও কিছু দেও...

লোকটা হাত গুটিয়ে বসে পড়ার আগেই আমরা তাকে গামলা ধরে পোজ দিতে বললাম। জেলের হাতে তরতাজা মাছ। দারুণ সমৃদ্ধির প্রতীক... ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাকে দিয়ে ছবির পোজ দেয়ালাম। তারপর ছেড়ে দিলে লোকটা নিজের জায়গায় বসে গামলাটা নৌকার ভেতর দিয়ে ঠেলে দিল অন্য গলুইয়ে বসা গোঁয়ার ছেলেটার দিকে- দ্যাও। কী দেবা দেও। স্যাররা কিছু চার চায়...

একটু পরে আরো কিছু মাছ নিয়ে গামলাটা তিন মাথার কাছে ফিরে এলে সে বাড়িয়ে দিলো বাপ্পী ভাইকে। খেঁকিয়ে উঠল বাপ্পী ভাই- কী দিলা এইসব? আরো কিছু দেও। আমারাও তো মাছ ধরব...

লোকটা নিজের গামলা থেকে আরো কয়েকটা মাছ তুলে দিলো আমাদের গামলায়। বাপ্পী ভাই অতগুলা মানুষের মাছ ধরার জন্য আরো কিছু চার চায়। লোকটা এবার আর নড়ে না। আমাদের গামলা আর তার নিজের গামলার দিকে তাককায়। তার গামলায় টোপের পরিমাণ আমাদের গামলার অর্ধেক। লোকটা মরিয়া হয়ে উঠে আতঙ্কে- স্যার। আর দিলি আমাগের চার হবে না স্যার...

বহুক্ষণ সে আর নিজের বঁড়শিগুলোতে চার গাঁথার সুযোগই পায় না। নৌকা সামনে নিয়ে- পেছনে ঠেলে- সোজা-ব্যাঁকা বানিয়ে চাহিদামতো পোজ দিতে থাকে আমাদের ছবির...

- মাছ নাই তোমাদের সাথে?
সুন্দরবনের মাঝির বৈঠাধরা হাতও কি কেঁপে উঠে এবার?

লোকটা চমকে উঠে একটা হাসি দেয় শুধু
- কই দেখি। কী মাছ দেখাও তো?

লোকটা মুখের বঁড়শিগাঁথা হা-টাকে আরো বড়ো করে এবার- এই নৌকায় নাই স্যার। পেছনের নৌকায়
- ওরা কই?
- এখানেই আসবে স্যার...

ওর কাছ থেকে পাওয়ার মতো সবগুলো ফ্রেম শেষ হয়ে যাওয়ায় ফটোগ্রাফাররা ওকে ছাড়ে আর আর বাপ্পী ভাইর চোখ পড়ে আইলাভাঙা ফরেস্ট ছাউনির দিকে- এই ওহাব। যা তো দেখি ওখান থেকে কিছু জ্বালানি কাঠ নিয়ে আয়

ওহাব কুড়াল নিয়ে ছাউনির আড়াল থেকে একটা ঘুণে ধরা শুকনো খুঁটি ভেঙে নিয়ে আসে
- বাড়া একটা ভূতে চুদা তুই। কী নিয়া আসছিস এইটা?

- মাছ কোন নৌকায়?

কেউ উত্তর দেয় না। তিনমাথা নতুন নৌকায় ইশারা দেয়। একটা ছেলে নামে। দীর্ঘ সুঠাম আর টানটান। কালো টিশার্টের নিচে প্রায় স্কিনটাইট একটা শর্টস। ছেলেটা কাছে এলে তিনমাথা কানে কানে কিছু বলে। একটা গামলা নিয়ে ছেলেটা এগিয়ে যায় বিড়ালের পাশে ভেড়ানো অন্য নৌকার দিকে...

শুনেছি বাঘের গতিকে ক্ষিপ্রগতি বলে। গামলা হাতে ছেলেটা যখন ঝপাস ঝপাস পানি ভেঙে এগোচ্ছিল তখন একবারও মনে হয়নি তার পায়ের নিচে পা কামড়ানো কাদাও আছে হাঁটু সমান। একটু সামনে ঝুঁকে ছেলেটার এগিয়ে যাওয়া আমাকে মনে করিয়ে দেয় ছোটবেলায় পড়া গালিভারের গল্প। আমি পরিষ্কার দেখি বিপক্ষ দেশের যুদ্ধ জাহাজগুলোকে সুতায় বেঁধে হাঁটুপানি সমান সমুদ্রের মাঝখান দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গালিভার। সুন্দরবনের সব নদীই এই টানটান ছেলের হাঁটুপানি সমান...

কিন্তু বিড়াল নৌকার পাশে গিয়ে হঠাৎ ছেলেটা তিনমাথা হয়ে যায়। শরীরটাকে মুচড়ে কুঁকড়ে গামলা হাতে ঢুকে পড়ে ছইয়ের ভেতর

কিছুক্ষণ পর গামলাসহ একটা হাত বের হয় নৌকার বাইরে। হাত দেড়েক লম্বা চারটা আইড় জাতীয় লোনাপানির মাছ। দুই থেকে আড়াই কেজি ওজন একেকটা অনুমান। বরফের বাষ্প উড়ছে মাছগুলো থেকে। খোলের ভেতরে বরফ দিয়ে রাখ ছিল মাছগুলো

- এইটা কী দিলা। অতগুলান মানুষ আমরা...
ছেলেটা বের হতে হতে আবার ঢুকে যায়। আরেকটু বড়ো সাইজের আরেকটা মাছ রাখে গামলায়। সেখানে বসেছিল আরেকজন। একটু মোটাসোটা কিন্তু চেহারা সেই তিন মাথাওয়ালার। কিছুই দেখছিল না সে অতক্ষণ। এবার কোঁকিয়ে উঠে- স্যার মাছ পাই নাই তেমন। মাহাজনের ট্রলার আসলি দিতি পারব না কিছুই...

ঠিক তখনই কেউ আবিষ্কার করে বিনিমাগনায় মাছগুলো উঠছে আমাদের ট্রলারে...

- এই মাছগুলোর দাম কত?

বোকার মতো তাকায় মোটা তিনমাথা। গামলাটা সেখানেই রেখে সেই ছেলেটা ঝপঝপ পানি ভেঙে আবার চলে গেছে নিজের নৌকায়। কিন্তু মাছের দাম বলে না কেউ
- এই মাছ আমরা খাবো না। বলেন মাছের দাম কত?
- আপনারা এইসবে নাক গলান কেন? পয়সা দিতে হলে আমি দেবো। আপনারা আপনাদের ছবি তোলেন

নেংটি পরা শরীরের উপর আধা সেকেন্ডের জন্য ঝিলিক দিয়ে চোখদুটো আবার মরা ইলিশের চোখ হয়ে যায়। হাতদুটোকে জোড়হাতে মাপ চাওয়ার মতো প্রশ্নকারীর দিকে তুলে মুখ খোলে- না না দাদ-দাদ-দাম ককককিসের? এই মাছ আপনাগের পাপ-পাপ-পাওনা। ফফফরেস্টারের পাপ-পাওনা এই মাছ

হয়ত বা লোকটা এমনিতেই তোতলা। অথবা তোতলাচ্ছে সে। তোতলাতে তোতলাতেই যোগ করল- এই মাছের দাম নেয়া তাদের জন্য পাপ। তারা গিয়ে মহাজনকে বলবে আমাদের মাছ দেয়ার কথা। কারণ ফরেস্টের লোক হিসেবে এই মাছ আমাদের পাওনা...

মাছের দাম নেয়া পাপ। সততার এই শব্দগুলো শুনতে পায় সবাই। কারো ফ্রেমেই ধরা পড়ে না দাম জিজ্ঞেস করার সময় জেলেটার দিকে বাঘের চোখ রাঙানি করা দুইজোড়া চোখের ছবি। ফরেস্টারের কাছে টাকা চাইলে সুন্দরবনে জেলের জীবন কতটা পানির নিচে ডুবতে পারে জেলেটার সেই ভয় পড়তেও পারে না কেউ। জানতেও পারে না ওজন করে ট্রলারে তুলে দেবার আগে পর্যন্ত কোনো মাছের হিসাবই উঠে না মহাজনের খাতায়। এই মাছ দাদনে বান্ধা খাওয়া জেলের বাঘ- কুমির- কামটের ঘর থেকে তুলে আনা মাছ। এই মাছ দিয়ে দাদনের দায় শোধ হয় তার...

....

আগেরদিন লুকিয়ে রাখা আধা বোতল ভদকায় পানি ঢেলে এক পেগ করে খেয়ে আমরা অপেক্ষা করতে থাকি রান্নার। খাবার তৈরি হলে ভাতের সাথে আসে সব্জি। সবজির সাথে আঙুল সাইজের চিংড়ি। ছোটমাছ। আমরা খাই। বড়ো বড়ো টুকরো মাছ আসে। আমরা খাই। খেতে খেতে লোনা পানির মাছের টেস্ট শরীরের চর্বি আর মাছেদের নাম নিয়ে আলাপ করি আমরা

সন্ধ্যার পরে ক্যামেরাগুলো অকেজো তাই ফটোগ্রাফাররা বেকার। তখন তালে মাতালে বিভিন্ন গল্প। তারপর সবার ঘুম। শুধু নিজের জায়গায় শুয়ে বিড়ি টানছি আমি। আর জেগে আছেন আপনি। কথা বলার নেশায় পেয়েছে আপনাকে। আপনার ভার্সিটি লাইফ... রউফুন বসুনিয়া...

বসুনিয়া গুলি খাওয়ার সময় তার ঠিক পাশেই ছিলেন আপনি। মরার আগের শেষ কথাটা আপনিই শুনেছেন শুধু। আমরা তাকে চিনতাম সে স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিথ হয়ে যাবার পরে। তার নামে বক্তৃতা ছড়া কবিতা কলাম শ্লোগান ব্যানার দেয়ালের চিকা করে নিজেদের শহীদ হবার বাসনা প্রমাণ করতাম আমরা। মোহন রায়হানের মধুর ক্যান্টিনে যাই কবিতা আমাদের মুখে মুখে সবার। নিজেও লিখে ফেলি একটা; শেষ বাক্যে বসুনিয়া- বন্দুকের একটা গুলি পাল্টাতে যতটা সময় লাগে/ততটা সময়ে এই বাংলা দিতে পারে জন্ম লক্ষ বসুনিয়া/ আমি যাচ্ছি হে স্বৈরাচার কিন্তু তুমি ঠিক করে রাখো/ এর পরে কয় লক্ষ বসুর বুকে তাক করবে তোমার একটা বন্দুক....

আমি ঝিম মেরে শুনছিলাম আপনার কথা। বসুনিয়াকে না চিনেই তার মুখে বসিয়ে দেয়া আমার কথাগুলোর সাথে মিলাচ্ছিলাম সত্যি সত্যি বসুনিয়ার শেষ বাক্য- শুয়োরের বাচ্চা গুলি করছে...

হা হা মুস্তাফিজ ভাই। যতই পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন বসুনিয়ার শেষ কথা হিসেবে এই কথাটাকে পাবলিককে খাওয়াতে পারবেন না আপনি। বসুনিয়া বীর। বীরের মুখ থেকে আমরা বীরত্ব কিংবা ত্যাগের কথা শুনতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি বাচ্চাপোলা ক্ষুদিরাম ফাঁসির দড়িতে দাঁড়িয়ে গেয়েছিল তত্ত্বকথার গান- একবার বিদায় দে মা...

পাবলিকের খাদ্য তালিকাটাই এরকম। জীবনী থেকে কিংবদন্তিতে রুচি বেশি আমাদের। সুন্দরবনের জেলেদের সততাই খাবে পাবলিকে বেশি। কিন্তু বসুনিয়ার শেষ সময়ে পাশে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়েও আপনি কি অনুমান করতে পারেন যখন বাধ্য হয়ে তাঁরা দাঁড়িয়ে ছিল কিংবা মাছগুলো তুলে দিচ্ছিল তখন মনে মনে ঠিক কী বলতে পারে এইসব মাঝিরা?

পরেরদিন সকালে শুরু হলো গণ-ডায়রিয়া আমাদের। দুবার টয়লেট-প্যারেড করে একটা ঘুম দিয়ে দুপুরে খেতে বসলাম ভাত। এখনও সেই গতকালের মাছ। এক কোষ ভাত মুখে তুলেই প্লেট রেখে দিয়ে উঠে গেলাম নৌকার কোনায়। আপনি তাকালেন- কী হলো?
- কিছু না। আসছি

দৌড়ে নৌকার কোনায় গিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেই- ওয়াক...

ভেতর থেকে বের হয়ে এলো নাড়িভুঁড়ি ছেঁড়া বমি- ওয়াক...

গতকালের যা কিছু সকালেই তা অবিরল ধারায় কমোড বেয়ে সুন্দরবনের নদীতে গেছে। বাকি যে গন্ধটুকু ছিল তাও বের হয়ে এলো। কিন্তু আমি বুঝলাম না কিছুই। কুলি করে আবার এসে খেতে বসলাম। পাশের টুলে রেখে গিয়েছিলাম ভাতের প্লেট। প্লেটটা তুলতে গিয়ে দেখি প্লেটটা ওখানে নেই। পড়ে গেছে। বোকার মতো আমি জিজ্ঞেস করলাম- প্লেটটা কি আমিই ফেলেছি?

আমি ছাড়া আর ফেলবে কে। এটাই ছিল সবার চোখের উত্তর। কিন্তু আমি জানি টুলের ওপরে রাখা প্লেটটায় আমার স্পর্শও লাগেনি একবার...। প্লেটটা আমি ফেলিনি। সুন্দরবনের প্রকৃতি ফেলেছে এই প্লেট। এই ডায়রিয়া- এই বমি- এই ভাতের পাত ফেলে দিয়ে সুন্দরবনের প্রকৃতি আমাকে বারবার জানিয়ে দিচ্ছিল- মাছ নয়; মাছ নয়; মাঝিদের মাংস এইসব খাবার...

হাঃ হাঃ হাঃ মুস্তাফিজ ভাই

আপনারা কেউ সাক্ষী না থাকলে আমি কিন্তু ডায়রিয়া-বমি-ভাত তিনটাকে একই ব্লেন্ডারে ফেলে একখান সততা-শিক্ষার মডেল বানিয়ে ফেলতে পারতাম নিজেকে। কিন্তু এক টয়লেটে সবার ঠেলাঠেলিতে সকালেই আবিষ্কার হয়ে গেছে গতরাতের প্রচুর মসলামাখা তরকারিই ছিল ঝামেলার কারণ

পড়ে যাওয়া ভাত গলুইয়ের নিচে আটকানো মুরগিগুলোকে দিয়ে ওহাব আবার ভাত এনে দেয় আমাকে। ...সেই মাছ। খেলাম আবার...

তখন নৌকা এসে দাঁড়াল ভুলে যাওয়া নামের আরেকটা ফরেস্ট ফাঁড়ির সামনে। প্রায় আট দশ ফুট বেজের উপরে ইটের বাংলো টাইপ দালান। ওখানে মোবাইলের অ্যান্টেনা আছে। ফোন করার জন্য হুড়মুড় করে নেমে গেলো সবাই। কেউ ফোন করল আর কেউ বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে গেলো যাদের ফোনের তাড়া নেই। আমিও বসলাম বারান্দায়। এবং এক দৌড়ে নেমে গেলাম নিচে। ঘাসের কাছে- ওয়াক...

দ্বিতীয়বারে খাওয়া পুরো ভাত ঢেলে দিলাম ঘাসে। ভরা পেটে বমি করা বেশ আরাম। প্রতিটা ধাক্কায় শ্যালো পাম্পের মতো মুখ ভরে বের হয়ে আসে বমি। কিন্তু খালি পেটের বমিতে জান বের হয়ে আসে। একেকটা ধাক্কায় নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে আসতে চায় কিন্তু এক দু চামচ শ্লেষ্মা ছাড়া পড়ে না কিছুই...

...তখনও আমি বুঝে উঠতে পারিনি সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভাষা। প্রকৃতি তার নিজের ভাষায় আমাকে দুবার নিষেধ করলেও আমি অনুবাদ করতে পারেনি বনের শব্দমালা। আমি আবারও ভরপেট সেই মাছ খেয়ে বাংলোর ব্যালকনিতে বসে বিড়ি ধরিয়েছি। যতদূর চোখ যায় সামনে নিজের নিয়মে সাজানো সুন্দরবন। জোয়ারের পানি তখন সন্ধ্যার আগে পা ধুইয়ে দিচ্ছে বৃক্ষরাজির...

তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। পাশে বসা কাউকে দেখতে পাই না আমি। আমার চোখ আটকে আছে নদীর অন্যপাড়ে দূরের একটা বিশাল কেওড়া গাছে। প্রথমে কেওড়া গাছটা তার নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে একটু নড়ে উঠে। তারপর এক ঝটকায় মাটি থেকে নিজের শেকড়গুলো খুলে নিয়ে নদীর উপর দিয়ে হাঁসের মতো ভাসতে ভাসতে আসতে থাকে আমার দিকে। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। একটুও নড়তে পারছি না আমি। হাতের বিড়িতেও পারছি না টান দিতে। একজন ঋষি মানুষের মতো ঝাঁকড়া কেওড়াগাছটা নদী পার হয়ে এসে বাংলোর ব্যালকনির নিচে সিঁড়ির কাছে দাঁড়ায়। আমি তাকিয়ে আছি। সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে গাছটা একটা দীর্ঘ ডাল বাড়িয়ে ব্যালকনিতে বসা আমাকে পেঁচিয়ে ধরে গলায়। আমি কিছুই করতে পারছিলাম না তখন। গাছটা আমাকে টানতে টানতে নিচে নামিয়ে নিয়ে যায় তার গোড়ায়। তারপর আমাকে ধরে রেখেই হরিণে সবগুলো পাতা খাওয়া কাঠির মতো আরেকটা ডাল সোজা এনে নলের মতো ঢুকিয়ে দেয় আমার মুখের ভেতর। মুখ থেকে গলা বেয়ে পাকস্থলীতে গিয়ে থামে ডালটা। তারপর পেটের ভেতরে ডালের মাথাটা একটু বাঁকিয়ে হঠাৎ এক হ্যাঁচকা টানে প্যান্টের পকেট ঝাড়ার মতো করে আমার পুরো পাকস্থলীটাকে বের করে নিয়ে আসে মুখের বাইরে। হুড়মুড় করে গাছের গোড়ায় ছিটকে পড়ে পেটের ভেতর যা কিছু ছিল সব। ...চাবানো মাছ। পানি। গলে যাওয়া ভাত...

তারপর অনেকগুলো ছোট ছোট পাতাওয়ালা ডাল এগিয়ে এসে পুরো পাকস্থলীটা মুছে দিতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না সেখানে একটা টুকরো মাছের গন্ধও থাকে। তারপর আবার এক ধাক্কায় পাকস্থলীটা ভেতর ঢুকিয়ে আমাকে ছেড়ে দিয়ে গাছটা নদী পার হয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে এক ঝটকায় আবার সাধারণ গাছ হয়ে যায়। আর ঘোর ভেঙে আমি নিজেকে আবিষ্কার করি বাংলোর সিঁড়ির নিচে বমিতে মাখামাখি। ... আর ঠিক তখনই আবিষ্কার করি- সুন্দরবনের এই প্রকৃতি চায় না মাঝিদের মাংস মাখা মাছের কোনো গন্ধ আমার ভেতরে যাক... মাছ নয়। মাছ নয়; মাঝিদের রক্তের দলা এই সব;

বলেন তো দ্বিতীয় বমিটাকে এভাবে বর্ণনা করলে জিনিসটা কোথায় দাঁড়াতো? পুরো একটা আদর্শবাদী সাহিত্য হয়ে যেত কাহিনীটা। কিন্তু আফসোস। আপনারা সবাই ওখানে বসা ছিলেন দিনের আলোয়। আপনারা সবাই দেখলেন আমি বাপ্পী ভাইর কাছ থেকে গ্যাসের টেবলেট আর খাবার স্যালাইন নিলাম

এই বমিটার সাথে কিন্তু প্রথম বমির পরে একজনের একটা কমেন্ট যোগ দিয়ে রীতিমতো শ্রেণিসংগ্রাম আর শ্রেণিশোষণ বিষয়ক ওয়াজ মাহফিলের লেকচার বানিয়ে ফেলা যায়;

সুপ্রিয় কমরেডগণ আপনারা জানেন। নিপীড়িত নির্যাতিত আমার কমরেড জেলে ভাইদের রক্ত জল করা মাছ যখন সামন্তবাদী চক্রান্তে আমার পেটে গিয়ে শ্রেণিসংগ্রামের প্রতিশ্রুতির কারণে উগলে বেরিয়ে আসছিল বমি হয়ে। তখন একজন আমাকে বলে- কুত্তার পেটে ঘি ভাত হজম হয় না

মানে কী বুঝছেন কমরেডগণ? না বোঝেন নাই। আপনারা ভাবছেন সেই লোক মাছ খাওয়ার খোঁটা দিয়েছে আমাকে? না ভুল। জেলেদের কাছ থেকে মাছ কেড়ে নিয়ে খাওয়াকে ওরা জায়েজ করে ফেলেছে বহু শতাব্দী ধরে। ওইটা এখন আর মাথায়ও নাই তাদের। সে ইঙ্গিত করেছে গতকালের খাওয়া বিদেশি মদের

কমরেডগণ। আপনারা জানেন এইসব সাম্রাজ্যবাদীরা মানুষকে লোভ দেখিয়ে; সুবিধা দিয়ে নিজের দলে ভিড়াতে চায়। আমাদের ঐক্যে ফাটল ধরাতে চায়। কারণ মানুষ যত বিভক্ত হবে ততই তাদের লাভ। ততই মুনাফা তাদের। ঐতিহাসিক সেই পুঁজিবাদী চক্রান্তের নীল নকশায় তারা আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে মদের আসরে নিয়ে যায়। গ্লাসের মধ্যে ঢেলে দেয় আমাদের আদিবাসী কমরেডদের ঘরে তৈরি করা চুয়ানির মতো স্বচ্ছ সাদা পানি। আমি সরল মনে তা মুখে দেই। গন্ধটা চুয়ানি থেকে একটু কম ছিল বলে আমি ধরে নেই সুন্দরবনের খোলা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে গেছে চুয়ানির সুবাস

কিন্তু কমরেডগণ। পরিকল্পিতভাবে তারা আমাকে মদের বোতল দেখায় না। যখন আমি পুরাপুরি টাল তখন তারা আমাকে বোতল দেখায়। বোতল দেখেই চমকে উঠে নেশা কেটে যায় আমার। মুহূর্তের মধ্যে আমি ধরে ফেলি মুনাফাখোর সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের নীল নকশার ছক। আমি চিনে ফেলি এরা কারা। কেন তারা গেলাস বাড়িয়ে দিচ্ছে আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গেই আমি ধরে বসি এমএম মানে মদ-ম্যানেজারকে। কাউকে বাদ দেই না আমি। তিন তিনটা সেমিঅটোমেটিক রাইফেলের সুরক্ষিত পাহারা তুচ্ছ করে একে একে সবার মুখোশ উন্মোচিত করি আমি। রাইফেলকে কেন ভয় পাব আমি? কাকে ভয় পাব আমি? আমার একার জীবনের কী দাম যদি না একটা শ্রমিকের এক এক ফোঁটা রক্তকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাতে পারি?

যখন তারা দেখল তাদের মুখোশ খুলে গেছে। তখন লেজ গুটিয়ে মদের সবগুলো বোতল লুকিয়ে ফেলল নৌকার গলুইয়ের ভেতর। আর পরের দিন যখন তাদেরই চক্রান্তে জলমজুরের প্রাণের মাছ খেয়ে বমি করছি আমি; তখন আমাকে দুর্বল আর একা পেয়ে তারা প্রমাণ করতে চাইল যে বাংলামদ খাওয়া আমার পেটে বিদেশি মদ হজম হয়নি তাই বমি করছি আমি...

কমরেডগণ। এরা সেই শ্রেণীর মানুষ। যারা শ্রমিকের রক্ত খেয়ে রক্তশূন্যতার দায় শ্রমিকের ঘাড়ে চাপায়। তারা জেলের কাছ থেকে মাছ ছিনতাই আড়াল করতে বমির দায় আমার হজমশক্তির উপর চাপায়। কিন্তু আপনারাই বলেন মদ খেয়ে কি সতেরো-আঠারো ঘণ্টা পরে বমি করে কেউ? আমি বমি করেছি কারণ আমি চিনতে না পারলেও আমার প্রতিটা রক্ত কণিকা ঠিকই চিনতে পেরেছ এই মাছ আমার কমরেডের রক্তের ফোঁটায় তৈরি মাছ। তাই আমার শরীর উগরে দিয়েছে এই মাছ...

কিন্তু আমি সেই যুক্তির ধারে কাছেও যাই না কমরেডগণ। আমি বলি- সত্যিই তো। বিদেশি মদ তো আমার পেটে হজম হবার কথাই নয়। কারণ আমার প্রতিটা রক্ত কণিকা জানে এই এক বোতল মদের দাম আমার একটা শ্রমিকের এক মাসের মজুরির সমান। আমার চাষির; আমার শ্রমিকের রক্ত পানি করা টাকা কেড়ে নিয়ে কারা রাতের অন্ধকারে মাতাল হবার জন্য এইসব মদ আমদানি করে আমি জানি। তাই এই মদ হজম হয় না আমার। আমার পেটে এইসব মদ হজম হয় না কারণ আমি জানি এইসব লাল-সাদা পানির জন্য প্রতিবছর যত টাকা বিদেশে পাচার করা হয় রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে... সেই টাকায় অত হাজার শ্রমিকের জন্য বাড়ি হয় প্রতি বছর। মাত্র অত বছর বিদেশ থেকে এইসব মদ আমদানি বন্ধ করলে আমার দেশের প্রতিটা কৃষক নিজের গাড়ি নিজে চালিয়ে ধান ক্ষেতে গিয়ে লাঙ্গল চালাতে পারে... আমি জানি এইসব। তাই এই মদ আমি চিনতে না পারলেও আমার প্রতিটা রক্ত কণিকা জানে এইটা মদ নয়। আমার ভাইয়ের রক্ত আর ঘাম...

আহারে...
আবারও মিস করলাম দুর্দান্ত একটা লেকচারের টপিক। এ জীবনেও আর শ্রেণিসংগ্রাম বিষয়ক একটা লেখা তৈরি করা হলো না আমার...

শ্রেণিসংগ্রাম আসোলেই একটা অসাধারণ স্কুল। যেখানে গিয়ে খুব সহজেই শিখে আসা যায় মানুষের ঠিক কোন জায়গায় শিঙা লাগালে একটানে সবগুলো রক্ত শুষে নেয়া যায়। দেখেন না এ যাবতকালে দেশে যতগুলো সরকার হয়েছে তারা নিজেরা শ্রেণিসংগ্রামি না হলেও প্রতিবারই মন্ত্রীপরিষদ ভর্তি থাকে শ্রেণিসংগ্রামের ইস্কুল পাশ করা লোকে? এরা শ্রেণিসংগ্রামের নামে মানুষের ভেতর গিয়ে জেনে এসেছে ঠিক কোন জায়গায় কামড় দিলে মানুষ মরার আগে আর টুশব্দও করতে পারে না জীবনের মতো। এইজন্যই একা ইলেকশনে দাঁড়ালে পাঁচশো ভোট না পেলেও সব সরকারেই এদের অত বেশি দাম...

এই লেকচারটাও কিন্তু যেকোনো সময়ের যেকোনো বিরোধী দলের সড়কবক্তৃতার খসড়া হিসেবে বিক্রি করে দেয়া যায়। বাংলাদেশে সব সময়ই এই বক্তৃতাটা ফিট করে দেয়া যাবে একটু এদিক সেদিক ঘুরিয়ে। কিন্তু সেই সুযোগটাও নাই আমার। কারণ নিজেকে শ্রেণিদরদি হিসাবে প্রমাণ করতে পারিনি আমি। না পত্রিকায় লিখেছি কিছু। না কোনো পোস্ট দিয়েছি ব্লগে শ্রেণিসংগ্রামের পক্ষে। তাই কেউ খাবে না আমার এই ড্রাফট। আফসোস...

এজন্যই কি আপনি আমাকে সুন্দরবন যেতে বলেছিলেন? এসব কি আপনারও চোখে পড়েছিল? চোখে পড়েছিল কি মাঝিদের কাছ থেকে কেজি দুই টোপ নিলেও আব্দুল ওহাব আর এমদাদ বঁড়শি বাইছিল মুরগির নাড়িভুঁড়ি দিয়ে? চোখে পড়েছিল কি এই চার আর মাছ খাইয়ে বাপ্পী ভাই চারটা মুরগি সেভ করে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল ফেরত? ওসবের কি কোনো ছবি তুলেছিলেন আপনি?

ধুত্তুরি...

২০০৯.০৮.২৫-২৬ মঙ্গল-বুধবার

No comments:

Post a Comment