বাঘের ওপর ফরিদ আহমেদের (ব্যাঘ্র শিকারি সারমেয়) ও কাছিমের ওপর বিপ্লব রহমানের লেখাদুটোতে অনুপ্রাণিত হয়ে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্রের বছর উপলক্ষে এই ফটো-লগটা দিচ্ছি। এই বছরের প্রথম দিকে আমার সুন্দরবন যাবার কিছু ছবি দিলাম, তারপরে বাঘ-সংক্রান্ত কিছু হৃদয় বিদারক তথ্যও দিলাম। যদি সময় না থাকে আমি পাঠকদের অনুরোধ করব, এই লেখা না পড়ে, একদম শেষে আল-জিজিরার লিঙ্কের ভিডিওটা দেখুন। শেষের দুটো গুরুত্বপূর্ণ ছবি (নাইমুল ইসলাম অপুর তোলা) ছাড়া অন্য ছবিগুলো আমার তোলা।

সুন্দরবনের উত্তর প্রান্ত

খুলনা ও মঙ্গলার মধ্যে শুধু হচ্ছে চিংড়ি চাষ। নদী থেকে লবণাক্ত জল পাম্প করে চাষযোগ্য জমিতে জমিয়ে চিংড়ির উপযোগী করা হচ্ছে।

শীতের বকেরা খাবার খুঁজছে শুকিয়ে-যাওয়া চিংড়ির ঘেরে। এই জমিগুলো আর চাষযোগ্য নয়, বরং এই জমি পুরো এলাকার দূষণের উৎস।

মঙ্গলার কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে, শ’য়ে শ’য়ে জেলে খুব সূক্ষ্ম জাল দিয়ে মাছ ধরছে। এই জালের ছিদ্র এতই ছোট যে কোন ধরণের পোনা মাছই বের হতে পারবে না। জেলেরা নিজেরাই জানে এই ধরণের মাছ চাষের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে।

এই কনকনে শীতের ভোরে, এই মহিলা চিংড়ির পোনা (মীন) খুঁজছেন ঘন্টার পর ঘন্টা। সেই মীন বিক্রী হবে উত্তরের চিংড়ির ফার্মে।

জেলেদের গ্রামগুলোর এই অবস্থা, কোন রকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই।

এই দৃশ্যটা খুবই রোমাঞ্চকর মনে হতে পারে, কিন্তু জোয়ার আর ভাটার মধ্যে এটা একটা কর্দমাক্ত অস্তিত্ব। এখানে বনের অবশিষ্টাংশ টিকে আছে।

একটা খাল পেরিয়ে সংরক্ষিত বন শুরু হল। কিন্তু জাহাজ ও বার্জ থেকে নিষ্কাশিত বর্জ্য তেল গোলপাতার ওপর একটা কালিময় রেখা টেনে দিয়েছে।

কিন্তু তার পর একটা কুয়াশায় ঢাকা একটা রহস্যময় বন আমাদের আহ্ববান করে। একটা বাইন গাছ এক কোণায় কোনরকমে দাঁড়িয়ে। জোয়ার দক্ষিণ থেকে পলিভরা জল নিয়ে আসে। ঘোলাটে জলে আমরা একটা শুশুককে লাফাতে দেখি, কিন্তু ক্যামেরায় ধরতে পারি না।

এখানে বন খুবই ঘন, পথ না করে দিলে হাঁটা যাবে না। হারবারিয়ায় আমরা একজন সশস্ত্র রক্ষীকে অনুসরণ করি। সুন্দরী গাছের মূল মাটি থেকে জেগে থাকে। এখানে অনেক সুন্দরী গাছ আগামরা রোগে আক্রান্ত।

অবশেষে বাঘের পদচিহ্ন। নাইমুল ইসলাম অপু বাঘের পায়ের স্কেল বুঝতে চাচ্ছেন।

গোলপাতা ঝোপের মধ্য দিয়ে বাঘের পায়ের ছাপ চলে গেছে। গোলপাতার নাম হয়েছে তার গোল ফলের জন্য। বাওয়ালীরা গোলপাতা দিয়ে ঘরের ছাউনী দেয়।

শেষাবধি আমি এইরকম একটা ছবি মনে রাখার চেষ্টা করি, একটা বন যা কিনা রহস্যময়, কিন্তু খুবই নাজুক। ঐতিহাসিক ভাবে বন থেকে সম্পদ আহরণ করা গেছে চিরাচরিত প্রথায়, কিন্তু তার সীমান্তে জনসংখ্যার চাপে সেই বন আজ ঝুঁকির মুখে।
আমি ফিরে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই একটি বাঘ পার্শ্ববর্তী গ্রামে ঢুকলে তাকে গ্রামবাসীরা ঘেরাও করে। সারাদিন পুলিস ও বিডিআর বাঘটাকে রক্ষা করলেও সন্ধ্যের পর হাজার হাজার গ্রামবাসী জড়ো হলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়। লোকেরা দড়ি-দাও-ঢিল-পাটকেল-লাঠি মেরে বাঘটাকে মেরে ফেলে। বাঘ একটা আটক পড়েছে শুনে নাইমুল ইসলাম অপু ঢাকা থেকে চলে যায়, তার পৌঁছানর কিছুক্ষণ আগেই বাঘটা মারা যায়। অপুর তোলা মৃত বাঘের ছবি দিলাম।

মৃত বাঘের ছাল নাকি ছাড়ান হয় কর্তৃপক্ষের তত্বাবধানে। এক বছরে প্রায় ৭টা বাঘ মারা গেল মানুষের হাতে। ধরা হয়ে থাকে এখন ৪০০টির মত বাঘ বাংলাদেশের সুন্দরবনে আছে। কিন্তু এই সংখ্যাটা নিচে ২৫০-২৭৫ থেকে ওপরে ৪৫০ পর্যন্ত হতে পারে।

কিন্তু আপনারা যদি সত্যিই দেখতে চান বাঘকে মানুষ কি ভাবে মারে, তাহলে নিচের লিঙ্কটি দেখতে পারেন (সুন্দরবন টাইগার প্রজেক্টের এডাম বারলোর পাঠান)। শেষ পর্যন্ত দেখবেন, যা দেখবেন তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। সবাই এটা নাও সহ্য করতে পারেন।

No comments:
Post a Comment