নিঝুম দ্বীপের হাতছানি
বঙ্গোপসাগর ও মেঘনার মোহনায় গড়ে ওঠা নিঝুম দ্বীপ প্রাণী ও উদ্ভিদ সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার। প্রাকৃতিক পরিবেশে পশু-পাখির জন্য দেশের একমাত্র অভয়ারণ্য এ দ্বীপটি। ৩ হাজার ৯৫২ একর জমির এই দ্বীপদেশে ৩০ হাজার মানুষের সঙ্গে বসবাস করে ৪০ হাজার হরিণ, ৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির পাখি ও ১৬ প্রজাতির সরিসৃপ। ঝিনুক সংগ্রাহকদের এ দ্বীপটি একটি জীবন্ত মিউজিয়াম। এখানে কৃষি, মত্স্যচাষ ও ভেড়া পালনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া দ্বীপের বিশাল জলসীমায় রয়েছে বিপুল পরিমাণ মাছের ভাণ্ডার। এখানে মূল্যবান সোনালি খনিজ বালু রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন গবেষকরা। নিঝুম দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অপার সম্ভাবনা ও আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন জাহিদুল করিম কচি ও সোহাগ কুমার বিশ্বাস
মায়াময় স্বপ্নিল প্রকৃতির নিসর্গ নিঝুম দ্বীপ। বাংলাদেশের স্থলসীমার শেষপ্রান্তে বঙ্গোপসাগর আর মেঘনার মোহনায় গড়ে ওঠা খনিজ, প্রাণিজ আর উদ্ভিদ সম্পদে পরিপূর্ণ এই দ্বীপটি যেন আরেক খণ্ড বাংলাদেশ। দ্বীপে বসবাসকারী মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে রয়েছে নিবিড় বন্ধুত্ব। পশু-পাখির জন্য এটিই দেশের একমাত্র অভয়ারণ্য। মাত্র ৩ হাজার ৯৫২ একর জমির এই দ্বীপদেশে ৩০ হাজার মানুষের সঙ্গে ৪০ হাজার হরিণের বাস। এছাড়া সরকারি হিসাবে এই দ্বীপে সাত প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির পাখি আর ১৬ প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে। ২১ প্রজাতির বৃক্ষরাজির সঙ্গে ৪৩ প্রজাতির লতাগুল্ম দিয়ে সাজানো প্রকৃতির এক অপার লীলাভূমি। ঝিনুক সংগ্রাহকদের কাছে নিঝুম দ্বীপের বিস্তীর্ণ সমুদ্রতট এক জীবন্ত মিউজিয়াম। চারপাশে বঙ্গোপসাগরের লোনা পানির মধ্যে দ্বীপের ভেতরকার জলাশয় ও খালগুলো আবার মিঠাপানির সংরক্ষণাগার, যেন স্রষ্টার রহস্যময় সৃষ্টি। বিভিন্ন কলকারখানা আর যান্ত্রিক যানের কালো ধোঁয়া, বিকট শব্দ, অসহ্য যানজট কিছুই নেই এখানে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি কোনো ধরনের সন্ত্রাসের সঙ্গে পরিচিত নয় এখানকার মানুষ। সাগরের গর্জন আর পাখির কিচিরমিচির, ডাকাডাকিই নিঝুম দ্বীপের নির্জনতা ভাঙায়।
নোয়াখালী জেলার সর্বদক্ষিণের বিচ্ছিন্ন উপজেলা হাতিয়া। প্রমত্তা মেঘনা আর বঙ্গোপসাগরের ভাঙাগড়া খেলায় বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপটি দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে পৃথক। হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নের ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় নিঝুম দ্বীপের অবস্থান। মানচিত্রে দেখলে চোখের মতো দ্বীপ হাতিয়া আর চোখ থেকে ঝরেপড়া একফোঁটা অশ্রুই যেন নিঝুম দ্বীপ। সম্প্রতি মেঘনার ভাঙনে সর্বস্ব হারানো হাতিয়ার কিছু মানুষ বসতি গড়ে তুলেছে নিঝুম দ্বীপে।
২০০১ সালের জরিপ থেকে জানা যায়, নিঝুম দ্বীপের ভূমির পরিমাণ ৩ হাজার ৯৫২ একর। তবে গত ৯ বছরে পলি জমে দ্বীপের জমির পরিমাণ আরও বেড়েছে।
নিঝুম দ্বীপের উত্পত্তির ইতিহাস বেশ চমত্কার। আজ থেকে একশ’ বছরেরও বেশি সময় আগে গভীর রাতে মাছ ধরতে গিয়ে জেলেরা এই দ্বীপ জাগতে দেখেন। গভীর রাতে বঙ্গোপসাগর আর মেঘনার মোহনায় হঠাত্ সাগরের উথাল-পাতাল ঢেউ দেখে প্রথমে জেলেরা ভাবেন—হয়তো সাগর মোহনা দিয়ে অতিকায় তিমির বিশাল ঝাঁক পথ হারিয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। পানির তাণ্ডব দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় সাহসী জেলেরা রাতেই সেদিকে এগিয়ে যায় এবং বিশাল এক ডুবোচরের সন্ধান পান। সেই ডুবোচরেই ধীরে ধীরে পলি জমে সৃষ্টি হয় আজকের নিঝুম দ্বীপ। কিছুদিন পর মত্স্যশিকারি পাখির আনাগোনা দেখে স্থানীয় জেলেরাও মাছ ধরতে এই এলাকায় যাওয়া-আসা শুরু করেন। জেলেরা এই বিশাল চরের নাম দেন বালুয়ার চর। নিঝুম দ্বীপের বালুর রঙ স্বর্ণের রঙের মতো হওয়ায় কিছুদিন পর এর নামকরণ করা হয় স্বর্ণদ্বীপ। ১৯৬৯ সালে একদল জরিপকারী এই চরে জরিপ করতে আসেন। তখন ওসমান নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা জরিপকারীদের সহযোগিতা করেন। জরিপকারী দলটি এই চরের নামকরণ করেন চর ওসমান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের পানিতে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরাজির বীজ ভেসে আসায় দ্বীপটিতে গড়ে ওঠে এক বিশাল প্রাকৃতিক বনাঞ্চল। দ্বীপজুড়ে নেমে আসে গভীর নির্জনতা। পরে লোকের মুখে মুখে ফেরে একটিই নাম, তা হলো—নির্জন দ্বীপ। ১৯৭৯ সালে প্রয়াত সংসদ সদস্য তত্কালীন প্রতিমন্ত্রী আমিরুল ইসলাম পরিদর্শনে এসে নির্জন দ্বীপের শান্ত ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে দ্বীপটির নামকরণ করেন নিঝুম দ্বীপ।
দ্বীপের প্রাকৃতিক সম্পদের তালিকা প্রণয়নের কাজ আজও শেষ হয়নি। ১৯৯৬ সালের এক জরিপে সাত প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির পাখি আর ১৬ প্রজাতির সরীসৃপের সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়া সুন্দরী, কেউড়া, গেওয়া, গোলপাতাসহ অন্তত ২১ প্রজাতির গাছ ও ৪৩ প্রজাতির লতাগুল্ম দিয়ে প্রকৃতি সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে সাজিয়ে তুলেছে নিঝুম দ্বীপকে। তবে এখন প্রাণী ও উদ্ভিদের পরিমাণ বহুগুণে বেড়ে গেছে। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে সবুজে ঘেরা এই দ্বীপটিকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় বৃহদাকারের কোনো সবুজ তিমি পিঠ উঁচিয়ে রোদের তাপ নিচ্ছে। দ্বীপের দক্ষিণপাশে রয়েছে সাগরের বিস্তীর্ণ বেলাভূমি। গহিন অরণ্যে গাঢ় সবুজের ক্যানভাস। কোথাওবা ফুটে আছে নীলাভ হিজল-জারুলসহ নানা অজানা-অচেনা বাহারি বনফুল। সমুদ্রতটেই দেখা মেলে সাগরের পানিতে ভেসে আসা নানা প্রজাতির বীজের অদ্ভুত রহস্যময় বংশবিস্তার প্রক্রিয়া। তবে ইদানীং বন বিভাগ নিঝুম দ্বীপের বনাঞ্চল সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।
দ্বীপের চারপাশ ঘিরে আছে সমুদ্র। দ্বীপের মধ্যে রয়েছে অন্তত ৮টি খাল ও বেশকিছু মিঠাপানির জলাশয়। মেঘনার পানি খালগুলো ভরে রাখে। কোনো কোনো সময় নদীর পানি টান দিলে সাগরের নোনা পানি এসে সেই ঘাটতি পূরণ করে। সমুদ্রের ডাক শুনতে আমরা ছুটে যাই কক্সবাজার কিংবা কুয়াকাটায়। সমুদ্র সৈকত বলতে আমরা কক্সবাজার ও কুয়াকাটাকেই বুঝি। অথচ নিঝুম দ্বীপের বিস্তীর্ণ সমুদ্রতট আর মায়াবী হাতছানি এখনও পর্যটকদের চোখের আড়ালে। অদ্ভুত এক নির্জনতা ঘিরে আছে নিঝুম দ্বীপের ভেতরে-বাইরে। সাগরের বুকের ওপর বসে গর্জন শুনতে হলে নিঝুম দ্বীপই আদর্শ স্থান। দু-এক রাত এই দ্বীপে কাটালে সেই আনন্দ আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। গভীর রাতে সমুদ্রের ডাক কান্না হয়ে আসে। যারা এ দ্বীপে কখনও রাত কাটাননি, তাদের কাছে এই অভিজ্ঞতা ভিন্ন।
সম্প্রতি নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন আরও কয়েকটি চর জেগেছে। চরজব্বার, চররশিদ, চরআজমল, চরআমানত—যেদিকেই তাকান না কেন, দিগন্তবিস্তৃত মাঠ—যেন সবুজ ঘাসের শ্যামল এক পৃথিবী চোখে পড়বে। নভেম্বরে প্যারাগনের ফাঁকে ফাঁকে বুনোফুলের সমাহার সহজেই যে কাউকে কাছে টানে। খালের দুই পাড়ে নদীর কূলে আর সমুদ্রতটে রয়েছে বিশাল বনভূমি, বনে রয়েছে হাজার হাজার চিত্রল হরিণ। এই দ্বীপে ঘুরতে আসা পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে হরিণের দেখা পাওয়া। শত শত হরিণ একসঙ্গে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য একমাত্র নিঝুম দ্বীপেই দেখা যায়। গহিন অরণ্য থেকে প্রায় প্রতিদিনই দু-একবার হরিণের দল আসে লোকালয়ে। তারা বিভিন্ন ফসলি জমি ও সবুজ ঘাসের মাঠে চরে বেড়ায়। তবে কার্তিক মাসে হরিণের দেখা পাওয়া দুষ্কর। এ সময় ফসলের মৌসুম হওয়ায় কৃষকরা দল বেঁধে মাঠে কাজ করেন। আর খালবিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় শিশু-কিশোররা এখানে মাছ শিকার ও খেলাধুলা করে। তারা হরিণ দেখলেই ধাওয়া করে। ফলে এ মৌসুমে হরিণ একেবারেই নিরাপদ পরিবেশ না পেলে দিনের বেলায় বন থেকে বের হয় না। তবে রাতে বের হয়। বড় টর্চলাইট নিয়ে রাতে একটু ঘোরাফেরা করলেই দল বেঁধে হরিণ দেখার সাধ মিটবে। হরিণের ঝাঁক নিঝুম দ্বীপের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
নির্জন এই দ্বীপে হরিণ কীভাবে এলো : এই ইতিহাস আরও আকর্ষণীয়। টমাসথন নামে এক ব্রিটিশ পর্যটক একজোড়া পোষা হরিণ সঙ্গে নিয়ে এই দ্বীপে ভ্রমণে আসেন। একপর্যায়ে তার হরিণদুটি ছুটতে ছুটতে গভীর অরণ্যে চলে যায়। আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই থেকে ক্রমান্বয়ে বংশবিস্তার। পরে অবশ্য বন বিভাগ আরও কিছু হরিণ অবমুক্ত করে দ্বীপটিকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করে। এছাড়া লাখ লাখ অতিথি পাখির জন্য দ্বীপটি এক বিরাট আকর্ষণ। শীতের সময় খাদ্যের অন্বেষণে এসব পাখি উড়ে আসে এই দ্বীপে। ঝাঁক বেঁধে এরা চলাফেরা করে, কাদাপানিতে বাসা বাঁধে। গ্রীষ্মকালে যখন যাযাবর পাখিরা বিদায় নেয়, তখন আকাশে নীল ঠোঁটওয়ালা কয়েক হাজার লাজুক ও দুর্লভ প্রজাতির সাদা মাথা হাঁস কোত্থেকে যেন উদয় হয়। এরা এখানকার ঝোপঝাড়ে ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটায়। পাখিদের মোহনীয় কূজন শুনে মনে হয় এ এক রূপকথার পক্ষীরাজ্য। হাজার হাজার হরিণের সঙ্গে বনমোরগের ঝাঁক নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায় গোটা দ্বীপে। দ্বীপের বাসিন্দারাও এসব প্রাণীরক্ষায় বদ্ধপরিকর। এ দ্বীপে শিকারির প্রবেশাধিকার একেবারেই নিষিদ্ধ। এছাড়া বাঘ ও কুকুরের মতো কোনো হিংস্র প্রাণীও নেই। গোধূলিলগ্নে পাখির কুহুতান প্রাণী আর সমুদ্রের লোনা বাতাসের গন্ধ মিলে তৈরি হয় এক মোহনীয় ইন্দ্রজাল।
দ্বীপের ৩০ হাজার বাসিন্দার বেশিরভাগই ভয়ঙ্কর মেঘনা ও গভীর সমুদ্রে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু গভীর সাগরে মাছ ধরার আধুনিক উপকরণ তাদের নেই। ইঞ্জিনবিহীন সাম্পানে করে তারা চলে যায় গভীর সমুদ্রে। আস্ত গাছ চেরাই করে দু-তিন ইঞ্চি পুরু তক্তা দিয়ে তৈরি করা হয় সাম্পান। সাম্পানে জাল, রশি, ফ্লোট, টোম, রেডিও ও প্রয়োজনীয় খাবার নিয়ে শুরু হয় জেলেদের সমুদ্রযাত্রা ও মত্স্য আহরণ অভিযান। গভীর সাগরে কয়েকদিন মাছ ধরে ফিরে এসে ট্রলার ভিড়ান মত্স্যবন্দর রহমত বাজার, চৈতন্য বাজার, বাংলা বাজার, লাম্বিয়ার বাজার, কামাল বাজার, রামচরণ, তমরুদ্দি, চরচোঙ্গা, জাহাজমারা, মোক্তারিয়া, বালুয়া, চরআমান প্রভৃতি ঘাটে। এসব ঘাট থেকে পাইকারের আড়ত হয়ে মাছ চলে যায় দেশ-দেশান্তরে। তবে এখানকার জেলেরা উপযুক্ত টাকা পান না। আবার বিধি বাম হলে ট্রলার আর সাগর থেকে ফেরে না, মুছে যায় কিছু নাম। তবু সাহসী জেলেরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রেখে চলেছেন।
ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন একটি করে বড় তিনতলা লঞ্চ হাতিয়ার তমরুদ্দি ঘাট পর্যন্ত যাতায়াত করে। অপরদিকে চট্টগ্রাম থেকে সপ্তাহে পাঁচদিন একটি করে স্টিমার হাতিয়ার নলচিরা ঘাটে যাতায়াত করে। নোয়াখালী থেকে প্রতিদিন একটি করে সি-ট্রাক ও দুটি বেসরকারি লঞ্চ হাতিয়ার নলচিরা ঘাটে যাতায়াত করে। এছাড়া হাতিয়ার তমরুদ্দি চেঙ্গাঘাট থেকে প্রতিদিন দুটি ট্রলার নিঝুম দ্বীপের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। তবে এসব ট্রলার ছাড়ার শিডিউল ঠিক থাকে না। এছাড়া হাতিয়ার নলচিরা ঘাট বা চেঙ্গাঘাট থেকে জাহাজমারা ঘাটে গিয়ে সেখান থেকে ট্রলারযোগে নিঝুম দ্বীপে যাওয়া যায়। কিন্তু এসব ট্রলারে জীবন রক্ষাকারী উপকরণ নেই। ঝুঁকি নিয়েই যেতে হয় নিঝুম দ্বীপে।
মায়াময় স্বপ্নিল প্রকৃতির নিসর্গ নিঝুম দ্বীপ। বাংলাদেশের স্থলসীমার শেষপ্রান্তে বঙ্গোপসাগর আর মেঘনার মোহনায় গড়ে ওঠা খনিজ, প্রাণিজ আর উদ্ভিদ সম্পদে পরিপূর্ণ এই দ্বীপটি যেন আরেক খণ্ড বাংলাদেশ। দ্বীপে বসবাসকারী মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে রয়েছে নিবিড় বন্ধুত্ব। পশু-পাখির জন্য এটিই দেশের একমাত্র অভয়ারণ্য। মাত্র ৩ হাজার ৯৫২ একর জমির এই দ্বীপদেশে ৩০ হাজার মানুষের সঙ্গে ৪০ হাজার হরিণের বাস। এছাড়া সরকারি হিসাবে এই দ্বীপে সাত প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির পাখি আর ১৬ প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে। ২১ প্রজাতির বৃক্ষরাজির সঙ্গে ৪৩ প্রজাতির লতাগুল্ম দিয়ে সাজানো প্রকৃতির এক অপার লীলাভূমি। ঝিনুক সংগ্রাহকদের কাছে নিঝুম দ্বীপের বিস্তীর্ণ সমুদ্রতট এক জীবন্ত মিউজিয়াম। চারপাশে বঙ্গোপসাগরের লোনা পানির মধ্যে দ্বীপের ভেতরকার জলাশয় ও খালগুলো আবার মিঠাপানির সংরক্ষণাগার, যেন স্রষ্টার রহস্যময় সৃষ্টি। বিভিন্ন কলকারখানা আর যান্ত্রিক যানের কালো ধোঁয়া, বিকট শব্দ, অসহ্য যানজট কিছুই নেই এখানে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি কোনো ধরনের সন্ত্রাসের সঙ্গে পরিচিত নয় এখানকার মানুষ। সাগরের গর্জন আর পাখির কিচিরমিচির, ডাকাডাকিই নিঝুম দ্বীপের নির্জনতা ভাঙায়।
নোয়াখালী জেলার সর্বদক্ষিণের বিচ্ছিন্ন উপজেলা হাতিয়া। প্রমত্তা মেঘনা আর বঙ্গোপসাগরের ভাঙাগড়া খেলায় বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপটি দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে পৃথক। হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নের ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় নিঝুম দ্বীপের অবস্থান। মানচিত্রে দেখলে চোখের মতো দ্বীপ হাতিয়া আর চোখ থেকে ঝরেপড়া একফোঁটা অশ্রুই যেন নিঝুম দ্বীপ। সম্প্রতি মেঘনার ভাঙনে সর্বস্ব হারানো হাতিয়ার কিছু মানুষ বসতি গড়ে তুলেছে নিঝুম দ্বীপে।
২০০১ সালের জরিপ থেকে জানা যায়, নিঝুম দ্বীপের ভূমির পরিমাণ ৩ হাজার ৯৫২ একর। তবে গত ৯ বছরে পলি জমে দ্বীপের জমির পরিমাণ আরও বেড়েছে।
নিঝুম দ্বীপের উত্পত্তির ইতিহাস বেশ চমত্কার। আজ থেকে একশ’ বছরেরও বেশি সময় আগে গভীর রাতে মাছ ধরতে গিয়ে জেলেরা এই দ্বীপ জাগতে দেখেন। গভীর রাতে বঙ্গোপসাগর আর মেঘনার মোহনায় হঠাত্ সাগরের উথাল-পাতাল ঢেউ দেখে প্রথমে জেলেরা ভাবেন—হয়তো সাগর মোহনা দিয়ে অতিকায় তিমির বিশাল ঝাঁক পথ হারিয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। পানির তাণ্ডব দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় সাহসী জেলেরা রাতেই সেদিকে এগিয়ে যায় এবং বিশাল এক ডুবোচরের সন্ধান পান। সেই ডুবোচরেই ধীরে ধীরে পলি জমে সৃষ্টি হয় আজকের নিঝুম দ্বীপ। কিছুদিন পর মত্স্যশিকারি পাখির আনাগোনা দেখে স্থানীয় জেলেরাও মাছ ধরতে এই এলাকায় যাওয়া-আসা শুরু করেন। জেলেরা এই বিশাল চরের নাম দেন বালুয়ার চর। নিঝুম দ্বীপের বালুর রঙ স্বর্ণের রঙের মতো হওয়ায় কিছুদিন পর এর নামকরণ করা হয় স্বর্ণদ্বীপ। ১৯৬৯ সালে একদল জরিপকারী এই চরে জরিপ করতে আসেন। তখন ওসমান নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা জরিপকারীদের সহযোগিতা করেন। জরিপকারী দলটি এই চরের নামকরণ করেন চর ওসমান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের পানিতে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরাজির বীজ ভেসে আসায় দ্বীপটিতে গড়ে ওঠে এক বিশাল প্রাকৃতিক বনাঞ্চল। দ্বীপজুড়ে নেমে আসে গভীর নির্জনতা। পরে লোকের মুখে মুখে ফেরে একটিই নাম, তা হলো—নির্জন দ্বীপ। ১৯৭৯ সালে প্রয়াত সংসদ সদস্য তত্কালীন প্রতিমন্ত্রী আমিরুল ইসলাম পরিদর্শনে এসে নির্জন দ্বীপের শান্ত ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে দ্বীপটির নামকরণ করেন নিঝুম দ্বীপ।
দ্বীপের প্রাকৃতিক সম্পদের তালিকা প্রণয়নের কাজ আজও শেষ হয়নি। ১৯৯৬ সালের এক জরিপে সাত প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির পাখি আর ১৬ প্রজাতির সরীসৃপের সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়া সুন্দরী, কেউড়া, গেওয়া, গোলপাতাসহ অন্তত ২১ প্রজাতির গাছ ও ৪৩ প্রজাতির লতাগুল্ম দিয়ে প্রকৃতি সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে সাজিয়ে তুলেছে নিঝুম দ্বীপকে। তবে এখন প্রাণী ও উদ্ভিদের পরিমাণ বহুগুণে বেড়ে গেছে। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে সবুজে ঘেরা এই দ্বীপটিকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় বৃহদাকারের কোনো সবুজ তিমি পিঠ উঁচিয়ে রোদের তাপ নিচ্ছে। দ্বীপের দক্ষিণপাশে রয়েছে সাগরের বিস্তীর্ণ বেলাভূমি। গহিন অরণ্যে গাঢ় সবুজের ক্যানভাস। কোথাওবা ফুটে আছে নীলাভ হিজল-জারুলসহ নানা অজানা-অচেনা বাহারি বনফুল। সমুদ্রতটেই দেখা মেলে সাগরের পানিতে ভেসে আসা নানা প্রজাতির বীজের অদ্ভুত রহস্যময় বংশবিস্তার প্রক্রিয়া। তবে ইদানীং বন বিভাগ নিঝুম দ্বীপের বনাঞ্চল সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।
দ্বীপের চারপাশ ঘিরে আছে সমুদ্র। দ্বীপের মধ্যে রয়েছে অন্তত ৮টি খাল ও বেশকিছু মিঠাপানির জলাশয়। মেঘনার পানি খালগুলো ভরে রাখে। কোনো কোনো সময় নদীর পানি টান দিলে সাগরের নোনা পানি এসে সেই ঘাটতি পূরণ করে। সমুদ্রের ডাক শুনতে আমরা ছুটে যাই কক্সবাজার কিংবা কুয়াকাটায়। সমুদ্র সৈকত বলতে আমরা কক্সবাজার ও কুয়াকাটাকেই বুঝি। অথচ নিঝুম দ্বীপের বিস্তীর্ণ সমুদ্রতট আর মায়াবী হাতছানি এখনও পর্যটকদের চোখের আড়ালে। অদ্ভুত এক নির্জনতা ঘিরে আছে নিঝুম দ্বীপের ভেতরে-বাইরে। সাগরের বুকের ওপর বসে গর্জন শুনতে হলে নিঝুম দ্বীপই আদর্শ স্থান। দু-এক রাত এই দ্বীপে কাটালে সেই আনন্দ আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। গভীর রাতে সমুদ্রের ডাক কান্না হয়ে আসে। যারা এ দ্বীপে কখনও রাত কাটাননি, তাদের কাছে এই অভিজ্ঞতা ভিন্ন।
সম্প্রতি নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন আরও কয়েকটি চর জেগেছে। চরজব্বার, চররশিদ, চরআজমল, চরআমানত—যেদিকেই তাকান না কেন, দিগন্তবিস্তৃত মাঠ—যেন সবুজ ঘাসের শ্যামল এক পৃথিবী চোখে পড়বে। নভেম্বরে প্যারাগনের ফাঁকে ফাঁকে বুনোফুলের সমাহার সহজেই যে কাউকে কাছে টানে। খালের দুই পাড়ে নদীর কূলে আর সমুদ্রতটে রয়েছে বিশাল বনভূমি, বনে রয়েছে হাজার হাজার চিত্রল হরিণ। এই দ্বীপে ঘুরতে আসা পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে হরিণের দেখা পাওয়া। শত শত হরিণ একসঙ্গে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য একমাত্র নিঝুম দ্বীপেই দেখা যায়। গহিন অরণ্য থেকে প্রায় প্রতিদিনই দু-একবার হরিণের দল আসে লোকালয়ে। তারা বিভিন্ন ফসলি জমি ও সবুজ ঘাসের মাঠে চরে বেড়ায়। তবে কার্তিক মাসে হরিণের দেখা পাওয়া দুষ্কর। এ সময় ফসলের মৌসুম হওয়ায় কৃষকরা দল বেঁধে মাঠে কাজ করেন। আর খালবিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় শিশু-কিশোররা এখানে মাছ শিকার ও খেলাধুলা করে। তারা হরিণ দেখলেই ধাওয়া করে। ফলে এ মৌসুমে হরিণ একেবারেই নিরাপদ পরিবেশ না পেলে দিনের বেলায় বন থেকে বের হয় না। তবে রাতে বের হয়। বড় টর্চলাইট নিয়ে রাতে একটু ঘোরাফেরা করলেই দল বেঁধে হরিণ দেখার সাধ মিটবে। হরিণের ঝাঁক নিঝুম দ্বীপের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
নির্জন এই দ্বীপে হরিণ কীভাবে এলো : এই ইতিহাস আরও আকর্ষণীয়। টমাসথন নামে এক ব্রিটিশ পর্যটক একজোড়া পোষা হরিণ সঙ্গে নিয়ে এই দ্বীপে ভ্রমণে আসেন। একপর্যায়ে তার হরিণদুটি ছুটতে ছুটতে গভীর অরণ্যে চলে যায়। আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই থেকে ক্রমান্বয়ে বংশবিস্তার। পরে অবশ্য বন বিভাগ আরও কিছু হরিণ অবমুক্ত করে দ্বীপটিকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করে। এছাড়া লাখ লাখ অতিথি পাখির জন্য দ্বীপটি এক বিরাট আকর্ষণ। শীতের সময় খাদ্যের অন্বেষণে এসব পাখি উড়ে আসে এই দ্বীপে। ঝাঁক বেঁধে এরা চলাফেরা করে, কাদাপানিতে বাসা বাঁধে। গ্রীষ্মকালে যখন যাযাবর পাখিরা বিদায় নেয়, তখন আকাশে নীল ঠোঁটওয়ালা কয়েক হাজার লাজুক ও দুর্লভ প্রজাতির সাদা মাথা হাঁস কোত্থেকে যেন উদয় হয়। এরা এখানকার ঝোপঝাড়ে ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটায়। পাখিদের মোহনীয় কূজন শুনে মনে হয় এ এক রূপকথার পক্ষীরাজ্য। হাজার হাজার হরিণের সঙ্গে বনমোরগের ঝাঁক নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায় গোটা দ্বীপে। দ্বীপের বাসিন্দারাও এসব প্রাণীরক্ষায় বদ্ধপরিকর। এ দ্বীপে শিকারির প্রবেশাধিকার একেবারেই নিষিদ্ধ। এছাড়া বাঘ ও কুকুরের মতো কোনো হিংস্র প্রাণীও নেই। গোধূলিলগ্নে পাখির কুহুতান প্রাণী আর সমুদ্রের লোনা বাতাসের গন্ধ মিলে তৈরি হয় এক মোহনীয় ইন্দ্রজাল।
দ্বীপের ৩০ হাজার বাসিন্দার বেশিরভাগই ভয়ঙ্কর মেঘনা ও গভীর সমুদ্রে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু গভীর সাগরে মাছ ধরার আধুনিক উপকরণ তাদের নেই। ইঞ্জিনবিহীন সাম্পানে করে তারা চলে যায় গভীর সমুদ্রে। আস্ত গাছ চেরাই করে দু-তিন ইঞ্চি পুরু তক্তা দিয়ে তৈরি করা হয় সাম্পান। সাম্পানে জাল, রশি, ফ্লোট, টোম, রেডিও ও প্রয়োজনীয় খাবার নিয়ে শুরু হয় জেলেদের সমুদ্রযাত্রা ও মত্স্য আহরণ অভিযান। গভীর সাগরে কয়েকদিন মাছ ধরে ফিরে এসে ট্রলার ভিড়ান মত্স্যবন্দর রহমত বাজার, চৈতন্য বাজার, বাংলা বাজার, লাম্বিয়ার বাজার, কামাল বাজার, রামচরণ, তমরুদ্দি, চরচোঙ্গা, জাহাজমারা, মোক্তারিয়া, বালুয়া, চরআমান প্রভৃতি ঘাটে। এসব ঘাট থেকে পাইকারের আড়ত হয়ে মাছ চলে যায় দেশ-দেশান্তরে। তবে এখানকার জেলেরা উপযুক্ত টাকা পান না। আবার বিধি বাম হলে ট্রলার আর সাগর থেকে ফেরে না, মুছে যায় কিছু নাম। তবু সাহসী জেলেরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রেখে চলেছেন।
ঢাকার সদরঘাট থেকে প্রতিদিন একটি করে বড় তিনতলা লঞ্চ হাতিয়ার তমরুদ্দি ঘাট পর্যন্ত যাতায়াত করে। অপরদিকে চট্টগ্রাম থেকে সপ্তাহে পাঁচদিন একটি করে স্টিমার হাতিয়ার নলচিরা ঘাটে যাতায়াত করে। নোয়াখালী থেকে প্রতিদিন একটি করে সি-ট্রাক ও দুটি বেসরকারি লঞ্চ হাতিয়ার নলচিরা ঘাটে যাতায়াত করে। এছাড়া হাতিয়ার তমরুদ্দি চেঙ্গাঘাট থেকে প্রতিদিন দুটি ট্রলার নিঝুম দ্বীপের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। তবে এসব ট্রলার ছাড়ার শিডিউল ঠিক থাকে না। এছাড়া হাতিয়ার নলচিরা ঘাট বা চেঙ্গাঘাট থেকে জাহাজমারা ঘাটে গিয়ে সেখান থেকে ট্রলারযোগে নিঝুম দ্বীপে যাওয়া যায়। কিন্তু এসব ট্রলারে জীবন রক্ষাকারী উপকরণ নেই। ঝুঁকি নিয়েই যেতে হয় নিঝুম দ্বীপে।
No comments:
Post a Comment