জলপ্রপাতের নাম নাফাখুম

গত ৬ আগস্ট, বিকেল। বান্দরবান শহরে আদিবাসী সাংস্কৃতিক একাডেমিতে দেখা হলো প্রথম আলোর বান্দারবান প্রতিনিধি বুদ্ধজ্যোতি চাকমার সঙ্গে। কিছুক্ষণ আগেই আমরা ফিরেছি এক অভিযান শেষ করে। বুদ্ধজ্যোতি বললেন, ‘যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে দেখা হলে আপনাদের যেতে দিতাম না। বর্ষার এ সময়টা ওইখানে মাঝেমধ্যেই তিন-চারজন “খরচা” হয়ে যায়।’ তাঁর সঙ্গে আসা প্রথম আলো বন্ধুসভার কয়েকজন বন্ধুও সায় দিলেন।
অভিযান শেষ, তার পরও ‘খরচা’ শব্দটার অর্থ বুঝে আমাদের বিশেষ করে আমার মধ্যে ভয় শুরু হলো। তবে নিজেকে অভয় দিলাম এই বলে যে ভালোয় ভালোয় ফিরে এসেছি লাইফটাইম একটা এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে।
দারুণ এই অভিজ্ঞতা যে গন্তব্যে, সেটি নাফাখুম জলপ্রপাত। রেমাক্রি জলপ্রপাত নামেও এটা অনেকের কাছে পরিচিত। জলপ্রপাতটা দেখে সবারই মনে হয়েছে, বাংলাদেশেও এমন জায়গা আছে!
নাফাখুম কিছুটা দুর্গম। বিশেষ করে, বৃষ্টিবাদলার দিনগুলোয়। তাই তো একেবারে জলপ্রপাত ঘুরে আসা সমতল ভূমির মানুষের সংখ্যাও কম। আমাদের ছোটখাটো দলের সবারই ইচ্ছে ছিল, বান্দরবানে কোনো ঝরনা বা জলপ্রপাত দেখে আসা। যেখানে যেতে আবার ট্রেকিংও যেন করতে হয়। দলটি এক অর্থে বেশ বিস্ময়কর, আবার আরেকভাবে চিন্তা করলে, দলটিতে দারুণ ভারসাম্য রয়েছে। দলে একদিকে আছেন বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী মুসা ইব্রাহীম, যিনি আমাদের গন্তব্য নাফাখুম জলপ্রপাত ঠিক করেছেন। অপরদিকে আমার মতো ৮৬ কেজি ওজনের মানুষ। মাঝখানে প্রথম আলোর সিমু নাসের, জাবেদ সুলতান পিয়াস আর সিমু নাসেরের স্ত্রী চারুকলার ছাত্রী সিফাত আজিম। একদিকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠা মুসা, অন্যদিকে পাহাড়ে অনভিজ্ঞ বা কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞ লোকজন—এমন ভারসাম্য কি আর সহজে মেলে?
থানচি হয়ে তিন্দু
গত ৪ আগস্ট সকালেই বাসে বান্দরবান শহর। বাস থেকে আমাদের নামিয়ে নিলেন গাইড মংখাই। ৯-১০ বছর আগে যখন মুসার পর্বতারোহণ শুরু বান্দরবানের পাহাড়-পর্বত দিয়ে, তখন থেকেই মুসার বিভিন্ন অভিযানের সঙ্গী তিনি। গত মাসের নাফাখুম অভিযানে মংখাই আমাদের সঙ্গী। মংখাইয়ের সঙ্গে কথা বলে মুসা আগেই রুট ঠিক করেছেন। তাঁর পরামর্শে আর প্রবল উৎসাহে আমাদের প্রস্তুতিও ব্যাপক। মশা যাতে না কামড়ায় সে জন্য মলম অডোমাস, বর্ষাতি, ছাতা, পর্যাপ্ত টয়লেট টিস্যু, হাফ বা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, পিচ্ছিল পথে হাঁটার উপযোগী স্যান্ডেল, টুকটাক ওষুধ, বারান্দাওয়ালা টুপি, টি-শার্ট, তিনদিকে সেলাই করা বিছানার চাদর (ঘুমানোর জন্য), টর্চলাইট, হেডল্যাম্প, এমনকি ক্যামেরার জন্য বর্ষাতি—লটবহর কম নয়। সব নিয়ে চড়া হয় ভাড়া করা নিশান পেট্রলগাড়িতে। চালক আনন্দ নিয়ে যাবেন থানচি পর্যন্ত। বান্দরবান থেকে ৭৯ কিলোমিটার। শুরু হলো গাড়ির চড়াই-উতরাই পেরোনো। পাহাড়ি পথের ধারে মিশ্র ফল বাগান, আদিবাসীদের চলাচল সবই মুগ্ধ করে। একে একে আমরা পার হই মিলনছড়া, নীলগিরি, চিম্বুক, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাস্তা ‘পিক ৬৯’, বাঘাইছড়া। মাঝেমধ্যে আমরা থামি, ছবিটবি তুলি; আবার চলতে থাকি আনন্দের জিম্মায়। পাহাড়ের একটা জায়গায় অনেক দূরে বঙ্গোপসাগরও দেখা যায়। ক্যামেরার টেলিলেন্সে নিশ্চিত হওয়া যায়, ওটা সমুদ্রই। ঘণ্টাতিনেক পরে গাড়ি পৌঁছায় থানচির এপারে শঙ্খ নদীর পাড়ে। পাহাড়িদের কাছে এ নদীর নাম সাঙ্গু। এই সাঙ্গু বেয়েই আমাদের উঠতে হবে রেমাক্রি বাজার অবধি। উঠতে হবে এ কারণে, শঙ্খ নদী নেমেছে পাহাড় বেয়ে। আমাদের গন্তব্য যেহেতু ঊর্ধ্বমুখী, তাই নদী বেয়ে ওঠা ছাড়া উপায় কী!
ইঞ্জিনচালিত চিকনচাকন একটা নৌকা ভাড়া করে ফেললেন মংখাই। শঙ্খ নদীর ওপারে থানচি বাজারে যেতে হবে আগে। দুপুরের খাবার ছাড়াও বিডিআর ক্যাম্প থেকে অনুমতি নেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা আছে। বাজারে আদিবাসী একটা পান্থশালায় মুরগি আর সবজি দিয়ে খাওয়া হলো। পাহাড়ি রান্নায় অনভ্যস্ত হওয়ায় মুরগিটা জমল না, জমল সবজি। মুসা ইব্রাহীম এভারেস্ট বিজয়ী, তিনি এখন তারকা। বিডিআরের কয়েকজন সদস্য তাঁর সঙ্গে এভারেস্ট নিয়ে কথাবার্তা শুরু করলেন। আমাদের বলা হলো, এ সময়টা দুর্ঘটনা ঘটে। তবে গত কয়েক দিন জোরালো বৃষ্টি হয়নি। তাই পাহাড়ি ঢল নামেনি। ঢল নামলে এ পথে যাওয়ার জন্য বিডিআরের অনুমতি মেলে না। জানা গেল ঘণ্টাখানেক আগে বিডিআরের অতিথি হয়ে আসা একটি দলও রওনা হয়ে গেছে। তবে অনুমতির আগে সবার ঢাকার ঠিকানা ও আত্মীয়ের ফোন নম্বর লিখে দিতে হলো। নৌকায় ওঠার আগে দূর পাহাড়ে দেখা গেল বৃষ্টি। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই বারিধারা থানচিতেও। থেমে গেল অল্পক্ষণেই। নৌকায় শুরু হলো আমাদের যাত্রা।
সাঙ্গু খরস্রোতা, পাথুরে। নৌকা কিছুক্ষণ চলতেই দুই পাশে অপূর্ব সৌন্দর্যের সব পাহাড়। নদীতে এসে পড়ছে ছোট ছোট ঝরনাধারা। জুম চাষের পাহাড়গুলো যেন হালকা সবুজের মোলায়েম মখমল। এখানে সেখানে আদিবাসী বাড়ি। নদীর বাঁকগুলোয় ছোট-বড় পাথরের স্তূপ আর প্রবল স্রোত। দুবার নামতেও হলো নৌকা থেকে। মাঝি আর তাঁর সঙ্গীরা ইঞ্জিন চালিয়ে, লগি ঠেলে ওসব বাঁকে নৌকা পার করলেন। এ নৌকায় সঙ্গী হয়েছে আদিবাসী পিতা-পুত্র। ছেলেটি শিশু, বয়স হবে আট-নয়। জানা গেল তার পেটে অস্ত্রোপচার হয়েছে, ব্যান্ডেজও রয়েছে। কিন্তু ভয়াল বাঁকগুলোতেও শিশুটি নৌকার পাটাতনে আধশোয়া, নির্বিকার তার ভঙ্গি। বোঝাই গেল প্রকৃতির সঙ্গে এভাবে জুুঝতে জুঝতেই বড় হবে শিশুটি। যেমন হয়েছেন তার পূর্বপুরুষেরা।
সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে নৌকা পৌঁছাল তিন্দু বাজারের ঘাটে। নেমেই উঁচু পাহাড়ে সোনালি আকাশ চোখে পড়ল। নদীর ঘাট থেকে সিঁড়ি বেয়ে বেশ উঁচুতে তিন্দুবাজার। কাঠের একটা ছোট দোতলায় থাকার ব্যবস্থা করা হলো। মশার কামড় থেকে বাঁচতে শরীরের খোলা অংশে মাখা হলো অডোমাস।
তিন্দু থানচি উপজেলার একটা ইউনিয়ন। চেয়ারম্যান শাইয়ানের সঙ্গে কথা হয় তাঁর দোকানে। সৌরবিদ্যুৎ আছে বাজারে। তারই টিমটিমে আলো থাকে রাতে। মোবাইল ফোনের মধ্যে শুধু টেলিটকের নেটওয়ার্ক রয়েছে। কোনো টিভি চ্যানেল, বেতার বা সংবাদপত্র এখানে নেই। ফলে খবর জানা যায় শুধু মোবাইল ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলে। তবে বাজারে সাবান, শ্যাম্পু, প্যাকেটের গুঁড়া মসলা ইত্যাদি ভোগ্যপণ্যই পাওয়া যায়।
রাতের খাওয়াটা হলো বেশ। মুরগির ঝোল, ভাত আর বাঁশের ঝোল। কেউ তো এমনিতে কোনো দিন বাঁশ খেতে চায় না, কিন্তু খাওয়ার সময় দেখা গেল দলের সবাই শুধু বাঁশই খেতে চাইছে। রাত নয়টার মধ্যে পুরো বাজার নীরব। বন্ধ হয়ে গেছে চেয়ারম্যানের টেলিভিশনটাও। এটাতে কোনো চ্যানেল নয়, ডিভিডি চালিয়ে দেখা হয়। উঁচু পাহাড় থেকে আকাশটা মনে হলো কাছেই। দলের সবাই বাজারে মাঝখানে ফেলে রাখা বাঁশের ওপর শুয়ে-বসে দেখতে থাকি অজস্র তারাভরা আকাশ। রাত বাড়তে থাকে, আকাশের তারা আরও উজ্জ্বল হতে থাকে। পাল্লা দিয়ে বাড়ে আমাদের মুগ্ধতা।
রেমাক্রির পথে
ভোর ছয়টাতেই ঘুম ভেঙে যায় সবার। দ্রুত প্রস্তুত হয়ে আবারও নৌযাত্রা। এবারের নৌপথ নাকি আরও কঠিন। কিছুক্ষণ পর তা বোঝাও গেল। জায়গাটার নাম কেয়াপেজা। বড় বড় পাথর। বড় তিন-চারটা পাথর আছে নদীর মাঝখানে, সেসব পাথরে তাঁবু খাটিয়ে থাকাও যায়। থেকেছেনও বৈমানিক এনাম তালুকদার আর অভিযাত্রী, আলোকচিত্রী রোনাল্ড হালদার। ফেসবুকে সেই তাঁবুবাসের ছবিও আছে। বিডিআরের লোকজন এই পাথরের কথা বলেই সাবধান করে দিয়েছিলেন। কেয়াপেজা পার হওয়ার খানিকটা পর নদী আরও বিরূপ। আমরা নেমে গেলাম নৌকা থেকে। শুরু হলো মানুষ, যন্ত্র বনাম প্রকৃতির লড়াই। অবশেষে পার হলো নৌকা, জয় মানুষেরই।
দুই পাশে প্রকৃতি অসীম আর উদার। জুমের সবুজ মখমলে মাঝেমধ্যে কালো কালো দাগ চোখে পড়ে। মনে হয় যেন ঘা। আসলে তা-ই। পাহাড়ের গায়ে থাকা বড় বড় গাছ কাটার চিহ্ন ওইগুলো। মনটা খারাপ হয়ে যায়। যেমন খারাপ লেগেছিল বান্দরবান থেকে থানচি বাজার আসার পথে দূর পাহাড়ের মাঝে ইটভাটার চিমনি দেখে।
আড়াই ঘণ্টার নৌকাযাত্রা শেষে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পৌঁছে যাই রেমাক্রি বাজারে। এটাও থানচির একটা ইউনিয়ন। থাকার জায়গা বের করি। ঠিক হয় বাজারে থাকব। এ বাজারেও সৌরবিদ্যুৎ, তবে মোবাইল ফোন নেই। থাকার জন্য এবার একতলা ঘর। মেঝেটা কাঠের। আমাদের লটবহর রেখে সাড়ে ১০টায় শুরু হয় মূল অভিযান—নাফাখুম জলপ্রপাত। আমাদের দলে যুক্ত হয় আদিবাসী এক কিশোর, যে নাফাখুমের পথটা চেনে।
ঝিরি বেয়ে নাফাখুমের পথে
গাড়ি ও নৌকার পালা শেষ রেমাক্রি বাজারেই। এবার ট্রেকিং মানে হাঁটাপথ। রেমাক্রি বাজারে সাঙ্গু বাঁক নিয়েছে। এই বাঁকে এসে পড়েছে রেমাক্রি খাল। খালের শুরুটা নাফাখুম জলপ্রপাতে। মাঝেমধ্যে অনেক ঝরনার পানি যোগ হয়েছে খালে। এই খাল মানে ঝিরি ধরেই হাঁটা আমাদের। শুরুতেই তিনটা পাহাড় ডিঙাতে হবে। অন্যদের তেমন কিছু না, একটা পাহাড় ডিঙাতেই আমার অবস্থা খারাপ। বসেই পড়ি এক জায়গায়। এগিয়ে আসেন মুসা। নানা কথা বলেন, উজ্জীবিত করেন। দলের সঙ্গে তাল মেলাতে শুরু করি। তিন পাহাড় পেরোতে ৪৫ মিনিট। এবার ঝিরি ধরে এগোনো। পাথুরে খালের দুই পাড় হাঁটার জন্য বন্ধুর। তবে শীতল, প্রায় স্বচ্ছ পানি আর নির্ভেজাল প্রকৃতির কারণে শরীর ও মন সতেজ হয়ে ওঠে। ঝিরির দুই পাড় বেশির ভাগ পাথুরে ও সরু। কোথাও কোথাও পিচ্ছিল। মাঝেমধ্যে আবার হাঁটু বা কোমরসমান স্রোত ঠেলে এপার-ওপার করতে হয়। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর আদিবাসীদের শেষ পাড়াটাও আমরা পেরিয়ে এলাম। মাঝেমধ্যে জুম চাষের পাহাড়ে বা ঝিরির পানিতে স্নানরত এক-দুজন আদিবাসী ছাড়া কোনো মানুষও চোখে পড়ে না। রেমাক্রি খালে এসে মিশেছে ছোট-বড় অনেক ঝরনা। শীতল সেই ঝরনাগুলোর পানি শীতল এবং সুপেয়। ঝরনা আর ঝিরির পানিতে ভিজে শরীর সতেজ হচ্ছে, আবার আমরা হাঁটছি। এভাবে একটা জায়গায় পৌঁছালাম আমরা। যেখানে খাল আর হেঁটে পার হওয়া যাবে না। আমি আর সিফাত সাঁতার জানি না। কী হবে?
ঝিরির পাশে এক জুমচাষি কাজ করছিলেন। তাঁর হাতের দা নিয়ে আমাদের কিশোর গাইড তিনটা কলাগাছ কেটে আনল। কলাগাছের আঁশ দিয়েই বাঁধা হলো সেগুলো। সামনে বাঁশের একটা কঞ্চি গাঁথা হলো। আমি সেটা ধরে থাকব, মুসা ও দুই গাইড সাঁতরে ঠেলে খাল পার করবেন। প্রথমে আমি, পরে সিফাত—পার হলাম এভাবে। এরপর পথ আরও জটিল। কাঁদা, পাথরের সঙ্গে যোগ হয়েছে ঝোপঝাড়। আরও প্রায় আধাঘণ্টা হাঁটার পর শোনা গেলে পানির শব্দ। দেখা মিলল শুভ্র জলরাশির—নাফাখুম জলপ্রপাত।
প্রায় ১৫-২০ ফুট ওপর থেকে পানি পড়ছে নিচের রেমাক্রি খালে। তীব্র স্রোত তৈরি করে চলে যাচ্ছে সাঙ্গু নদীর দিকে। জলপ্রপাতের প্রস্থ ৪০ ফুটের কম না। দুদিকে বড় পাথরের দেয়াল। এমন জলপ্রপাত বাংলাদেশে, বিশ্বাসই যেন হতে চায় না। জলপ্রপাতের নিচে পাথুরে গুহাও আছে। সেই গুহা চলে গেছে পাহাড়ের অনেকটা ভেতরে। জলপ্রপাতের শুভ্র জলরাশির মধ্যে হঠাৎ নীল একটা আকৃতি চোখে পড়ল। দেখা গেল একজন আদিবাসী মারমা বাঁশের আগায় জাল বেঁধে মাছ ধরছেন। ওপর থেকে পানি পড়ার সময় সব মাছ লাফ দেয়। লাফ দিয়ে জালে এসে ধরা দেয় এসব মাছ।
বিষয়টা সরেজমিন বোঝার জন্য মুসা আর সিমু নাসের পাথুরে পাড় থেকে জলপ্রপাতের জলধারায় ডাইভ দেন। স্রোত তাঁদের আট থেকে ১০ ফুট ঠেলে নিয়ে যায়। একটা পাথর আঁকড়ে ধরে তাঁরা উঠে যান ওপারে। তারপর পাথুরে পাহাড় ধরে ধরে জলপ্রপাতের ভেতরে গুহার মুখে যান তাঁরা। এই গুহা নিয়ে নানান কিংবদন্তি আছে। গুহায় নাকি বিরাট কিছু মাছ আছে, সেগুলো ধরতে যারা গুহায় ঢোকে, তারা আর ফিরে আসে না।
দেড় ঘণ্টার মতো আমরা নাফাখুম দেখলাম, মুগ্ধ হলাম। আবার হাঁটতে হবে আট কিলোমিটার বন্ধুর পথ। দিনের আলো থাকতেই পৌঁছাতে হবে রেমাক্রি বাজারে। আদিবাসী মৎস্য শিকারির কাছ থেকে বেশ কিছু নলাজাতীয় মাছ কিনে শুরু হলো ফিরতি যাত্রা। রাতে খাওয়া হয় এই মাছ ভাজা আর পরদিন সকালে এই মাছের কাবাব।
ফেরার সময় বিরতিহীন হাঁটা। ঝিরঝির বৃষ্টি থাকলেও কোথাও থামা হয়নি। সন্ধ্যা নেমে এল আর আমরা ঝিরি থেকে উঠে গেলাম পাহাড়িপাড়ায়। নাফাখুমে শীতকালেও পানি থাকে, তবে পরিমাণে কম। শীতকালে যাওয়া-আসার পথের ঝুঁকিটাও অনেক কম।
গত ৬ আগস্ট সকালে আবার নৌকাযাত্রা। ফিরতি পথ মানে নেমে যাওয়া থানচির পথে। যে পথে যেতে সময় লেগেছিল ছয় ঘণ্টা, ফিরতে লাগল দেড় ঘণ্টা। সাঙ্গুর বাঁকগুলোয় ওঠার চেয়ে যে নামা আরও বিপজ্জনক, তা বোঝাও গেল। বিশেষ করে কেয়াপেজা জায়গাটা। নানা রকম পাথর এড়িয়ে যে নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে মাঝিরা নৌকা চালালেন, তা দেখার মতো।
দুই পাশের অপার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা ফিরে এলাম থানচি। জেনে এলাম নাফাখুমের যে পানি, তার উৎস আরও দুই দিনের পথ। সেখানেও আছে জলপ্রপাত। এর চেয়েও বেশি উঁচু প্রায় ১০০ ফুট ওপর থেকে পড়ে বিপুল জলরাশি। তাজিনডং পেরিয়ে যেতে হয় সেখানে। বান্দরবানে রোমাঞ্চকর এ রকম দারুণ সুন্দর জায়গাগুলো নিয়ে আমরা তো গর্ব করতেই পারি, বেরিয়ে যেতে পারি অভিযানে।
যেভাবে যাবেন
বাসে ঢাকা থেকে বান্দরবান, ভাড়া ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা। চান্দের গাড়ি বা ভাড়া করা ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়িতে থানচি। চান্দের গাড়ির ভাড়া জনপ্রতি ২০০ আর গাড়ি ভাড়া করলে তিন হাজার থেকে তিন হাজার ৫০০ টাকা। থানচি থেকে রেমাক্রি নৌকায় যাওয়া-আসা, ভাড়া চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা।
থাকা: থানচি, তিন্দু বা রেমাক্রি বাজারে কাঠের ঘরে থাকা যাবে। থাকার জন্য টাকা লাগবে না, তবে খাওয়ার জন্য প্রতি বেলায় জনপ্রতি লাগবে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এ ছাড়া গাইডের সহযোগিতায় আদিবাসী গ্রামেও থাকা যেতে পারে।
Source:
নাফাখুম...... বাংলাদেশের নায়েগ্রা!
![]()
নাফাখুম
নাফাখুম (আপস্ট্রীম থেকে তোলা)
নাফাখুমের পড়ন্ত জলের ধারার নীচে গিয়ে বসার সুযোগ রয়েছে। আমার-আপনার জন্য বিষয়টা বেশ রিস্কি হলেও পাহাড়ীরা জলপ্রপাতের পিছনে বসে অনায়াসে মাছ শিকার করে। এক ধরনের উড়ুক্কু মাছ (স্থানীয় ভাষায় মাছটির নাম নাতিং মাছ) উজান ঠেলে এসে নাফাখুমে বাধাপ্রাপ্ত হয়, লাফ দিয়ে এই প্রপাত-টা আর ক্রস করতে পারেনা....গিয়ে পড়ে জলপ্রপাতের ভিতরে ছোট্ট একটা গুহায়। অনায়াসে সেখান থেকে মাছ সংগ্রহ করে স্থানীয় পাহাড়ীরা।
রেমাক্রি বাজার (নদী থেকে তোলা)
রেমাক্রি বাজার থেকে দুইভাবে নাফাখুম-এ যাওয়া যায়। এক ঘন্টা উঁচু-নীচু পাহাড়ী পথ মাড়িয়ে(পাহাড় ডিঙিয়ে) তারপর রেমাক্রি খালের পাড় ধরে বাকিটা হেঁটে চলা। এই পথে গেলে নাফাখুমে পৌঁছাতে আপনার সময় লাগবে চার ঘন্টা। রেমাক্রি খাল ক্রস করতে হবে তিন বার, যার মধ্যে শেষবার আপনাকে সাঁতার পানি পেরুতে হবে। আপনি পাহাড় না ডিঙিয়ে গোটা পথই রেমাক্রি খালের পাশ দিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে নৌকা করে রেমাক্রি খালের মুখে (যেখানে রেমাক্রি খাল সাঙ্গুতে পড়েছে, রেমাক্রিখুম) যেতে হবে আপনাকে...তারপর খালের পাড় দিয়ে হাঁটা পথে নাফাখুম বরাবর। এই পথে আপনাকে চার বার খালটি ক্রস করতে হবে...তবে সময় লাগবে তিন ঘন্টা। আমি আপনাকে দ্বিতীয় পথেই যেতে পরামর্শ দেব...এতে আপনার সময় ও এনার্জী দু'টোই ব্যয় হবে কম। আর শীতের দিনে গেলে খাল ক্রস করার ঝামেলাই নেই.... গোটাটাই আপনি ঝিরিপথ দিয়ে হেঁটে যেতে পারবেন। তবে শীতকালে নাফাখুম-এর এই পূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ হবেনা.... পানি প্রবাহ অনেক কমে যাবে তখন।
রেমাক্রিখুম-টাও খুব সুন্দর! রেমাক্রি বাজারের কাছেই এই 'রেমাক্রি খুম'। রেমাক্রি খাল যেখানে এসে সাঙ্গু নদীতে পড়েছে.... সেটাই রেমাক্রি খুম।
রেমাক্রিখুম
পাঁচ-ছয় ফুট উপর থেকে কয়েকটি ধাপে পানি পড়ছে এই জলপ্রপাতে। এ'টি অনেক চওড়া। এই জলপ্রপাতটিও আপনাকে মুগ্ধ করবে নিঃসন্দেহে। তিন্দু থেকে রেমাক্রি যাবার পথেই চোখে পড়বে এই রেমাক্রিখুম।
রেমাক্রিখুম
সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ব্লগার বান্দরবানের থানচি উপজেলার তিন্দু, বড়পাথর, রেমাক্রি ঘুরে এসেছেন... চমৎকার সব ছবিসহ অনেকে পোস্ট-ও দিয়েছেন। বিস্তারিত না গিয়ে আমি শুধু কিছু তথ্য শেয়ার করছি এখানে....
নীলগিরি
১. বান্দরবান শহর থেকে থানচি উপজেলা (বান্দরবান জেলার সর্বদক্ষিণের উপজেলা) সদরের দূরত্ব ৮২ কিঃমিঃ। রিজার্ভ চাঁদের গাড়ীতে বান্দরবান থেকে থানচি যেতে সময় লাগবে ৩ ঘন্টা, ভাড়া নেবে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। পথে চিম্বুক আর নীলগিরিতে নেমে কিছু ছবি তোলার ইচ্ছে থাকলে সময় কিছুটা বেশী লেগে যেতে পারে।
তিন্দু (সাঙ্গুর পাড়ে)
তীব্র স্রোত ঠেলে উজানে যাবার চেষ্টা
২. বর্ষায় ইঞ্জিনবোটে থানচি থেকে তিন্দু যেতে সময় লাগবে আড়াই ঘন্টা। তিন্দু থেকে রেমাক্রি যেতে লাগবে আরও আড়াই ঘন্টা। এই পাঁচ ঘন্টার নৌ-পথে আপনি উজান ঠেলে উপরের দিকে উঠতে থাকবেন আর ভার্টিকেল ডিষ্টেন্স কভার করবেন প্রায় ৫০ মিটার । শীতের সময় ইঞ্জিন বোট চলার মত নদীতে যথেষ্ট গভীরতা থাকেনা...তখন ঠ্যালা নৌকাই একমাত্র বাহন। বর্ষা মৌসুমে তিন দিনের জন্য ইঞ্জিনবোটের ভাড়া পড়বে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। আর শীত মৌসুমে ঠ্যালা-নৌকার ভাড়া পড়বে প্রতি দিনের জন্য ১০০০ টাকা।
সাঙ্গু নদীর উজানে হঠাৎ এরকম স্টেপ-ডাউন পাবেন প্রচুর
৩. থানচি থেকে যত উজানে যাবেন (দক্ষিণে).... নদীর স্লোপ তত বাড়তে থাকবে। গোটা নদীপথেই একটা জেন্টেল স্লোপ-তো আছেই...তার উপরে মাঝে মাঝেই আছে ১ ফুট থেকে ১ মিটার পর্যন্ত খাড়া স্টেপ-আপ। আমি রেমাক্রি ছাড়িয়েও ছোট মওদক পর্যন্ত গেছি। কিন্তু তিন্দু থেকে রেমাক্রি পর্যন্ত নদীপথ-টুকুই বেশী খরস্রোতা ও একটু ঝুঁকিপূর্ণ।
যখন আমরা বড়পাথর অতিক্রম করছি
৪. ঢালু পাহাড়ী নদী খরস্রোতা হওয়াই স্বভাবিক... বর্ষায় সাঙ্গুও সেইরকম খরস্রোতা। তবে ভয় পাবার কিছু নেই। নৌকার মাঝিরা যথেষ্ট স্কীল বলেই মনে হলো। দু' একটা দূর্ঘটনার গল্প হয়তো শুনবেন.... কিন্তু আমি ভয়ের কিছু দেখিনি, বরং ফেরার সময় রাফটিং-এর একটা মজা উপভোগ করেছি। থাকা-খাওয়ার কিছুটা অসুবিধা মেনে নিলে এমনকি এ্যডভেঞ্চার প্রিয় মেয়েরাও অনায়াসে রেমাক্রি পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারবেন।
চমৎকার সুস্বাদু চাঁপা কলা
৫. থানচি থেকে নৌকায় উঠার সময় মাত্র ১০০ টাকায় এইরকম এক কাঁদি চাঁপা কলা নৌকায় তুলে নিলে.... পথে বেশ কাজে লাগবে।
৬. হাতি পোকার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য এন্টি মসক্যুইটো ক্রীম নিতে ভুলবেন না।
রেমাক্রি রেস্ট হাউজের বারান্দায়... ধুম ঘুম!
৭. রেমাক্রি পর্যন্ত যদি যান... তবে এইভাবে ঘুমিয়ে সময় না কাটিয়ে একটু কষ্ট করে 'নাফাখুম' দেখে আসতে ভুলবেন না। হাতে সময় থাকলে ব্যাটকেভ বা বাঁদূর গুহা-টাও দেখে আ কোন সময়সতে পারেন, যদিও আমরা ব্যাটকেভ দেখে আসার সময় করতে পারিনি।
৮. আর্মি বা বিডিআর-এর রেফারেন্স থাকলে তিন্দু ও রেমাক্রিতে বিডিআর-এর আতিথেয়তা পেতে কষ্ট হবেনা.... আর বিডিআর-এর আতিথেয়তা পেলে থাকা-খাওয়ার সম্ভাব্য সর্বোত্তম ব্যবস্থা-টা সহজেই মিলে যাবে। সাথে উপরি পাবেন নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা...যদিও নিরাপত্তা জনিত কোন অসুবিধা আমার চোখে পড়েনি।
৯. বিডিআর ক্যাম্পে থাকার ব্যবস্থা না করতে পারলেও কোন অসুবিধা নেই। নিশ্চিন্ত মনে বছরের যে কোন সময় ৪ থেকে ৬ জনের গ্রুপ নিয়ে চলে যান তিন্দু, রেমাক্রি। মারমাদের বাঁশ-কাঠের বাড়ীতে অনায়াসে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে আপনাদের। মারমাদের প্রায় প্রতিটি বাড়ীতেই খুব অল্প টাকায় এমন থাকা-খাওয়ার সুবিধে রয়েছে। তিনবেলা খাওয়ার খরচ পরবে জনপ্রতি ২০০ টাকা, আর থাকা ফ্রি। তবে যে বাড়ীতে ফ্রি থাকবেন... খেতে হবে তাঁর দাওয়ায় বসেই।
১০. থানচি পর্যন্ত আপনার টেলিটক মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাবেন। তিন্দু গিয়ে আপনার মোবাইলে নেটওয়ার্ক না থাকলেও আপনি একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবেন না। মারমাদের দোকান থেকে বাঁশের উপর এ্যন্টেনা লাগানো সেট থেকে চাইলে বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন। কিন্তু রেমাক্রি পৌঁছালে আপনি একেবারেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন।
তাহলে একবার সুযোগ করে ঘুরে আসুন তিন্দু, বড়পাথর, রেমাক্রি, নাফাখুম.... উপভোগ করে আসুন ভিন্ন এক থ্রিলিং প্রকৃতি। স্যাটিসফেকশন গ্যারান্টেড!
![]()
![]()
![]()
![]()
![]()
![]()
![]()
![]()
![]()
![]()
![]()
![]()
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:০১
By নীল ভোমরা












The return to simpler times seems to be the theme of this resort. Contemporary amenities and facilities married with unspoiled nature is what you get at Mermaid Eco Resort in Cox's Bazar. And its owners, the adventurous and romantic duo Bristi and Shohag, with their infectious happy smile and awesome hospitality allow you to tuck away your worries and enjoy nature at its best - untainted and natural.

