Search This Blog
FCO Travel Advice
Bangladesh Travel Advice
AFRICA Travel Widget
Asia Travel Widget
Sunday, September 4, 2011
রূপময়ী কাপ্তাই পাহাড়-নদীর হাতছানি
Sunday, August 7, 2011
বর্ষায় বাংলার দার্জিলিং
বর্ষায় বাংলার দার্জিলিং
এত খারাপ আবহাওয়ার মাঝেও যাদের উত্সাহে আমরা এবারের গ্রীষ্মের ছুটিটা বান্দরবানে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সেই নোঙর ট্যুরিজমের কামরুল ভাই কথামত ঠিক সামনের দিকের ১৫টি সিট আমাদের জন্য আগেই বুকিং করে রেখেছিলেন। ফলে এরকম খারাপ আবহাওয়ার মাঝে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে বাসের চাকার হঠাত্ লাফিয়ে ওঠার ঝাঁকুনি থেকে সামান্য হলেও রক্ষা পাওয়া যাবে ভেবে ভালো লাগল। এরকম ভাবনার মাঝে কখন যে বাস চলতে শুরু করেছে খেয়াল করিনি। খোলা জানালা দিয়ে ফকিরাপুল থেকে কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত খানাখন্দে ভরা সড়কের জায়গায় জায়গায় হাঁটু সমান কাদাপানি কেটে বাসের ছুটে চলা দেখতে দেখতে কখন যে দু’চোখজুড়ে ঘুম চলে এসেছে খেয়াল করিনি। মাঝে দু’একবার ঘুম ভাঙলেও অন্যদের বেঘোরে ঘুমোতে দেখে খানিক জেগে থেকে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। সকালের বৃষ্টিভেজা সতেজ আলোতে যখন ঘুম ভাঙল তখন আমাদের বহনকারী বাসটি দু’পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ছুটে চলেছে। আমরা এখন কোথায়, কামরুল ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলে জানালেন, সাতকানিয়ার কেরানিহাট থেকে বান্দরবান শহরে যাওয়ার মাঝামাঝি রাস্তায়। শহরে পৌঁছতে আরও ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে।
বাস টিলা-উপটিলার মতো ছোটখাটো পাহাড় ডিঙিয়ে ছুটে চলছে। হঠাত্ অঝোরে বৃষ্টি নামল। খানিক বাদে চালকের গিয়ার পরিবর্তনের শব্দে সামনে তাকালাম। দেখলাম সামনের রাস্তা আকাশ ছুঁয়েছে। পাহাড় বেয়ে নামা বৃষ্টির পানি তীব্রবেগে সোজা বাসের দিকে ছুটে আসছে। চালকের একটু ভুল ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ পরিণতি। ভেজা সড়ক থেকে চাকা পিছলে সোজা কয়েকশ’ ফুট নিচে... ভাবতেই মেরুদণ্ডের মাঝখান দিয়ে শীতল রক্তস্রোত বয়ে গেল। তবে চালক বেশ সতর্ক। দক্ষ হাতে কয়েক মিনিটের মধ্যে গাড়ি পাহাড় চূড়ায় নিয়ে পৌঁছলেন। চূড়ায় পৌঁছতেই চারপাশের প্রকৃতি বেশ পরিচিত লাগল। বাম পাশে মেঘলা পর্যটন মোটেলকে পেছনে ফেলে বাস যখন আরেকটু উপরে উঠল, তখন বুঝতে বাকি রইল না এটা কোন জায়গা। আমরা মেঘলা পাহাড়ের উপর। বান্দরবান ভ্রমণকারীদের অন্যতম পছন্দের জায়গা। এ পাহাড় চূড়ায় রয়েছে অনিন্দ্য সুন্দর মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স, যা সারা বছরই পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত থাকে। বান্দরবান বেড়াতে এসে কেউ এর সৌন্দর্য না দেখে ফেরেন না। এর আসল সৌন্দর্য পাহাড়ঘেরা সর্পিলাকার স্বচ্ছ পানির লেক ও দু’টি ঝুলন্ত ব্রিজ। অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে ব্রিজ দুটির কাছাকাছি যেতে হয়। ব্রিজ পার হওয়া অনেক আনন্দের। পাশে প্রিয়জন থাকলে কথা নেই, তার হাতে হাত রেখে যখন ওপারে চলবেন তখন স্মৃতির ফ্রেমে বাসা বাঁধবে নানা বর্ণের স্বর্গীয় সুখের অনুভূতি।
বান্দরবানে আমাদের দুই দিনের সংক্ষিপ্ত ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনের বিকালটা রাখা হয়েছে এই মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স দর্শনের জন্য। তাই এ নিয়ে ভাবনার বেশি সময় না দিয়ে চালক বাস নিয়ে ছুটে চললেন সোজা শহরের দিকে। মেঘলার চূড়া থেকে সমতলের দিকে তাকালে মনে হবে বিশাল এক অজগর এঁকে-বেঁকে নেমে গেছে শহরের দিকে। আসলে এটি শহরে যাওয়ার রাস্তা। মেঘলা চূড়া থেকে সবুজ বেষ্টনীর মাঝে দু’একটি দালান-কোঠায় ভরা শহরটিকে বেশ ছোটই মনে হয়। শহরের মতো বাসস্ট্যান্ডটিও বেশ ছোট। এখানে বাস থেকে নেমে কাছেই হোটেলের উদ্দেশে ছুটে চললাম আমরা। হোটেলে পৌঁছে ঝটপট নাস্তাসহ প্রয়োজনীয় কাজ সেরে শুরু হলো বান্দরবানে আমাদের এবারের ভ্রমণ।
সকালের শিডিউলে রয়েছে নীলগিরি, চিম্বুক ও পাহড়ি ঝরনা শৈলাপ্রপাত দর্শন। তিনটিই একই পথে। তবে সব শেষে নীলগিরি। ঠিক হলো সবার আগে নীলগিরি, ফিরতি পথে বাকি দু’টি দর্শন। পরিকল্পনামত সাড়ে নয়টার দিকে চান্দের গাড়িতে চড়ে বসলাম। পাহাড়ের কোলঘেঁষে বহু চড়াই-উতরাই, ছড়া-ঝরনা পেছনে ফেলে ছুটে চললাম নীলগিরির অপার সৌন্দর্যের টানে। দু’পাশের সবুজ ছাউনি আর দূর-বহুদূরে পাহাড়ের চূড়ায় খেলা করা মেঘেদের মেলা দেখছিলম বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে। হঠাত্ বাঁয়ে পাহাড়ি নদ সাঙ্গুর মাথার ওপর কোথা থেকে যেন একদলা কালোমেঘ এসে জমাট বেঁধেছে। বুঝতে বাকি রইল না কী হতে চলেছে। মেঘ ফুঁড়ে শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। বলা নেই কওয়া নেই, খানিক বাদে সেই বৃষ্টি ধেয়ে এসে পাহাড়ের উপর আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে গেল। এই হলো বর্ষায় বান্দরবানের রূপ। এই রোদ, এই বৃষ্টি। রোদ-বৃষ্টির এরকম বিচিত্র খেলা আর সাঙ্গু নদের চোখজুড়ানো সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের নীলগিরিতে, যেখানে পাহাড় ছুঁয়েছে আকাশকে। মনে পড়ল কবিগুরুর সেই বিখ্যাত কবিতার কথা—
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।
ভূমি থেকে নীলগিরির উচ্চতা ৩ হাজার ফুট। উচ্চতার কারণে বর্ষায় বান্দরবান বেড়ানোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা এই নীলগিরি। এর চারপাশে মেঘেরা খেলা করে। যারা প্রকৃতির এই খেলা খুব কাছে থেকে দেখতে চান তারা একটা রাত থেকে যেতে পারেন সেনাবাহিনী পরিচালিত কটেজে। এর পাশে খাবারের জন্য রয়েছে ভালোমানের রেস্টুরেন্ট। এখানে বসে পেট পুরে খেতে খেতে ডানে-বাঁয়ে চোখ বুলালে দূর-বহুদূরে দেখতে পাবেন দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাহাড় কেওক্রাডং, পাহাড় চূড়ার বগা লেক, কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর।
নীলগিরির সৌন্দর্য লিখে শেষ করার নয়। আমাদের লক্ষ্য এবার বাংলার দার্জিলিং চিম্বুকের দিকে। শহর থেকে এর দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার। এর ২৫শ’ ফুট উচ্চতায় না উঠলে বান্দরবান ভ্রমণের মূল আনন্দই অধরা থেকে যাবে আপনার। বর্ষা মৌসুমে এর পাশ দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘ দেখে মনে হয় মেঘের স্বর্গরাজ্য। মেঘের হালকা হিম ছোঁয়া মেঘ ছোঁয়ার অনুভূতি এনে দেয় মনে। পর্যাপ্ত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত ও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ আরও উন্নত করা গেলে চুম্বকের সৌন্দর্য ভারতের দার্জিলিংয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম হতো না মনে করেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। তাই একে তারা বাংলার দার্জিলিং বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আমরা এর চূড়ায় পৌঁছে ম্রোদের হাতে তৈরি এক কাপ চা খেয়ে নিজেকে চাঙ্গা করে ফের হোটেল অভিমুখে রওনা দিলাম। পথে পাহাড়ি ঝরনা শৈলাপ্রপাতে ১০ মিনিটের যাত্রাবিরতি। স্থানীয় কয়েক বাম উপজাতি তরুণ জানালেন, বর্ষায় শ্যাঁওলাধরা এ পাথুরে ঝরনায় নামা খুবই বিপজ্জনক।
বিকালের পুরো সময়টা আমরা হোটেল ও এর আশপাশে কাটিয়ে দিলেও বন্ধু হালিম তার নববধূকে নিয়ে এক ফাঁকে স্বর্ণমন্দির ঘুরে এলো। আমাদের মধ্যে ওরাই একমাত্র নবদম্পতি। আমরা চেয়েছিলাম ওদের নিজেদের মতো ঘোরার জন্য আলাদা একটা সময় বের করে দিতে। প্রথমে ওরা একটু ইতস্তত করলেও পড়ন্ত বিকালে আসমা ভাবীর ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি দেখে মনে হলো ওরা সময়টা ভালোই কাটিয়েছে।
দ্বিতীয় দিন রাতে আমাদের ফেরার পালা। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। নিজেদের এদিন কোনো শক্ত শিডিউলে বেঁধে রাখতে মন চাইল না। সকালের সময়টা যে যার মতো কাটিয়ে বিকালে নীলাচল ও মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স ঘুরে রাতে ঢাকার পথ ধরলাম। পেছনে রয়ে গেল বর্ষাস্নাত দু’টি দিনের সেই বিমুগ্ধ স্মৃতি। যে স্মৃতিতে বর্ষা এলে বারবার হারিয়ে যায় মন। আবার ছুটে যেতে চায় বাংলার দার্জিলিংয়ের টানে।
বান্দরবানের পথে ঢাকার ফকিরাপুল ও সায়েদাবাদ থেকে শ্যামলী, সৌদিয়া, ডলফিন পরিবহনের কয়েকটি গাড়ি রাতে ছেড়ে যায়। ভাড়া ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। যারা সেখানে যেতে যান, নিজেরা উদ্যোগী হয়ে কিংবা বেড়ানোর জন্য কোনো ভ্রমণ আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠানের প্যাকেজে নাম লেখাতে পারেন। আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়া, সাইট সিং সব ব্যবস্থাই করে এ প্রতিষ্ঠানগুলো। নোঙর ট্যুরিজম এ ধরনের একটি প্যাকেজের আয়োজন করেছে।
Source: Daily Amardesh
Sunday, March 20, 2011
হোয়াইকংয়ের কুদুম গুহা
হোয়াইকংয়ের কুদুম গুহা
যেতে চাইলে
ঢাকা থেকে কক্সবাজার। নিজস্ব বাহনে অথবা লিংক রোড থেকে টেকনাফের গেটলক বাসে। নামতে হবে হোয়াইকং বাজার। স্থানীয় ফাঁড়ি থেকে পুলিশ স্কট নিয়ে যেতে হবে কুদুম গুহা। জনপ্রতি সর্বমোট খরচ যাই হোক কক্সবাজারে কাঁকড়া ভাজার স্বাদ নিতে কিন্তু ভুলবেন না। পরিশেষে বলতে হয়, প্রকৃতির দান কুদুম গুহার প্রতি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি সুদৃষ্টি দেয় তাহলে দার্জিলিংয়ের রক গার্ডেনের চেয়ে আমাদের হোয়াইকংয়ের কুদুম গুহার নয়ন জুড়ানো অপার সৌন্দর্যের প্রাকৃতিক দৃশ্য কোনো অংশে কম হবে কি?
Source: Daily Amardesh
নাইক্ষ্যংকে চিনি বহুদিনের। মূলত বন্যপ্রাণীর টানেই ভবঘুরের মতো বারবার ছুটে যাওয়া হয় সেখানে। বন্যহাতি, প্যারাইল্লা বানর আর সাম্বার হরিণের জন্য সবাই নাইক্ষ্যংকে আলাদা করে চেনেন। এখন বানর আর হরিণের জাতটির দেখা বেশ কষ্টকর হলেও হাতির পাল দেখা যায় সহজেই। হাতি হিংস্র আর ভয়ঙ্কর বলেই সবাই জানেন। ওই নাইক্ষ্যং-এ যাওয়া হয়েছে বহুবার। কত রকমের পথ বেয়ে যে তাকে উপভোগ করেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু যতবারই গেছি সবসময়ই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই গুহার কথা মনে পড়েছে। চক্কর দিয়েছি, পথের সন্ধান করেছি, তবে খুঁজে পাইনি। সবশেষে শেখ আইনউদ্দিনের কথার সুর ধরে চলতে থাকলাম এবং পথ শেষে ঠিকানা ঠিকই মিলল গুহাটির। বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে একটি দুর্গম পাহাড়ে বিশ্বযুদ্ধের চিহ্ন খুঁজে পেয়ে বহুদিনের দেখার স্বাদ পূরণ হলো। গুহাটি কীভাবে আজও দরজা ফাঁক করে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে মিয়ানমারের দিকে তা ভাবতেই অবাক লাগে। যুদ্ধের দাবানল যখন তুঙ্গে তখন মিয়ানমারের দিক থেকে এক্সিস বাহিনী বাংলার সীমানার দিকে ধেয়ে আসছিল। জার্মানি, ইতালি, জাপানিজসহ অন্যরা এ দলে ছিল। এর আগে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইনের মতো আরও কিছু দেশ এ বাহিনীর কাছে ধরাশায়ী হয়েছিল। সেসময় ভারতবর্ষজুড়ে ব্রিটিশ বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করলেও তাদের সঙ্গে ইউএসএসহ অন্য মিত্ররা মিলে স্পেশাল অ্যালাইড বাহিনী গঠন করেছিল। এক্সিস বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের ভয়ে পাহাড়ি এলাকার অ্যালাইড গ্রুপ নাইক্ষ্যং পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। মিয়ানমারের দিক থেকে নাইক্ষ্যংয়ের দিকে ছুটে আসা এক্সিস সৈনিকদের সামনে তখন শুধুই ছিল নাফ নদী। ঠিক এমন সময় আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা মেরে যুদ্ধের মোড় পুরো ঘুরিয়ে দেয়। যুদ্ধ চলে যায় অ্যালাইডদের হাতে। নাফ থেকে পিছু হঠতে থাকে এক্সিস বাহিনী। এ সময় অ্যালাইডের সৈন্যরা নাইক্ষ্যংয়ের গুহার ভেতর থেকে মুখ খুলে গর্জন ছাড়ে। জয় হয় নাইক্ষ্যংয়ের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এ গুহাটি তাই পাহাড়টিকে এনে দিয়েছে বাড়তি এক মর্যাদা। নাইক্ষ্যংয়ের আশপাশের আরও দুটি আশ্চর্য আকর্ষণ হলো তৈগা চূড়া ও কুদুমের গুহা। ভয়ঙ্কর কুদুম গুহার ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর রয়েছে হাজারও চামচিকার ভিড়।
নাইক্ষ্যং পাহাড়ের চূড়া স্বপ্নের মতো সুন্দর। এখন থেকে মিয়ানমারের পর্বতশ্রেণী দেখার মজা আরও আনন্দের। আর এই দুই পর্বতের মধ্য দিয়ে বেয়ে গেছে এ দেশে সবচেয়ে সুন্দর নদী নাফ। নাফের বেয়ে চলা, সাগরের সঙ্গে তার মিলন দেখলে সবাই পাগল হবেন তার রূপের মোহনায়। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো দু'দেশের জেলেরা এ নদীতে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে মিলেমিশে মাছ ধরে, দেখা হলে কুশল বিনিময় হয়। নদীতে আছে হরেক রকমের পরিযায়ী পাখি। আরও আছে গানজেজ ও ইরাবতি ডলফিনের দল। শুধু এই একটি পাহাড়কে ঘিরেই কত যে স্বপ্ন সমষ্টিবদ্ধ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
খুঁজে পাওয়া নাইক্ষ্যং পাহাড়ের। গুহার দরজায় দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের পর্বতশ্রেণী দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতো। পেয়েছিলাম। সে যুগে জয় হয়েছিল নাইক্ষ্যংয়েরই। পাহাড়টি এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, অ্যালাইড বাহিনী চলে গেছে। তৈরি হয়েছে দুটি দেশের আলাদা মানচিত্র। এখন এর একপাশের পাহারাদার বিডিআর, অন্যপাশে আছে নাসাকা বাহিনী। দু'দেশের সীমানার ভেতর চাইলেই আর কেউ ঢুকতে পারেন না। অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে, আছে আইন মেনে চলার কঠোর সিদ্ধান্ত। তবে সে যুগের আদিপ্রথা এখনও টিকে আছে পাহাড়ি বন্যহাতিদের বেলায়। তাদের কোনো পাসপোর্ট লাগে না। মাঝেমধ্যে মিয়ানমার পাহাড় থেকে হাতির পাল খাবার সন্ধানে চলে আসে নাইক্ষ্যংয়ের দিকে। একটা বিশেষ সময় পার করে আবার ফিরে যায় নিজ দেশে। বন্যপ্রাণীর মতো এই সম্প্রীতি সবার মধ্যে তৈরি হলেই কেবল যুদ্ধের মতো ক্ষতচিহ্নগুলো আর হবে না।
Source: Daily Samakal
জীববৈচিত্র্যে কক্সবাজার
জীববৈচিত্র্যে কক্সবাজার
জেলেরা গভীর সমুদ্রে গিয়ে আহরণ করে নানা প্রজাতির মাছ। এগুলোর কিছু নাম পরিচিত, আর কিছু অপরিচিত। কোরাল, রূপচাঁদা, শাপলা, চিংড়ি, ছুরি, হাঙর, জেলিশিসসহ অসংখ্য প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, পরিবেশের ইকো সিস্টেমের ভারসাম্যহীনতার কারণে অনেক মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া গভীর সমুদ্রে বড় বড় হাঙরের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় অনেক মাছ উপকূলের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এতে সাগরে মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। জেলের জালেও আর আগের মতো মাছ আসে না।
ফিশারিজ সংশ্লিষ্টরা জানান, পারস্পরিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় বঙ্গোপসাগর আগামীতে মত্স্যশূন্য হয়ে পড়তে পারে। কারণ এক সময় (১০-১৫ বছর আগে) ফিশারিঘাটে একেকটি নৌকায় ২০ থেকে ৩০ মণ নানা জাতের সামুদ্রিক মাছ আসত। বর্তমানে একটি নৌকা কয়েক মাসেও ২০ থেকে ৩০ মণ মাছ ধরতে পারে না।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, সমুদ্রজুড়ে আধুনিক ফিশিং ট্রলারের অপ্রতিরোধ্য মত্স্য আহরণের কারণে সাগর মাছশূন্য হয়ে যাচ্ছে। এসব বোট মালিক বেশিরভাগ প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাই এরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না। সমুদ্রসীমার ৪০ ফুট গভীর জলসীমার ভেতরে এসেও এসব ফিশিং বোট মাছ ধরছে। ফলে ছোট আকারের মাছগুলোও এসব ট্রলারের মাধ্যমে মেরে নিয়ে আসা হচ্ছে। বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের ফিশিং গ্রাউন্ডে ১৩০টির বেশি আধুনিক ফিশিং ট্রলার চলছে। বর্তমান সরকারের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে নামে-বেনামে আরও ২০টি ফিশিং ট্রলারের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, থাইল্যান্ডসহ বহু দেশ অত্যাধুনিক ফিশিং বোটে মাছ শিকার নিষিদ্ধ করেছে। কারণ এক সময়ে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমার ফিশিং জোনে যথেচ্ছ মত্স্য আহরণ করায় বর্তমানে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমার ফিশিং গ্রাউন্ড প্রায় মত্স্যশূন্য হয়ে পড়েছে। আধুনিক ফিশিং বোট ব্যবহার করলে যে কোনো সময় আমাদের সমুদ্রসীমা মত্স্যশূন্য হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে মত্স্য আইনের সঠিক প্রয়োগ সব ফিশিং ট্রলারের ওপর কার্যকর প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
Source: Daily Amardesh
বেড়িয়ে এলাম কক্সবাজার
- শান্ত বালক
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিনের জেলা হচ্ছে কক্সবাজার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ সমারোহ এখানে। কয়েকদিন আগে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলাম। এই ভ্রমনে কক্সবাজার সম্পর্কে যা যা জানতে পেরেছি তা সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরছি।
কক্সবাজারের যোগাযোগ ব্যাবস্হা খুব ভাল। সড়ক ও আকাশ পথে যাওয়া গেলেও রেল যোগাযোগ এখনও হয়নি। তবে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ট্রেনে গিয়ে তারপর বাসে যাওয়া যায়। তাছাড়া ঢাকা ও অন্যান্য জেলা থেকে সরাসরি বাসচলাচল করে। কক্সবাজারে রিক্সা-অটোরিক্সা সবই রয়েছে। পর্যটন এলাকা তাই তুলনামূলক ভাড়াটা একটু বেশীই। তবে চালকরা অত্যন্ত নম্র-ভদ্র, অতিথিকে যথাযথ সম্মান দিতে জানেন তাঁরা।
কক্সবাজারে থাকা-খাওয়ার সুব্যাবস্হাপনা রয়েছে। নিম্ন আয় থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত সব ধরনের মানুষের জন্য রয়েছে বিভিন্ন রেট এ আবাসিক থাকার ব্যাবস্হা। এখানে যা দেখলাম, বলতে গেলে সব হোটেলেই দরদাম করে ভাড়া ঠিক করা। কলাতলী রোডের বেশীরভাগ হোটেলের জানালা থেকেই সমুদ্র দেখা যায়।
কক্সবাজারে খাবারের দাম তুলনামূলক বেশ বেশী। প্রায় প্রতিটা আবাসিক হোটেলের সাথেই/গ্রাউন্ডে রয়েছে রেষ্টুরেন্ট। ব্যতিক্রমধর্মী কয়েকটি রেষ্টুরেন্ট রয়েছে কলাতলী মোড়ের কাছে। এগুলো উচু করে সমুদ্রের/বিচের উপর নির্মিত। এখানে বসে সমুদ্রের অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগ করার সাথে খাওয়ার মজাটাই অন্যরকম। সব রেষ্টুরেন্টে বলতে গেলে মুরগী-গরু-ইলিশ-চিংড়ি-রুঁপচাদা-লইট্যা কমন আইটেম। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের ভাজি-ভর্তা ও শুটকির আইটেমতো রয়েছেই।
মার্কেট এলাকায় প্রধান ব্যবসা হচ্ছে বার্মিক কাপড়। শহরের মার্কেট এলাকায় রাস্তার দুধার দিয়ে রয়েছে সারিসারি বার্মিজ মার্কেট। এখানে বার্মিজ বিছানার চাদর. গায়ে দেবার চাদর, ড্রেস, তোয়ালে, শীতের পোশাক ছাড়াও পাওয়া যায় বার্মিজ খাবার, শোপিচ ও রুপ সৌন্দর্যের প্রসাধন। তবে এখানে অনেক দরদাম করে জিনিস কিনতে হয়।
দর্শনীয় স্হান:
কক্সবাজারের প্রধান আকর্ষন হচ্ছে সমুদ্র সৈকত। সবচেয়ে জাঁকজমক হচ্ছে লাবনী বিচ এলাকা। পরিস্কার ঝকঝকে পরিবেশ আর নানা সুযোগ-সুবিধা রয়েছে এখানে। বিচের তীর ঘেষে রয়েছে ইজিচেয়ারে শোবার ব্যাবস্হা। চা-কফি-ডাব-মুড়ি-বাদাম সবই পাওয়া যায় এখানে কিন্তু কোন কিছু নিচে ফেলা যাবে না। এছাড়া স্পীডবোট, বিচকার, ঘোড়ায় চড়ার ব্যাবস্হা এসব তো রয়েছেই। তবে বিচে সবচেয়ে বিরক্তিকর পেশাদার ফটোগ্রাফারদের উৎপাত।
***
এছাড়া একটু দূরে ইনানী বিচের সৌন্দর্যও অবশ্যই প্রশংসনীয়। এখানে পানির মধ্যে রয়েছে বড় বড় সব পাথর। ভাটার সময় তাই উকি দেয়া পাথরই সৌন্দর্য ফুঁটিয়ে তোলে এখানকার। ইনানী বিচের লাল ডাবের স্বাদই অন্যরকম। ইনানী যাবার পথে দীর্ঘ সি-ড্রাইভ অবশ্যই মুগ্ধ করবে আপনাকে। রাস্তার একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে সুদীর্ঘ সমুদ্র সৈকত পুরোটা পথ সঙ্গ দিবে আপনাকে।
***
ইনানী বিচে যাবার পথেই দেখা মেলে হিমছড়ির। এখানে রয়েছে মনোমুগ্ধকর এক ঝর্না। সিড়ি বেয়ে অনেক উঁচু পাহাড়ে উঠে কক্সবাজারের ভিউ দেখার সুযোগ রয়েছে এখানে। সিড়ি দিয়ে উঠতে প্রথম দিকে মনে হয় এতো অল্প, পরে যেন ওঠার পথ আর শেষ হতে চায় না। অবশেষে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বিমোহিত হয়ে যেতে হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে। এছাড়াও এখানে ছোট মার্কেট ও সুন্দর করে সাজানো বিচ রয়েছে যা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষন।
***
এই পথেই রয়েছে সামুদ্রিক জীব-জন্তুর মিউজিয়াম। বেশ কিছু কমন-আনকমন জীবিত-মৃত প্রানী রয়েছে তাদের সংরক্ষনে। মিউজিয়ামটা সম্প্রসারনের কাজ চলছে।
বন্যপ্রানীদের নির্বিঘ্নে চলাফেলার মুক্ত পরিবেশ রয়েছে সাফারী পার্কে। সেখানে আমার যাওয়া হয়নি।
***
কক্সবাজারের মহেশখালী বেশ সুন্দর একটা জায়গা। এখানে খুঁজে পাওয়া যায় অন্যরকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তবে এখানকার রিক্সাচালকেরা ধান্দাবাজ। ভাড়া মিটাতে গেলে বলে আপনি খুশি হয়ে যা দিবেন তাই মাথা পেতে নেবো, কোন অসুবিধা নাই। অথচ শেষে বিপদে ফেলবে অনেক টাকা ভাড়া চেয়ে। আমার কাছে ১০০০/= চেয়েছিল আমি ৫০০/= দিয়ে তারপরও না মানায় স্হানীয় লোকদের কাছে বিচার দিয়েছিলাম এবং বিচারে রায় হলো যে, আমি যা ভাড়া দিয়েছি প্রকৃত ভাড়া তার চেয়ে অনেক অনেক কম। একদম মাঠে শুকানো তরতাজা শুটকি পাওয়া যায় এখানে। শুটকির ফিল্ড ছাড়াও এখানে রয়েছে লবনের ফিল্ড। এখানকার মিষ্টি পান অতি বিখ্যাত।
***
কক্সবাজারে বেড়াতে গেছে অথচ টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনে বেড়াতে যাননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে আমি টেকনাফ বেড়াতে গেলেও সামুদ্রিক সিগন্যাল না থাকায় সেন্টমার্টিনে যাওয়া হয়নি। টার্মিনাল থেকে সারাদিনই টেকনাফ-কক্সবাজার যাওয়া-আসার বাস রয়েছে। অনেকে মাইক্রোবাস সার্ভিসেও যাতায়াত করেন। টেকনাফ যেন প্রাকৃতিক রুপ-সৌন্দর্যের পুরোটায় কেড়ে নিয়েছে। এখানকার সমুদ্র সৈকত সম্পূর্ন নীলাভ। এতো সুন্দর তা ভাষায় প্রকাশ করে বলা যায় না। টেকনাফের আরেক সৌন্দর্য নাফ নদীতে। এখানে গেলে সুইজারল্যান্ড কিংবা নিউজিল্যান্ডের দেখা প্রাকৃতিক ছবিগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। এখানে আরও রয়েছে মনোমুগ্ধকর এক ঝর্না আর উঁচু পাহাড়ের সাথে রয়েছে বন্যপ্রানীদের অবাধ বিচরন। এই পাহাড়ে রয়েছে বন্য হাতীও।
আপনিও বেড়িয়ে আসুন কক্সবাজার, ভাল লাগবে সেটা আমি নিশ্চিত।
সর্বশেষ সম্পাদনা করেছেন শান্ত বালক (১১-১২-২০১০ ২১:৫১)
Source: http://forum.projanmo.comThursday, March 10, 2011
কাঁপতে কাঁপতে কাপ্তাই!!!
কাঁপতে কাঁপতে কাপ্তাই!!!
আমাদের সঙ্গের অস্ত্রগুলো সাদা কাপড়ে মোড়া। দেখতে অনেকটা কাফনে মোড়া লাশের মতো আকার ধারণ করেছে। শামস্ বিশ্বাস একাই সেটি কাঁধে করে নিয়ে রিকশায় চেপেছেন। পুলিশ ধরলে তাকে ধরবে। শামস্ মনে মনে উত্তরও ঠিক করে রেখেছেন। কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলবেন, ভাই এইটা একটা ইভ টিজারের লাশ। কবর দিতে যাচ্ছি কাপ্তাই!
সবকিছু ঠিকঠাক মতো কাপ্তাইগামী বাসের লাগেজ বক্সে দিয়ে আপাতত আমরা বাসে আরোহণ করতেই শুরু হলো আসল কাঁপাকাঁপি! বাসের ড্রাইভার রিখটার স্কেলের ৪ নম্বর শেকিং এম্পটিটিউড গতিতে বাস টানতে শুরু করলেন। এ পরিবহনের ড্রাইভাররা নাকি এমন স্কেলেই গাড়ি টানেন। শামস্ মন্তব্য করলেন-‘এই পরিবহনের গাড়িতে আসহাব কাহাফ কিংবা রিপ ভ্যান উইঙ্কল ঘুমাইলে হয়তো ইতিহাস অন্যরকম হইতো!’ গাড়ির ভেতরে লাইটস অফ হলো যেই মাত্র, অমনি মুন্না নিখোঁজ! অন্ধকারে তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আরেক পোচ কালি চড়াইলে যে তাকে নিগ্রো বলিয়া চালান যায়!
গাড়ি চলছে, বাসের ভেতরে বাজছে গান। বলাবাহুল্য হিন্দি। এলেমদার আলমগীর রাসেল বাসের হেলপারের উদ্দেশে বলে বসলেন, ‘ভাই বাসররাইতের গান ছাড়া আর কিছু নাই! এমনিতেই যে ভূমিকম্পের স্কেলে গাড়ি টানতে আছেন তাতে অটো মিলন হয়ে যাবেরে ভাই! এই গানের দরকার নাই!’ গান বন্ধ হলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পর শুরু হলো আর কত দিন একা থাকব....
মাঝপথে বিরতি মিলল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। সেখানে ১০ টাকা দামের পরোটা আর ষাট টাকা দামের ভাজি খেয়ে সবার ‘দশেহাল’ অবস্থা। চায়ের পরিবর্তে ‘ছা’ খেয়ে তো শামস্ বিশ্বাস এবং রক রক রকি যথাক্রমে নিতম্ব এবং ভুঁড়ির ওজন কিছুটা হালকা করে এলেন। মাহবুব মুন্নাকে নোকিয়া ১১০০ টর্চ মেরে ফের শনাক্ত করে বাসে ওঠানো হলো। সে কালো এবং ভালো ছেলের মতোই বাসে উঠে আবহাওয়ার সতর্কবাণী দিতে লাগলেন একের পর এক। যা অন্ধকার ছাপিয়ে নাকের কাছে ফকফকে সাদা হয়ে বাতাসে ভেসে রইল!
বাসের ড্রাইভার একের পর এক ওভার টেকিং করে এবং সব যাত্রীকে নির্ঘুম আতঙ্কিত একটি রাত উপহার দিয়ে পৌঁছে গেলেন কাপ্তাই। আমরা বাস থেকে জিনিসপত্র নামাতে নামাতে দেখি সুইডেন বাংলাদেশ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের বেশ কয়েকজন ছাত্র আমাদের গার্ড অব অনার এবং শেল্টার দিতে লগ গেটে দাঁড়িয়ে। অস্ত্র এবং আনুষঙ্গিক বয়ে নিয়ে তারা পৌঁছে দিলেন কাছেই বিএফআইডিসির রেস্ট হাউসে। সেখানের কেয়ারটেকার পাওয়ারফুল চশমা পরিহিত চার চোখ মিলন বড়ুয়া আমার পূর্বপরিচিত। সরকারি রেস্ট হাউসের ততোধিক সরকারি কাস্টমসে বিশেষজ্ঞ তিনি। তাকে চারবার না ডাকলে তিনি সাড়া দেন না! আমাদের বরাদ্দ রুম দেখিয়ে দিলেন মিলন। একতলার দুটো রুমের বরাদ্দ হয়েছে আমাদের। সবকিছু ভালোই কেবল পুলসিরাত পাড়ি দিয়ে বাথরুমে যেতে হয়। মানে রুমের ভেতরে একটা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে টয়লেট করতে যেতে হবে এই আরকি!
আমরা অস্ত্রের হেফাজত করে বেরুলাম নাস্তা করতে। পেটে ভূমিকম্পে নাড়িভুঁড়ি নড়ে চড়ে হয়ে গেছে। সেটাকে ঠিক করা চাই। কাপ্তাইতে ভালো খাবার হোটেল নেই বললেই চলে। ঠিক তেমনি থাকার জন্যও। ফরেস্টের রেস্ট হাউসগুলোই ভরসা। যদিও অধিকাংশ সময় তা সরকারি লোকেদের বুকিং এ থাকে। তবে আগে থেকে জানালে ব্যবস্থা হতে সময় নেয় না। বাজারে নাস্তা করতে গিয়ে ডুবো তেলে ভাজা পরোটা আর ডিম দেখে সবাই তাই খেতে চাইল। কিন্তু অর্ডার দিলেও যখন আসতে দেরি হচ্ছে, তখন আমাদের হয়ে একজন হোটেল স্টাফকে যেই ওই হা ... পো... বলে ডাক দিলেন অমনি সব হাজির। সার্ভ করতে করতে হা... পো... জানালো তার আসল নাম কুদ্দুস!
আমরা খেয়ে-দেয়েই শুক্রবারকে কাজে লাগাতে ছুটে গেলাম কাপ্তাইর বিখ্যাত বাংলাদেশের একমাত্র পানি বিদ্যুত্ প্রকল্প দেখতে। সেখানে সেনাবাহিনীর জনৈক উচ্চপদস্থ অফিসারের বদৌলতে দুটি জিপে আমরা ছুটলাম মনুষ্য সৃষ্ট কৃত্রিম কাপ্তাই বাঁধ দেখতে। ১৯৫৬ সালে তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তান সরকার আমেরিকার আর্থিক সহায়তায় এই বাঁধ নির্মাণ করে। এটির কাজ শেষ হয় ১৯৬২ সালে। প্রায় ৬৭০ মিটার দীর্ঘ বাঁধটির ১৬টি স্পিলওয়ে গেট আছে, যা প্রায় সাড়ে বাহান্নো লাখ কিউসেক পানি পরিবাহিত করে বিদ্যুত্ উত্পাদনে। বাঁধের আশপাশে ছবি তোলা বিধিবদ্ধভাবে নিষিদ্ধ। যদিও আমাদের কয়েকজন ভাবছিলাম কেন গুগল আর্থ আছে না!
কাপ্তাই লেক দেখতে ইংরেজি এইচ অক্ষরের মতো। কাপ্তাই লেকের এই বৈশিষ্ট্যের দু’টি হাতের একটি কর্ণফুলী নদী, সুভলংয়ের কাছে একটি ক্যানিওন/ফাঁকায় মিলেছে। কর্ণফুলীর একটি পুরনো অংশ, কাসালং, মাইনী, চেঙ্গি এবং রিখ্যয়ং নদীই মূলত কাপ্তাই লেকের পানির ব্যবস্থা করে। বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম লেক তৈরি হলে পানিতে ডুবে যায় হাজারো একর কৃষি জমি। লেকের পানিতে ডুবে যায় সমৃদ্ধ চাকমা রাজার বাড়ি। এই নিয়ে হাহাকার আজও নাকি প্রবহমান।
সবাই জানালো ক্লান্তি নেই। আর তাই কাপ্তাই ড্যাম থেকে ফিরে হালকা রেস্ট নিয়ে ছুটলাম চিত্মরমে। কাপ্তাই মূল শহর থেকে সামান্য দক্ষিণে ওয়াগ্গাছড়া পেরুলেই নয়নাভিরাম এই গ্রামটি। এখানেই পার্বত্য অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো বৌদ্ধ বিহার জুমল্যান্ড চিদমুরঙ ক্যায়াঙ অবস্থিত। পার্বত্য আদিবাসীদের প্রিয় বৈসাবি উত্সবে এখানে মেলাসহ নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। অনুষ্ঠানের নিমিত্তে এখানে একটি স্থায়ী বেদী আছে। সেখানে বৈসাবি উত্সবে, বৈশাখে মারমা/চাকমা মেয়েরা দল বেঁধে নাচের সঙ্গে গেয়ে ওঠে—‘মুই তোমারে লই বেরেম, তোমারে মুই সোনেম গান; হাজি হাজি নাজি নাজি, সোনেম পজ্জন নানাগান... (তোমাদের নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াব, গান শোনাবো, হেসে খেলে গান গেয়ে, তোমাদের শোনাবো রূপকথার কাহিনী)’ রেস্ট হাউসে ফিরে আসার আগে বাজার থেকে গরুর দুধের চা আর গরম গরম পিঁয়াজু খেতে ভুললাম না। রাতে সুইডেন পলিটেকনিকের অসাধারণ সুন্দর ক্যাম্পাসের মাঠে আড্ডা জমলো। আমাদের আড্ডায় দারুণ সঙ্গ দিল পূর্ণিমার চাঁদ।
এ সুযোগে অস্ত্র প্রদর্শনের স্থানটি বেছে নিলাম। মাঠের আড্ডায় সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র শুভ আমাদের শোনালো নূপুর ভাবীর কথা। তাকে নিয়ে প্রচলিত মিথটি সংবেদনশীল হওয়ায় তা অনুল্লেখই রাখলাম। নূপুর ভাবীর অস্বাভাবিক মৃত্য হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর এই ক্যাম্পাস এবং এর আশপাশের অঞ্চলে প্রায়ই রাতে সাদা শাড়ি পরা নারী দেহের চলাচল এবং নূপুরের শব্দ পাওয়া যায়! ঘটনা শুনে আমরা রেস্ট হাউসে ফিরছি এ সময় আমাদের মাঝে প্রথম নূপুরের শব্দ শুনলেন কবি ইন্দ্রজিত্ ইমন। এমনিতেই বেচারা ফেসবুকের নূপুরদের নিয়ে টানা-হেঁচড়ায় আছেন এর মাঝে কাপ্তাইয়ের নূপুর ভাবী তার আত্মায় কাপন লাগিয়ে দিয়ে গেল! নূপুর ভাবীর ভয়েই কিনা জানি না, রাতে ৬ জনে একরুমে জড়ো হয়ে সবাই মিলে কার্ড খেলতে বসেছি ওমনি শুরু হলো নূপুরের আওয়াজ, তাও যেন কাচের তৈরি! ভয়ে ভয়ে সবাই ঘুমুতে গেলাম। সকালে কেয়ারটেকার মিলন বড়ুয়া জানাল রাতে কাচের জানালা ভালো করে বন্ধ করে শুতে না হলে হনুমানেরা দলবেঁধে জানালার ধারে বসে গান ধরে। হায় এই কি তবে নূপুর ভাবী মিস্ট্রি!!
শনিবার আমাদের অস্ত্র প্রদর্শনীর কথা থাকলেও ভারত-বাংলাদেশের ম্যাচের কারণে তা পিছিয়ে পরের দিন রোববার অর্থাত্ ২০ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত হয়। সকাল-সকাল তাই মাইক্রোবাস ভাড়া করে কাপ্তাই রাঙামাটির অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য সংবলিত বাইপাস সড়ক হয়ে রাঙামাটি ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম।
বাইপাস ঝাগড়াবিল বড়াদম সড়কের প্রতিটি পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অসাধারণ এক পাহাড়ি সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্য গিলে খেতে খেতে চলেছি। মাঝে মাঝে চলা থামিয়ে সেইসব অসাধারণ সুন্দরকে সাধারণ ক্যামেরায় ধরে রাখার অতি আন্তরিক চেষ্টা। রকি’তো পা ছড়িয়ে বসে গেল রাস্তার ওপর। তাকে অনুসরণ করে অন্যরা। আওলাদপাড়ায় ঢোকার মুখে ব্রিজে সেকি উল্লাস সবার। গাড়িতে গান বাজছে-ন চাং যেবার এ জাগান ছাড়ি, ইদু আগং জনমান পুরি, এ জাগাগান রইয়েদে। ম মানান জুড়ি। (এদেশ ছেড়ে আমি যেতে চাই না, এখানে আমি রয়েছি সারা জনম ধরে, এ আবাস ভূমিতেই, আমার মনপ্রাণ মিলেছে এখানে, ঠিক এখানে) মাইক্রোবাস রাঙামাটি শহরতলীর ভেতর দিয়ে আসামবস্তি, ভেদভেদি, কলেজগেট, বনরূপা হয়ে রাজবাড়ি ঘাটে। রাজবাড়ি ঘুরে বেড়াতে যাওয়ার আগে রাজবন বৌদ্ধ বিহার, চতুর্থমহারাজিক স্বর্গ আর কঠিন চিবরদানের স্থানটি দেখে নিলাম। সেখানে যুগ যুগ ধরে বাদাম বিক্রেতা মুসলিম এক লোকের সঙ্গে খাতির হয়ে গেল কবি ও কার্টুনিস্ট ইমনের। তার বাদাম মানুষ না বিহারের বানরগুলো খায়, তা নিয়ে এন্তার গবেষণা করে ফেলল সে।
আমাদের অনেকের ভাগ্যেই রাজার বাড়ির সেই অপরূপ আঙিনা আর জৌলুস দেখার সৌভাগ্য হবে না। গত বছর (১১ নভেম্বর ২০১০) রাজার বাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পুড়ে যাওয়ার আগে একবার ঘুরে গিয়েছিলাম। সেই সময় তোলা কয়েকটি ছবি স্মৃতি হিসেবে আমাদের গাইড ও বন্ধু অশোক চক্রবর্তীকে উপহার হিসেবে দিলাম। পুড়ে ছাই রাজবাড়ীর আঙিনায় দেখলাম জনৈক চাকমা ‘প্রবেশ নিষেধ’ লেখা একটি নোটিশ ঝুলাচ্ছেন। সেই সুযোগে রাজবাড়ির দোড়গোড়ায় সিমেন্টের সিংহের পিঠে চড়ে নিতে ভোলেনি মুন্না ও শামস্। রাজবাড়ির সামনে ফতে খাঁর কামানটি দেখে ইতিহাসের মজার বিষয়টি জানাল শামস্-শাহ সুজাউদ্দৌলা, ভাই আওরঙ্গজেবের ধাওয়া খেয়ে আরাকানের কাছে চাকমা রাজা ধামানার আশ্রিত হন। সে সময় সখ্যের নিদর্শন হিসেবে সুজার কন্যার সঙ্গে ধামানার পুত্র ধরম্যার বিয়ে দেয়া হয়। ১৬৬১-এর ধরম্যা রাজা হওয়ার পর অনেক চাকমা প্রভাবশালীরা মুসলমান নাম ধারণ করেন। যেমন জুবল খাঁ, জল্লাল খাঁ, ফতে খাঁ। আর তাই ফতে খাঁকে মুসলমান ভাবার কোনো কারণ নেই।
অশোকদা আগে থেকেই আমাদের জন্য একটি বোট ঠিক করে রেখেছিলেন। সেই বোটে রওনা হলাম অপরূপা ‘শিলার ডাক’ খ্যাত শুভলং ঝরনা দেখতে। সেই পথে যেতে মনের ভেতর থেকে কে যেন গেয়ে উঠল—‘কর্ণফুলী দুলি দুলি কদু যেবে কনা যেদুং চাং, মুই ত সমারে, মরে নেযানা।।’ (কর্ণফুলী দুলে দুলে কোথায় যাবে বলো না, আমিও যাব তোমার সাথে, আমাকে নাও না তোমার সাথে)। শুভলং ঝরনায় বৃষ্টির মতো ঝিরঝিরে পানি পড়ছে তাতে কি। আমরা ঝরনা ছুঁয়ে দেখতে উঠে গেলাম হাজার ফুট ওপরে। ভিজিয়ে নিলাম তৃপ্তিকে। থেকে বোটে ছুটলাম পর্যটনের ঝুলন্ত ব্রিজ দর্শনে। সেখানে ডারউইনের প্রতি কৃতজ্ঞতা শুভলং প্রদর্শনপূর্বক ঝুল তার ধরে টেনে টুনে ঝুলে বেশ ফটোসেশন হলো।
কাপ্তাই ফিরে রেস্ট হাউসে বিশ্রাম নিয়ে ছুটলাম আগামীকালের অস্ত্র প্রদর্শনীর জন্য প্রিন্সিপ্যাল জনাব বারী স্যারের সঙ্গে আলাপ করতে। তিনি খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে সাহায্য ও পরামর্শ দিলেন। ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টার মধ্যে আমরা আমাদের সিআরএনবির (কার্টুনিস্ট রাইটস নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ) অস্ত্র প্রদর্শনী মেলে ধরলাম ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীদের জন্য। হ্যাঁ, আমাদের আঁকা কার্টুন। ইভ টিজিং নামক সামাজিক অভিশাপের বিরুদ্ধে অন্যরকম এক অস্ত্রের প্রদর্শনী দেখল পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ের বিএসপিআই সাধারণ শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীরা। প্রদর্শনী উদ্বোধন করলেন অধ্যক্ষ। দুশো পাতার ভিজিটরস বুকে মতামতে মুহূর্তেই ভরে গেল সব পাতা। সেখানে বেলী নামের এক শিক্ষার্থী লিখেছেন—‘আপনাদের কার্টুন নামের এই অস্ত্রের আঘাতে পরাজিত হোক নারীর প্রতি সব অবিচার, সে হোক ইভ টিজিং নামের পাশবিকতা!’
কোলাহল মুখরিত যান্ত্রিক নগরীতে ফিরে এলাম আবারও, তখন ঊষার আলো ফুটছে কেবল আর মনের মধ্যে এক বুক আশায় সামাজিক সব অনাচারের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছেরা সাহস হয়ে আঁকড়ে ধরে আছে আমাদের অস্ত্রগুলোকে—আমাদের আঁকা ইভ টিজিং বিরোধী কার্টুনগুলোকে।
Source: Daily Amardesh
Tuesday, March 8, 2011
মৌয়ালদের সঙ্গে সুন্দরবন
রহস্যে ঘেরা সুন্দরবন। এ বনের একেকটি রেঞ্জ পর্যটকদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আমেজে ধরা দেয়। জালের মতো বিছানো লবণাক্ত নদী আর খালের পাড়ে ঠাসবুনোট জঙ্গল। সুন্দরবনের সুন্দরী, বাইন, পশুর, গেওয়া, কেওড়া, হেতাল, কাঁকড়া, গর্জন, ধুন্দল আরো কতশত গাছ। গ্রীষ্মের শুরুতে এসব গাছে ফুল ফোটে, ঘ্রাণ ছড়ায় জঙ্গলের বাতাসে বাতাসে।
মৌমাছিরা এসব ফুল থেকে মধু নিয়ে চাক বাঁধে গাছে গাছে। গাছের ডালে জমা হয় প্রকৃতির অমূল্য দান মধু।
পশ্চিম সুন্দরবনের লাগোয়া লোকালয়ে এই মধুর উৎসকে কেন্দ্র করে লোকেরা বাস গড়েছে বহুকাল ধরে। যুগ যুগ ধরে জঙ্গলের এই মধু 'মৌয়াল' নামের এক শ্রেণীর পেশাদারের জীবিকা নির্বাহের খোরাক জুগিয়ে আসছে।
বন বিভাগ তিন মাসের জন্য মৌয়ালদের বনের ভেতরে ঢুকে মধু সংগ্রহের অনুমতি দিয়ে থাকে। সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জ কার্যালয় থেকে মেলে এ অনুমতি। পয়লা এপ্রিল যাত্রা শুরুর আগে মৌয়ালদের বনের রাজস্ব আদায়সহ কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই নৌকা ছুটাতে হয় বনের উদ্দেশে। যাত্রার শুরুতে একটি প্রার্থনা সভার মাধ্যমে মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ শেষে নিরাপদে ফিরে আসার আকুতি জানান উপরওয়ালার কাছে। প্রার্থনা শেষে প্রত্যেক মৌয়ালের হাতে বেঁধে দেওয়া হয় লাল কাপড়। তাদের বিশ্বাস, এ কাপড় বিপদ-আপদ বিশেষ করে বনের রাজার হাত থেকে রক্ষা করবে তাদের। প্রার্থনা শেষে মৌয়ালরা তাদের নৌকা নিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে অপেক্ষা করেন। বন কর্মকর্তা আকাশে গুলি ছোঁড়েন, মৌয়ালরা জোরসে বৈঠায় হাত লাগান। কার আগে কে পেঁৗছুতে পারেন বনের পানে। লোনা পানি কেটে বৈঠা টানেন জোরেসোরে।
সাত থেকে তেরজন মৌয়াল থাকেন সাধারণত একেকটি দলে। বনে পৌঁছে একজনকে নৌকা পাহারায় রেখে সবাই ঢুকে পড়েন ভেতরে। গামছা দিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে নেন হুল ফোটার ভয়ে। মৌয়ালদের চোখ থাকে গাছে, গাছের ডালে ডালে। সবাই-ই ডালে ডালে খুঁজে ফেরেন মধু ভরা মৌচাক। তবে, চাক ভাঙার সিদ্ধান্তটি নেন দলনেতা, মৌয়ালরা যাকে বলেন বহরদার। সবার হাতে দা, ধামা। বহরদার অভিজ্ঞ মৌয়াল। বাতাসের গতি ও মৌমাছির উপস্থিতি ইত্যাদি লক্ষ্য করে মৌচাকের অবস্থান খুঁজে বের করেন তিনি। সাধারণত তারা মৌচাকের অস্তিত্ব টের পান গাছের পাতায় মৌমাছির মল কিংবা মৌমাছির উড়াউড়ি দেখে। বহরদারের অনুমতি মিললে গাছে চড়ে মৌচাকে আগুনের ধোঁয়া দেন একজন, একজন দা দিয়ে কাটেন চাক, নিচে বেতের তৈরি ধামা পেতে কাটা চাক ধরেন অরেকজন। এভাবেই জঙ্গলে জঙ্গলে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন মৌয়ালরা। সারা দিনের সংগ্রহ নিয়ে সন্ধ্যায় নৌকায় ফেরেন তারা। মাটির বড় মটকিতে পুরে ফেলেন দিন শেষের সংগ্রহ।
মৌয়ালদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সুন্দরবনের ভেতরে এসব রোমাঞ্চকর মধু সংগ্রহের দৃশ্য দেখার ব্যবস্থা করেছে বেসরকারী ভ্রমণ সংস্থা বেঙ্গল টু্যরস। সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে মৌয়ালদের মধু সংগ্রহ দেখতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন অভিজ্ঞ এ ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে। প্রতিবছরের মতো এবারও বেঙ্গল টু্যরস মধু সংগ্রহের বিশেষ প্যাকেজের ব্যবস্থা করেছে। যে কেউ তাই কাছে থেকে দেখে আসতে পারেন সুন্দরবনের মৌয়ালদের জীবনযাপন ও মধু সংগ্রহের রোমাঞ্চকর সব দৃশ্য। ৩১ মার্চ থেকে শুরু হবে এ ভ্রমণ। ৪ রাত ৩ দিনের এ প্যাকেজে জনপ্রতি খরচ হবে ৮ হাজার ৫০০ টাকা, বিদেশিদের জন্যে ১০ হাজার ৫০০ টাকা। ঢাকা থেকে তাপনিয়ন্ত্রিত বাসে করে সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালিনী। সেখান থেকে বেঙ্গলের নিজস্ব জলযানে চেপে পশ্চিম সুন্দরবনের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো আর মধু সংগ্রহ দেখা। যোগাযোগ :বাড়ি-৪৫, রোড-২৭, বস্নক-এ, বনানি, ঢাকা। ফোন :৮৮৫৭৪২৪, ৮৮৩৪৭১৬।
কিছু তথ্য
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের জন্য সাধারণত মৌয়ালরা প্রতিবারে পনের দিনের অনুমতি পান। সুন্দরবনের সবচেয়ে ভালো মানের মধু হলো খোলসী ফুলের 'পদ্ম মধু'। মানের দিক থেকে এরপরেই গরান ও গর্জন ফুলের 'বালিহার মধু'। মৌসুমের একেবারে শেষে আসা কেওড়া ও গেওয়া ফুলের মধু অপেক্ষাকৃত কম সুস্বাদু। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে ঐতিহ্যবাহী মৌয়াল পেশা এখন হুমকির মুখে। আরো আছে নানারকম সাপ আর বাঘের ভয়। প্রতিবছর গড়ে আট থেকে দশজন মৌয়াল বাঘের আক্রমণের শিকার হন। মৌয়ালরা তাদের সংগৃহীত মধু বিক্রির পসরা সাজান সাতক্ষীরার গাবুরা গ্রামে। খাঁটি মধু চেনার সহজ উপায় হলো, এক টুকরা কাপড় কিংবা কাগজ মধুতে ডুবিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেখা। মধু ভেজানো কাপড় টুকরা ভালোভাবে জ্বললে মধু খাঁটি, না জ্বললে ভেজাল।
Sunday, February 20, 2011
বে ড়া নো : ভ্রমণের আনন্দ জনবিহীন ছেঁড়াদ্বীপ
বে ড়া নো : ভ্রমণের আনন্দ জনবিহীন ছেঁড়াদ্বীপ
মায়াবী প্রশান্তির খোঁজে দুই রাত তিন দিন কর্মহীন ভ্রমণবিলাসী জীবন ধারণ করেছিলাম গত ১৯ জানুয়ারি ভোরবেলা থেকে। উদ্দেশ্য কক্সবাজার, পেঁচার দ্বীপ, ইনানী, মহেষখালী, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন ও ছেঁড়াদ্বীপ। সঙ্গে ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কেএম আবু বাকের ও পরিজন, ডা. কামরুজ্জামান ও পরিবার, ডা. সজিদ খান ও পরিবার এবং আমার স্ত্রী মিত্রা দেব এবং আমাদের সন্তান ত্রিয়মা রায়। এর আগেও এসব স্থান ভ্রমণ এবং পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু এবারেরটা ভিন্ন আঙ্গিকে, খোশ মেজাজে, শ্বেতশুভ্র অবস্থানে। তিন দিন দুই রাতের কর্মপরিকল্পনা এবং পরিভ্রমণ ঠিকানার বিস্তারিত প্যাকেজ চূড়ান্ত হয়েছিল চট্টগ্রামে বসে। পর্যটক আকর্ষণের দীনতা, দুর্বলতা এবং পেশাদারিত্বের সীমাহীন অব্যবস্থাপনার দৃশ্য পীড়াদায়ক লেগেছে। যদিও আমরা ছিলাম শতভাগ নিশ্চয়তা আর আন্তরিক আতিথেয়তার সুগভীর অবস্থানে। কক্সবাজারে আমাদের ভ্রমণকে আনন্দদায়ক নির্ঝঞ্ঝাট প্রফুল্লময় করেছে সেখানকার সিআইপি আনোয়ার ভাইয়ের কল্যাণে। বিলাসবহুল গাড়ির আয়োজনে পরদিন ভোরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাইক্রো আমাদের পৌঁছে দেয় টেকনাফের কেয়ারি ঘাটে। শীতের ভোরের চাদর ঢাকা হালকা কুয়াশা পাহাড়ি রাস্তার মায়াবী পরিবেশে মোহাবিষ্ট না হয়ে পারা যায় না। আমদানি সিদ্ধান্তের কারণে ক্রম বিলুপ্তির পথে টেকনাফের ঐতিহ্যবাহী লবণ চাষ প্রক্রিয়ার শ্রীহীন মলিন স্তূপাকৃত অপরিশোধিত লবণ প্রত্যক্ষ করে ব্যথিত হলাম। স্বচোখে দেখলাম আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বেড়াজালে জড়িয়ে আমাদের ঐতিহ্যময় শিল্পের ধ্বংস প্রক্রিয়া। যেমনটা হয়েছে পাট, চামড়া, চা ও লবণ।
সপ্তাহান্ত ছাড়াও কেয়ারিঘাটে পর্যটকের উত্ফুল্ল ভিড় দেখে প্রফুল্ল হলাম। নতুন সংযোজিত বিলাসবহুল কেয়ারি ক্রুজে উঠে মনোপীড়ার কারণ হলো, এত বড় জাহাজে আমরা মাত্র ১৫-১৬ জন যাত্রী। অবশ্য তাদের প্রচারণা এবং খরচাধিক্য অন্যতম কারণ বলে জানানো হলো। সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্য জাহাজ ছাড়ার অল্প সময়ের মধ্যেই টের পেলাম কেয়ারি ক্রুজের আসল রহস্য। সাধারণ মানের এক কাপ চা ৫২ টাকা। কি সাংঘাতিক! অবশ্য ম্যানেজার মাহাতাব সাবেরের যৌক্তিক বর্ণনা আমাকেও ভাবিয়ে তুলল।
সত্তর দশকের শেষ প্রান্তে ইউনিয়ন মর্যাদা পাওয়া রত্নাকার বঙ্গোপসাগরের সর্বদক্ষিণ প্রান্তে মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করা ৭ বর্গ কিলোমিটারের সাগরকন্যা সেন্টমার্টিনে যখন পৌঁছলাম, তখন সূর্যিমামা ঠিক মাথার মাঝখানে, দুপুর ১২টা।
টেকনাফের মূল ভূখণ্ড থেকে ৪৫ কিলোমিটার সাগর অভ্যন্তরে সাড়ে সাত হাজার মানুষের ভারাক্রান্ত পদভারে ন্যূব্জ ৫ হাজার বছরের ইতিহাস জানা নীলাভ দ্বীপ ‘সেন্টমার্টিন’। ব্লু মেরিন রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের স্বপ্নিল আতিথেয়তা, সুন্দরী আর উড়ন্ত মাছের স্বাদ গ্রহণের মধ্য দিয়ে পার হলো আমাদের দলের দুপুরটি। হুমায়ূন আহম্মদের ‘সমুদ্র বিলাস’ সেন্টমার্টিনকে দিয়েছে আলাদা প্রচারণা, নতুন করে প্রেরণা। ঘটনাও তাই দেখলাম। এর আগে সমুদ্র বিলাসকে দেখেছিলাম ভঙ্গুর, ক্ষয়িষ্ণু, নিষ্প্রভ। আজ এখানে কয়েকটি কটেজ বাঁশ, কাঠ, খড়, টিন আর মাচানের মাতামাতি। কাজ চলছে দ্রুতলয়ে, রাতারাতি। নোয়াখালী, চট্টগ্রাম আর মিয়ানমার ভাষার সংমিশ্রণে শ্রমিকরা জানাল ব্যবসাবান্ধব কার্যক্রমের উদ্বোধনও খুব সন্নিকটে।
আড়াই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের, দেড় কিলোমিটার প্রস্থের পুরো সেন্টমার্টিনকে পায়ে হেঁটে পরিভ্রমণ করা যায় ২ ঘণ্টা সময়ে। আমরা সে রকম যাত্রায় না গিয়ে রিকশাভ্যান সঙ্গী করলাম। পরিবেশ দফতরের নয়নাভিরাম অবকাঠামো থাকলেও সতর্ক ও সচেতনতামূলক কয়েকটা সাইনবোর্ড ছাড়া তেমন কোনো জোরালো কাজ চোখে পড়ল না। নীল সমুদ্র, নীলদিগন্ত, নীলাকাশ, নীলাচল ইত্যাদি নামীয় রিসোর্টগুলো এর আগে বাঁশ, বেত, কাঠের সুদৃশ্য মিলন দেখেছিলাম। এখন আইন বিরুদ্ধ ইট, লৌহ কংক্রিটের সংমিশ্রণে রীতিমত প্রাসাদোপম।
সরকার নির্ধারিত সুনির্দিষ্ট তারিখের যে পাঁচ মাস সেন্টমার্টিন ভ্রমণের সুযোগ থাকে, তাতে পূর্ণিমা থাকে কয় দিন? সেদিন ছিল পূর্ণিমা, আলোকিত জোত্স্না রাত। আয়োজন হলো বারবি কিউর। আমরা মিশে গেলাম ওখানে অবস্থান নেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকমণ্ডলীর আয়োজনে। হলো কবিতা, গান, বক্তৃতা, অভিজ্ঞতার আলোচনা। ভাটার টানে গর্জনহীন নীল সমুদ্রের দিগন্ত জোড়া বিশাল জলরাশির ওপর যখন পূর্ণিমার নিষ্পাপ আলোকিত ছায়া পড়েছিল, সে দৃশ্য কেবলই দেখার, অনুভবের, উপলব্ধির; কিন্তু প্রকাশের নয়। আমরা বীচ এলাকায় আয়োজন করলাম স্থানীয় শিল্পী আবদুলের গম্ভীরা গানের আসর। খমক, জুরি, ঢোলক আর দোতারার সমন্বয়হীন বাদন, আঞ্চলিক উচ্চারণ, অর্থ উদ্ধার না করতে পারা গীতের সুর ঝংকারও আমাদের নির্ঘুম রাত যাপনে উদ্বুদ্ধ করেছে। তিন বছর যাবত্ নিধনহীন কুকুরের বিশালাকার দলবদ্ধ উদ্দেশ্যহীন ঘেউ ঘেউর মধ্যেও স্মৃতিময় জোছনালোক অবলোকনে রাত ৩টা, কখনও বাজে অনুভব করতে কষ্ট হয়েছে।
পরদিন ভোরে ইঞ্জিন নৌকায় করে ২৫ মিনিট সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম মনুষ্যহীন ছেঁড়াদ্বীপে। ব্রিটিশ সরকার মিয়ানমার আর বাংলাদেশ সীমান্ত পিলার গেড়েছিল ওখানে। ধ্বংসাবশেষ এখনও দেশ দুটিকে আলাদা মর্যাদা দিয়ে থাকে। ছেঁড়াদ্বীপ মূলত মূল সেন্টমার্টিনের অখণ্ড রূপ। চামচের মতো এর লেজ সংযুক্ত সেন্টমার্টিনের সঙ্গে। ভাটার সময় পরিষ্কার হয়ে ওঠে লেজ। মূল অংশ থেকে ছিঁড়ে গেছে বলেই ছেঁড়াদ্বীপ। কয়েক বিঘার এ দ্বীপের চার পাশে রয়েছে সমুদ্রের নানা প্রজাতির জীবন্ত প্রবাল। পরিষ্কার নীল জলের গভীর তলদেশে সামুদ্রিক প্রাণীর মায়াময় কোলাকুলি, দুঃসাহসিক ভ্রমণের সার্থকতা এনে দেয়।
আমরা কথা বললাম পরীর মতো অবস্থান করা দ্বীপের পাহাড়াদার একমাত্র পরিবার হোসান আলীর সঙ্গে। দুই মেয়ে চার ছেলের সংসারের সব কিছু আসে সেন্টমার্টিন থেকে। ছেঁড়াদ্বীপে মনুষ্য খাদ্যতালিকার কোনো কিছুই নেই। চাষাবাদও সম্ভব নয়। কেবলই প্রবাল আর প্রবাল। এত বড় সংসার হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করতে হোসান আলী লজ্জাবনত হাসিতে বললেন, ওঁনার দাদা মিয়ানমারের লোক। বলেছিল কোনটা আলী হবে আর কোনটা অলি হবে কেউ জানে না। কিন্তু হোসান আলী এতদিনে উপলব্ধি করেছেন তার সন্তানরা কেউ আলীও হয়নি, কেউ অলিও হয়নি। তিনি ভুল করেছেন। আমি সেন্টমার্টিনের ১০ শয্যা হাসপাতালের একমাত্র চিকিত্সক ডা. সুমনের ঠিকানা দিলাম। আগের দিন প্রাণময় জোছনা রাতে ডা. সুমনের সঙ্গে দ্বীপসংক্রান্ত বিশেষ তথ্যবহুল মজাদার আলোচনা হয়েছিল। জন্মনিয়ন্ত্রণ থেকে যাবতীয় চিকিত্সা ও ওষুধ সংগ্রহের সুযোগ নিতে হোসান আলীকে অনুরোধ করলাম। সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের দীর্ঘকালের নির্বাচিত চেয়ারম্যান মাওলানা ফিরোজ আলমের সঙ্গে যখন কথা হয়েছিল, তখন তিনি জনসংখ্যার অতিদ্রুত বর্ধনশীলতা সেন্টমার্টিনের জন্য হুমকি বলে মন্তব্য করেছিলেন। ৬৫০ জন ভোটার দিয়ে ৩ দশক আগে ইউনিয়নের যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল। বর্তমানে ২৮০০ ভোটার। ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশু রয়েছে ২৩০০। এমন ঘটনাও চলমান যে ১৫টি বিবাহ ৭ স্ত্রীর একত্র সংসার ২৪ সন্তান নিয়ে এক পরিবার। হোসান আলীর সঙ্গে কথা বলে এর রূঢ় সত্যতার বাস্তব মিল খুঁজে পেয়ে বিমর্ষিত হলাম। উপলব্ধি করলাম ব্যক্তি, সমাজ এবং সরকারের সব অর্জন, বিসর্জন হবে, যদি না জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়। সোলার প্যানেল বাধ্যতামূলক নয়, রাত ১১টা পর্যন্ত বিশালাকার সব জেনারেটরের গোঙ্গানি আর কম্পন সেন্টমার্টিনের অবস্থা অনেক আগেই নিয়ন্ত্রণহীন পাগলা ষাঁড়ের মতো। ছেঁড়াদ্বীপের জীবন্ত প্রবালের সঙ্গে মুখোমুখি আর স্মৃতিপূর্ণ কোলাকুলির পর আমরা বিষণ্ন চিত্তে রওনা হলাম আমাদের ফিরতি গন্তব্যে, আমাদের জীবনচক্রে।
সমুদ্রের সঙ্গে সূর্যের মিতালি দেখতে কার না ভালো লাগে। অনেকে এ মিতালি দেখতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। সমুদ্র আর সূর্যের আলিঙ্গন দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন পর্যটকরা। ভূমির প্রকৃতি ও আকৃতির কারণে বাংলাদেশকে বলা হয় বদ্বীপ। এ বদ্বীপ সদৃশ বাংলাদেশেই আছে দেখার মতো অনেক কিছু। এ দেশের বন-জঙ্গল পাহাড় আর সমুদ্রের সৌন্দর্য দেখে থমকে দাঁড়াতে হয় যে কোন পর্যটককে। আরএ সৌন্দর্য দেখতে প্রতিবছর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক ভিড় জমায় বাংলাদেশে। বলছিলাম সূর্য আর সমুদ্রের আলিঙ্গনের কথা। বাংলাদেশের ছেঁড়াদ্বীপে গেলে আপনি দেখতে পাবেন আলিঙ্গনের সেই সন্ধিক্ষণ। প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই ছেঁড়াদ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের গা ঘেঁষে জেগে উঠেছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। আর সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে অবস্থিত ছেঁড়াদ্বীপ। স্থানীয়রা ছেঁড়াদ্বীপকে সেন্টমার্টিনের লেজ বলে থাকেন। তবে ছেঁড়াদ্বীপকে সেন্টমার্টিনের লেজ বললেও সাম্প্রতিক সময়ে ছেঁড়াদ্বীপ সেন্টমার্টিন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যে কারণে ছেঁড়াদ্বীপের সৌন্দর্য বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। গভীর সমুদ্রের জলরাশির মধ্যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসেবে এর সৌন্দর্য অন্যরকম। যেন সুন্দর কোন মুখশ্রীর কপালের মাঝে জেগে থাকা টিপ। সুন্দর তবে সৌন্দর্য প্রকাশের ধরনটা একটু ভিন্ন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট দ্বীপ হলো ছেঁড়াদ্বীপ। অনেকে ছেঁড়াদ্বীপকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের অংশ মনে করলেও আসলে ছেঁড়াদ্বীপ একটি প্রবাল দ্বীপ। সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রাণীর অস্তিত্ব থাকলেও ছেঁড়াদ্বীপে প্রবাল ও পলি মাটির ওপর জেগে ওঠা সবুজের সমারোহ ছাড়া আর কিছু নেই। তবে এ সবুজের সমারোহই ছেঁড়াদ্বীপকে দিয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। ভাটার সময় সামুদ্রিক কাঁকড়া ফেরে আপন আলয়ে। তাই বলা যায়, সামুদ্রিক কাঁকড়া ও ছোট প্রজাতির মাছদের বেড়ানোর জায়গা ছেঁড়াদ্বীপ। জোয়ার-ভাটার মধ্যবর্তী সময় এখানে বেড়াতে আসে দেশি-বিদেশি অসংখ্য পর্যটক। তখন সমুদ্রের অতিথিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের একটা সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে। সামুদ্রিক প্রাণীদের সঙ্গে দুষ্টুমি করতে করতে কখন যে সময় পার হয়ে যাবে তা বুঝতেও পারা যায় না। ছেঁড়াদ্বীপের প্রবালের সৌন্দর্য দেখে অনেকেই অভিভূত হয়ে পড়েন। প্রবালকে অনেকে সামদ্রিক জীব, কেউ কেউ আবার সামুদ্রিক উদ্ভিদ বলে থাকেন। স্তরে স্তরে সাজানো প্রবালের সঙ্গে প্রবালের নিবিড়তম সম্পর্ক ইচ্ছে করলেই ক্যামেরাবন্দী করা সম্ভব। দেশের সবচেয়ে ছোট এ দ্বীপের যে সৌন্দর্য দেখতে পর্যটকরা ভিড় করেন, তা হলো সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত।
মূল ভূখ- থেকে ছেঁড়াদ্বীপ অনেকটা দূরে। আর তাই সূর্যোদয় দেখাটা অনেকাংশেই কঠিন। তবে সূর্যোদয় না দেখতে পারলেও সূর্যাস্তের সৌন্দর্য অবশ্যই দেখতে পাওয়া যায়। সূর্যাস্তের সময় পশ্চিমাকাশ টকটকে লাল হয়ে যায়। সেই সঙ্গে লাল রঙের আভায় ভরে ওঠে সমুদ্রের গভীর জলরাশি।
সূর্যটা আকাশ থেকে নামতে নামতে হঠাৎ করে এমনভাবে উধাও হয়ে যায় মনে হয় নিমিষেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল। মনে হবে সূর্যটা পানির নিচে ডুবে গেছে। ছেঁড়াদ্বীপে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালে জলরাশি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়বে না। সূর্যাস্তের পর গোধূলির আলোয় মূল ভূখ-ে ফিরতে হবে। তা না হলে জোয়ারের সময় বড় বড় ঢেউয়ে ভয়ের জুজু ধরে বসতে পারে।
কীভাবে যাবেন
টেকনাফ থেকে ট্রলার কিংবা সি-ট্রাকে করে সেন্টমার্টিন ঘেঁষে ছেঁড়াদ্বীপ যাওয়া যায়। যাওয়ার সময় মনে করে অবশ্যই ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা সঙ্গে নেবেন।
Source: Daily Sangbad
পাথর উত্তোলন, প্রবাল শৈবাল আহরণ চলছে:
হুমকির মুখে ছেঁড়াদ্বীপ
গত সোমবার সকালে এই দ্বীপ পরিদর্শন করে এখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন দেখে হতাশ হন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) নূর মোহাম্মদ।
দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার ব্যাপারে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে গত রোববার দুপুর সাড়ে ১২টায় আইজিপি নূর মোহাম্মদ সেন্ট মার্টিনে যান। ওই দিন বেলা তিনটা পর্যন্ত তিনি হেঁটে হেঁটে দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাথর উত্তোলন, সৈকত দখল করে দোকানপাট, বসতবাড়িসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ পরিদর্শন করেন। বিকেল পাঁচটায় তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে মতবিনিময় সভা করেন। সভায় দ্বীপের কয়েক শ মানুষ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে পাথর উত্তোলন, প্রবাল-শৈবাল আহরণ ও বিক্রি বন্ধসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষার শপথ নেয়। পরদিন সকাল ১০টায় আইজিপি সেন্ট মার্টিন থেকে কোস্টগার্ড বাহিনীর একটি স্পিডবোটে করে ছেঁড়াদ্বীপ পরিদর্শনে যান।
আইজিপি নূর মোহাম্মদ জীবনের প্রথম ছেঁড়াদ্বীপের মাটিতে পা রেখে বললেন, ‘কী সুন্দর দ্বীপ! জীবনে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আরেকবার আসার সুযোগ পাই কিনা আল্লাহ জানে।’
আইজিপির সঙ্গে ছিলেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আসাদুজ্জামান মিয়া, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসাইনসহ পুলিশ ও কোস্টগার্ডের কয়েকজন সদস্য।
দ্বীপে উঠে সবাইকে নিয়ে আইজিপি হাঁটা শুরু করেন। ২০ কদম যেতেই তাঁর সামনে পড়েন নারায়ণগঞ্জ থেকে ভ্রমণে আসা এক ব্যক্তি। তাঁর হাতে তিন টুকরো প্রবাল। আইজিপির প্রশ্নের জবাবে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘প্রবালগুলো সুন্দর লেগেছে, তাই ভেঙে সঙ্গে নিলাম।’ নূর মোহাম্মদ প্রবাল-শৈবাল, শামুক-ঝিনুক আহরণকারী এ রকম আরও কয়েকজনকে ডেকে বলেন, ‘প্রবাল-শৈবাল আহরণ ও বিপণন নিষিদ্ধ তা আপনারা জানেন না? এর কারণে যে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়, আপনারা নিশ্চয় জানেন? বাংলাদেশের সর্বশেষ ভূখণ্ডটিকে অন্তত বাঁচিয়ে রাখুন।’ এরপর লোকজন হাতে থাকা, ব্যাগে রাখা প্রবাল-শৈবালগুলো সাগরের পানিতে রেখে দেয়।
ছেঁড়াদ্বীপে পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রত্যয় নামের একটি বেসরকারি সংস্থার তিনটি সাইনবোর্ড নজরে পড়লেও এদের কাউকে দ্বীপে দেখা যায়নি। ছোট্ট দ্বীপটিও পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, ডাবের খোসায় ভরা।
সেখানকার অস্থায়ী রেস্তোরাঁর মালিক সেন্ট মার্টিনের আবদুল শুক্কুর (৪৫) জানান, স্থানীয় লোকজন প্রবাল-শৈবাল আহরণ করে না। পর্যটকেরা ফিরে যাওয়ার সময় এসব আহরণ করে নিয়ে যায়। নিষেধ করলে তারা শোনে না। ডাব বিক্রেতা সৈয়দ নূর জানান, আগে সেন্ট মার্টিনের কয়েকজন প্রভাবশালী ছেঁড়াদ্বীপ থেকে বিপুল পরিমাণ প্রবাল-শৈবাল, শামুক-ঝিনুক আহরণ করে ট্রলারযোগে কক্সবাজারে পাচার করতেন। গত রোববার থেকে তা বন্ধ রয়েছে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান জানান, দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পুলিশের এই উদ্যোগে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে এবং দায়িত্ববোধ কাজ করছে।
বিকেল সাড়ে তিনটায় ছেঁড়াদ্বীপ ত্যাগ করে সেন্ট মার্টিন থেকে টেকনাফগামী জাহাজে ওঠার সময় জেটির মাঝপথে দেখা গেল, তিন ব্যক্তি হাতমাইকে ঘোষণা করছেন, ‘সম্মানীত পর্যটকবৃন্দ। আপনাদের হাতে প্রবাল ও শৈবাল থাকলে দয়া করে এখানে রেখে যান। এসব আহরণ, সংগ্রহ, সরবরাহ একেবারে নিষিদ্ধ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।’
লোকজন ব্যাগ, প্যান্ট, জ্যাকেট ও কোটের পকেট থেকে প্রবাল-শৈবাল, শামুক-ঝিনুক বের করে জমা দিয়ে জাহাজে উঠছে। উদ্ধারকর্মী আনোয়ার হোসেন জানান, এখন থেকে প্রতিদিন জাহাজ থেকে নামার সময় পর্যটকদের এ ব্যাপারে সতর্ক করা হবে এবং ওঠার সময় তল্লাশির ব্যবস্থা চলবে।
Source: Daily Prothom Alo
Friday, February 11, 2011
পর্যটন প্যারাডাইজ কক্সবাজার
মাইলের পর মাইল সোনালী বালুকাময় বেলাভূমি। লতা-গুল্ম বন-বনানী দিয়ে সুশোভিত তরঙ্গায়িত খাড়া পাহাড়। তরঙ্গ বিধৌত ফেনাযুক্ত ঢেউ। রঙ্গিন শামুক-ঝিনুকের সম্ভার, সু-স্বাদু সামুদ্রিক খাদ্য, ১২০ কিলোমিটার পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত যা বঙ্গোপসাগরের নীল জল রাশির দিকে ক্রম ঢালু। কক্সবাজারের উত্তরে আছে চট্টগ্রাম এবং পাহাড়ি জেলা বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি, পূর্বের দিকে মায়ানমার, দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বঙ্গোপসাগর, সুসজ্জিত সমুদ্র তীর, প্রধান সড়কের দুইধারে সৌখিক দ্রব্যাদিসহ সজ্জিত দোকান, রাখাইনদের কুঁড়ে ঘর। এখানে আকাশ নীল। উচ্ছ্বসিত শিশুর মত ঢেউ খেলে যায় সাগরের বেলাভূমিতে। নারিকেলের বীথি মিতালি করে রাখাইন কিশোরীদের সাথে। পশ্চিম আকাশে আগুনে পুড়ে লাল করে ডুবে যায় দিনের সূর্য। বিদায়ী সেই লগন ব্যথাতুর করে মানব হূদয়কে । সারা রাত এইভাবে কাটিয়ে পাহাড়ের বুক চিরে ঝুটিওয়ালা মুরগীর ডিমের লাল কুসুমের মতো গোল সূর্য ওঠে আবার। সেটি আভা ছড়ায়, আকাশের গায়ে আবীর মাখায়। পাহাড়ের ঢালে লুকিয়ে থাকে ভোরের সূর্য। এ যেন এক তরুণীর না বলা অব্যক্ত গল্প গাঁথা। ঠিক এমনই ছবির মত সাজানো সাগর কন্যা কক্সবাজার।
মনে হয় স্রষ্টা আপন হাতে উপুড় করে দিয়েছেন তার সৌন্দর্য। এ যেন স্বর্গ নরকের রহস্যপুরী।
পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত ও বনভূমির নয়নাভিরাম দৃশ্য কক্সবাজারকে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। এখানে প্রতি বছর ১৫ মিলিয়ন লোক আগমন করে যার ৩% হলো বিদেশী। প্রায় দুই শত কোটি টাকা সরকারের প্রতি বছর রাজস্ব আয় হয়। পর্যটনকে কেন্দ্র করে এখানে বহুধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বহু হোটেল, মোটেল, কটেজ গড়ে উঠেছে। কক্সবাজারকে ঘিরে বিজ্ঞাপন টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকায় প্রচার হচ্ছে-নতুন নতুন সুরম্য অট্টালিকা তৈরি হচ্ছে যা কক্সবাজারকে টু্যরিস্ট প্যারাডাইজে পরিণত করেছে।
সরকারও শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে পর্যটন শিল্পকে আরও আকর্ষণীয় করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন।
পর্যটনকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারে গড়ে উঠেছে মৎস্য, গবাদি পশু ও হাঁস মুরগীর খামার। এছাড়া সীমান্ত পথে বার্মা, থাইল্যান্ড, চীন প্রভৃতি দেশ থেকে আগত বিলাস সামগ্রীর বাজার বার্মিজ মার্কেট। বার্মিজ মার্কেটে সুন্দরীদের জিনিসপত্র বিক্রি কার না দৃষ্টি কাড়ে। প্রভৃতির মাধ্যমে সরকারের আয় ছাড়াও স্থানীয়দের কর্ম সংস্থানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত করেছে। কক্সবাজারের খনিজ সম্পদের মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস, গন্ধক, জিরকন, ইলমেনাইট, ব্রুটাইল, ম্যাগিনাটাইট, সোনাজাইট, কয়নাইট প্রভৃতি উলেস্নখযোগ্য। তাছাড়া সৈকতে মূল্যবান ইউরেনিয়াম এবং ইষধপশ এড়ষফ পাওয়ার ঘটনাও ঘটছে যা আমাদের অর্থনৈতিক চাকা ঘুরাতে পারে।
একুশ শতকে বাঙালির অতীতের জ্বরা জীর্ণ অবস্থা কাটিয়ে নতুনভাবে জাগার ডাক পড়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পর্যটন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভূমিকা পালন করে চলেছে। থাইল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের বহু দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একমাত্র পথ হল পর্যটন শিল্প। নেপালের মোট রাজস্ব আয়ের প্রায় চলিস্নশ ভাগই এই খাত হতে অর্জিত হয়। পর্যটনকে বলা হয় ওহারংরনষব বীঢ়ড়ৎঃ মড়ড়ফং- বা অদৃশ্য রপ্তানি পণ্য। বাংলাদেশের মত অনেক দেশে যেখানে রপ্তানি পণ্য বই কম সেখানে কক্সবাজার এর মত সমুদ্র সৈকত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অফুরন্ত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি বেকারত্ব দূরীকরণ, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রীতি সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
[ লেখক : গবেষক]
Thursday, February 3, 2011
শরণখোলা রেঞ্জের আরণ্যক সৌন্দর্য
শরণখোলা রেঞ্জের আরণ্যক সৌন্দর্য
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য এই সুন্দরবনকে এরই মধ্যে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উপকমিটি (ইউনেস্কো) বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। সুন্দরবনকে আকর্ষণীয় করে বিশ্বের বুকে পরিচিত করে তুলতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন সুন্দরবনে পর্যটকদের নিয়ে কাজ করলেও তাদের রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। এরপরও সরকার সুন্দরবনে পর্যটনখাতে প্রতিবছর মোটা অংকের রাজস্ব আয় করছে। সরকারের সদিচ্ছা, বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ ও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় সম্ভব হলে এ খাতের রাজস্ব বেড়ে যেতে পারে কয়েকগুণ। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ হবে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।
সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির ছোট-বড় বৃক্ষ, ১৬৫ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৩ প্রজাতির পরাশ্রয়ী অর্কিড রয়েছে। সুন্দরী এ বনের প্রধানতম বৃক্ষ, যা মোট বনাঞ্চলের ৭৩ ভাগ। এছাড়া কেওড়া, বাইন, পশুর, ধুন্দল, কাঁকড়া, পশুর, গরান, হেতাল ও গোলপাতা উল্লেখযোগ্য। এ বনের ২৬৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, ১৮৬ প্রজাতির পাখি ও ২১০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। বন্যপ্রাণীর মধ্যে বিশ্বনন্দিত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী চিত্রল হরিণ, লোনাপানির ভয়ঙ্কর কুমির, বানর, শূকর ও গুইসাপ প্রধান।
এসব বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ সংরক্ষণ, বৃদ্ধি, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৭৭ সালে সুন্দরবনের ৩টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য চিহ্নিত করা হয়। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের পাশাপাশি এসব অভায়রণ্য জনসাধারণের জন্য বন্যপ্রাণীর বিচরণ পর্যবেক্ষণ ও উপভোগের জন্য উন্মুক্ত। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ও সমুদ্রের বিশাল জলরাশির কারণে সুন্দরবনের পূর্ব অভায়ারণ্য সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সুন্দরবনের এ অংশের নৈসর্গিক দৃশ্য ও ভয়াবহ নিস্তব্ধতার সঙ্গে সরকারি ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার সমন্বয়ে গড়ে উঠতে পারে পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।
এ অংশটি সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত। সমগ্র সুন্দরবনের সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় অঞ্চল কটকা ও কচিখালী নিয়ে এ অংশ গঠিত। কটকা, কচিখালী ছাড়াও শরণখোলা রেঞ্জের সুপতি, বাদামতলা, জামতলা, তিনকোনা আইল্যান্ড ও জেলে পল্লী দুবলা পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় স্থান।
কটকা : সুন্দরবন পূর্ব অভয়ারণ্যের পশ্চিমাংশে সাগর তীরে অবস্থিত কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্র। এখানকার নৈসর্গিক ও মনোরম পরিবেশ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। ঘন বনানীর ছায়ায় নির্মিত বিশ্রামাগারের বারান্দায় বসে চোখের সামনে উত্তাল সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ পর্যটকদের উচ্ছ্বসিত করে তোলে। বিকালে বিশ্রামাগারের চারপাশে হাজার হাজার চিত্রল হরিণের ছোটাছুটি, বানরের কোলাহল আর সকালে নদীর পাড়ে কুমিরের রোদ পোহানোর দৃশ্য যেন স্বপ্ন ও সত্যির অপূর্ব সমন্বয়। এখানে বিশ্রামাগার প্রান্তিকে ৪ শয্যাবিশিষ্ট ২টি কক্ষ রয়েছে। বরাদ্দপ্রাপ্তি ও রাজস্ব প্রদান সাপেক্ষ এটা ব্যবহার করা যায়।
কচিখালী : সুন্দরবনের পূর্ব অভয়ারণ্যের দক্ষিণ-পূর্বপ্রান্তে সাগর তীরে গড়ে উঠেছে কচিখালী কেন্দ্র। সুন্দরবনের ভ্রমণকারী এবং পর্যটকদের জন্য এখানে গড়ে উঠেছে একটি বড় ধরনের বিশ্রামাগার। এক শয্যাবিশিষ্ট তিনটি ও দুই শয্যাবিশিষ্ট একটি বেডরুম, ড্রইংরুম ও ডাইনিং রুমের সমন্বয়ে এ বিশ্রামাগারটি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। প্রতি শীত মৌসুম অর্থাত্ অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি এখানে কৌতূহলী পর্যটকদের ভিড় থাকে। তারা এখানকার সাগরপাড় আর ছন ক্ষেতের ভেতর খুঁজে ফেরে বহু প্রত্যাশিত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দর্শন। ঝাঁক বাঁধা চিত্রল হরিণ ছুটে বেড়িয়ে বন্ধুদের জানিয়ে দেয় পর্যটকদের আগমন বার্তা।
জামতলা : কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্রের নিকটবর্তী পর্যটকদের একটি আকর্ষণীয় স্থান জামতলা। জামতলায় রয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। যেখান থেকে বিস্তীর্ণ ছন ক্ষেতে হাজার হাজার হরিণের ছোটাছুটি, আবার কখনও রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখা যেতে পারে।
বাদামতলা : কচিখালী আর কটকার ঠিক মধ্যবর্তী স্থানের নাম বাদামতলা। বাদামতলা অত্যন্ত নির্জন এক সমুদ্র সৈকত। সেখানে আছড়ে পড়া সামুদ্রিক ঢেউ পর্যটকদের মন কেড়ে নেয়। শীতকালে বাদামতলার সৈকতে অজস্ত্র বাঘের পায়ের ছাপ দেখা যায়। কচিখালী ও জামতলা থেকে পায়ে হেঁটে বাদামতলা পৌঁছানো সম্ভব।
দুবলার চরে মত্স্যপল্লী : সাগরদ্বীপ দুবলাসহ সন্নিবেশিত ১০টি চরে মাছ আহরণের মৌসুমে ৩০ থেকে ৪০ হাজার মত্স্যজীবী ভিড় জমায়। অক্টোবরে এরা আসা শুরু করলেও নভেম্বরে রাসমেলা নামক এক ধর্মীয় উত্সবের মধ্য দিয়ে তাদের বছরের কাজ শুরু হয়। দুশ’ বছরের ঐতিহ্যলালিত এ রাস উত্সবেও দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক ও দর্শনার্থী ভিড় জমায়।
যোগাযোগ : শরণখোলা রেঞ্জের সম্ভাবনা সুন্দরবনের অপরূপ প্রকৃতি, জীববৈচিত্র, গভীর সমুদ্রের অপরূপ দৃশ্য ছাড়াও যোগাযোগ ও যাতায়াতের জন্য এ রেঞ্জ বিশেষ উপযোগী। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বাগেরহাট থেকে বাসযোগে শরণখোলা উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজারে আসতে হবে। মংলা বন্দরের তুলনায় এখানে সাশ্রয়ী ভাড়ায় বিভিন্ন ধরনের লঞ্চ ও ট্রলার ভাড়া পাওয়া যায়। আগে থেকে বনবিভাগের অনুমতি প্রাপ্তিসাপেক্ষে শরণখোলা থেকে কচিখালী ও কটকায় যেতে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় লাগে। শরণখোলা থেকে এর দূরত্ব যথাক্রমে ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার। শরণখোলা রেঞ্জের কটকা ও কচিখালীতে আরামপ্রদ বিশ্রামাগারে পর্যটকরা যেমন রাতযাপন করতে পারেন, তেমনি ইচ্ছা করলে একদিনের মধ্যে সমগ্র এলাকা ঘুরে ফিরে আসতে পারেন, যা নির্ভর করবে পর্যটকদের প্রস্তুতি ও সামর্থ্যের উপর।
প্রস্তাবনা : স্থানীয় বিশেষজ্ঞ ও পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলে শরখোলা রেঞ্জকে আকর্ষণীয় করতে বেশ কিছু প্রস্তাবনা পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে রয়েছে শরণখোলা রেঞ্জ অফিস থেকে পর্যটকদের বনে প্রবেশের রাজস্ব গ্রহণ ও অনুমতি প্রদানের ব্যবস্থা। শরণখোলা রেঞ্জভিত্তিক পর্যটকদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নিরাপদ জলযানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রস্তাবিত সাইনবোর্ড-শরণখোলা আঞ্চলিক মহাসড়কের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। বনদস্যু ও জলদস্যুদের কবল থেকে পর্যটকদের নিরাপদ রাখতে সন্নিবেশিত নিরাপদ রুট চিহ্নিত করতে হবে। নিরাপদ রুটে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সার্বক্ষণিক টহল জোরদার করতে হবে। সুন্দরবনের আকর্ষণীয় জায়গা চিহ্নিত করে পরিবেশ উপযোগী অবকাঠামো ও চিত্তবিনোদনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ রেঞ্জের উজ্জ্বলতম পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ বৃদ্ধি করতে হবে। সুপতি স্টেশনে এবং কচিখালী থেকে জামতলা পর্যন্ত উডেন ট্রেইল তৈরি করে গভীর বনে পর্যটকদের নিরাপদ পথ চলার ব্যবস্থা করতে হবে। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস বা তেরাবেকা টহল ফাঁড়ি সংলগ্ন এলাকায় মংলা করমজলের মতো টুরিস্ট স্পট স্থাপন করতে হবে। এমন অভিমত দিয়েছেন সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জভিত্তিক পর্যটন কেন্দ্রের দাবিতে আন্দোলনরত শরণখোলা উন্নয়ন ফোরামের প্রধান সমন্বয়ক, সাংবাদিক আসাদুজ্জামান মিলন।
সুন্দরবন পূর্ব-বিভাগের ডিএফও মিহির কুমার দে বলেন, বর্তমানে সুন্দরবন থেকে প্রতিবছর পর্যটন খাতে সরকার এক কোটি টাকা রাজস্ব আয় করছে। ব্যাপকভিত্তিক প্রচারণা ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারলে রাজস্ব কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে শরণখোলা রেঞ্জ হতে পারে অপার সম্ভাবনাময় এক পর্যটক কেন্দ্র।
এ ব্যাপারে শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার জহিরুল ইসলাম জানান, সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জকে পর্যটন কেন্দ্রের আওতায় আনার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তবে এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
Monday, January 31, 2011
বাহের দেশে হাঁকাও গাড়ি
এইখানে সন্ধ্যারা পাতা ঝরায় শাল-সেগুনের বনে
তবু, কোথাও উধাও হয়েছে আজ নাগরিক মননে_
নিধুয়া প্রান্তর কুয়াশার শরীরে
নতুন করে বানানো খড়ের 'ছই' বসানো এত গরুর গাড়ি যখন শাল-সেগুনের ছোট্ট বনটা ছেড়ে বের হলো অত ভোরে, তখন আমরা নিজেদের পাগলামিতে নিজেরাই মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। ফুলকপি, শিম, মটরশুঁটি ক্ষেত পার হয়ে যখন কৃষকের খোলা পার হতে চলেছে গরুর গাড়ির শোভাযাত্রা, তখন কুয়াশা ভেদ করে যেন ভেসে এল এক সম্ভাষণ : বাহে...কোন্ঠে যাছেন? বিয়াবাড়ি নাকি বাহে?ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়ছে ভোররাত থেকেই। কৃষকের উঠানে মিনারের মতো পাঁজা করা খড়ের স্তূপের আড়াল ভেদ করে শ্মশ্রুমণ্ডিত সরল এক বৃদ্ধের মুখে ফুটে উঠল নরম হাসি। অবাক বিস্ময়ে শহুরে মানুষের কাণ্ডকারখানা দেখে বুঝে উঠল না কিছুই। তাঁর প্রশ্নের তেমন কোনো জবাবও দিল না কেউ, শুধু হাসল গাড়োয়ানরা।রাতভর গান, উল্লাস আর সীমাহীন আড্ডা চলেছে গাছের গুঁড়ি জ্বালানো আগুনের পাশে গোল হয়ে। সাঁওতাল মেয়েরা কোথাও নেচেছে আজ আঁচলে মনসার ফণা তুলে, মাদল বাজিয়ে নেচেছে হাত ধরে সাঁওতাল ছেলেরা। বনকুটিরের পাশে এক ছোট্ট নদী_নাম তার নর্ত। হয়তো বা নদী সে আপন মনে নৃত্যরতা_চলেছিল এঁকেবেঁকে বনের সবুজের সঙ্গে কথা কইতে কইতে। কে গো তুমি অমন নামটি রেখেছিলে মাদলের বোলে। কাল রাতে নর্ত ঘুমাতে পারেনি হঠাৎ বহুদিন পর। বনকুটিরের সামনে গাছের নিচে আগুন জ্বালিয়ে কারা যেন জেগে আছে সারা রাত? এই বন, এই নদী ঘুমাবে কী করে আজ তাদের ঘুম না পাড়িয়ে!চলার শুরুগত বছরের শেষ দিনটিতে ঢাকা থেকে উত্তরের দেশে এসে ভোরবেলা সুপরিসর বাস থেকে নামে ২১ জনের একটি দল। এই পথ আর কিছু দূর গেলে তেঁতুলিয়ার সীমান্ত, তারপর আর কিছু দূর গেলেই হিমালয়! পৌষের মাঝামাঝি সেই হিমালয়ের হিমঝরা ভোরে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি 'সিঙড়া' বনের দুয়ারে। ছোট্ট এ বন দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলায়, বাস থেকে নামতে হয় বীরগঞ্জ পার হয়ে ছয়-সাত কিলোমিটার পর বটতলীতে। বীরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরে এ রকম বন আরো অনেক আছে। হয়তো একসময় যুক্ত ছিল সেসব বন একে অপরের সঙ্গে। এসব বনে মূলত শাল-সেগুনেরই বাড়-বাড়ন্ত। শোনা যায়, একসময় বন্য প্রাণীর বেশ আনাগোনা ছিল এখানে। এখন নানা রকম পাখি আর খরগোশ, শেয়াল, বনবেড়াল এসব। এসব বনকে কেন্দ্র করে একসময় রাজমহল পাহাড় থেকে তীর-ধনুক হাতে নেমে এসেছিল যেসব সাঁওতাল, ওঁড়াও, মুণ্ডা, রাজবংশী জনগোষ্ঠী_তাদের প্রধান জীবিকা ছিল শিকার এবং নানা কৃত্যে এই শিকারই ছিল বীরত্বের প্রতীক।দীর্ঘ বৃক্ষরাজির বুকচেরা মসৃণ পথ দিয়ে যেতে যেতে নিশ্চুপে পাখির ডাক শুনি বহু দিন পর নগরের বিদীর্ণ শব্দে অতিষ্ঠ কানে। আমাদের দলের (বিটিইএফ_বাংলাদেশ ট্যুরিজম এঙ্পানশন ফোরাম) এবারের ভ্রমণে উদ্দেশ্য ছিল দুটি : শীতার্ত মানুষের জন্য যৎসামান্য গরম কাপড় বিতরণ এবং এ জনপদে গরুর গাড়িতে চড়ে ইতিহাসের শেষ শোভাযাত্রা করা! প্রথম উদ্দেশ্য ভাগ করে নিয়েছে আমাদের উত্তরের দুই বন্ধু। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য সফল করেছে এক বন্ধুর নেতৃত্বে 'সিঙড়া' বনের পাশের গাঁয়ের বেশ কিছু মানুষ। আমাদের খুব শখ হয়েছিল গরুর গাড়ি ভ্রমণ করি! উত্তরবঙ্গে কোনো গাড়িয়াল ভাইয়ের সঙ্গে ধুধু প্রান্তর দিয়ে চলি চিলমারী বন্দর। কিন্তু হায়, আমাদের জানাই ছিল না যে এই শকটটি আজ বিলীন হতে চলেছে প্রায়! বেশ কয়েকটি উপজেলায় খোঁজ করে কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না একসঙ্গে ৮-১০টি গরুর গাড়ি। যদিও বা কোথাও দুই-তিনটি মেলে, সেগুলোর না আছে টোপর, না আছে সেই আদি কাঠের চাকা। হায়, গরুর গাড়ি চড়ে নাইওর যাওয়ার দিন যে শেষ! এখন গাঁয়ের শেষ বাড়িটির দুয়ার অবধি যে পেঁঁৗছে গেছে অটোরিকশা কিংবা রিকশাভ্যান। সময়ের হিসাবে তাকে অস্বীকার করি কিভাবে? শেষ অবধি পাওয়া গেল এইখানে, এই নর্ত নদীর গাঁয়ে, কিন্তু 'ছই' কই? ছই মানে গাড়ির ওপর যে টোপর থাকে সেই টোপর। নেই তাতে কি_ওরা খড় দিয়ে ছেয়ে, বাতা দিয়ে বেঁধে সুন্দর করে বানিয়ে দিল আটটি গাড়ির 'ছই'। ধুয়ে-মুছে খড় বিছিয়ে সাজিয়ে দিল। আর যদিও বা নামে 'গরুগাড়ি', আসলে গরুর বদলে মোষ। আগে গরুর গাড়ি টানত বলদ, তারা হালও বাইত। এখন হাল চষে পাওয়ার টিলার, কে পোষে আর বলদ! আমাদের ভ্রমণের প্রথম দিন রাতে ডিসেম্বরের শেষ সন্ধ্যায় চলে এল এসব গাড়ি। আর তারা জোয়াল নামিয়ে নতুন বছরের ভোর অবধি গোল হয়ে ঘিরে থাকল কতগুলো ছায়া-শরীর। মহিষরা ওম নিল ধিকিধিকি আগুনের অঁাঁচে।হাঁকাও গাড়ি তুই..প্রতিটি গাড়িতে তিনজন যাত্রী। সকালে আরো তিনজন ঢাকা থেকে এসে যোগ দিয়েছে দলে। গতকাল ছিল ঝকঝকে রোদ, আর আজ দার্জিলিংয়ের ওয়েদার! গরুর গাড়ির বহর একটা গাঁ পেরোতেই পথের ধারে দেখা মিলল স্কুল, লাগোয়া মাঠ, বটের ঝুরি আর বিশাল দিঘি। থামাও গাড়ি। এসে গেল শীতের পিঠা! সঙ্গে গরম ধোঁয়া ওঠা চা। চায়ের ধোঁয়া আর মুখের কুয়াশার ধোঁয়া মেলানোর খেলায় মেতে উঠল আমাদের দলের দুই নবদম্পতি তাদের নতুন জীবনের আনন্দে। গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা তাদের ঘিরে মজা দেখছে। জোয়ালে আবার মহিষ জুত, আবার চলো সামনে। এবার বসতি ছেড়ে বিরান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে পথ। দুই পাশে সরিষা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলুর ক্ষেত। সব যেন কেমন পরিপাটি, চকচকে, প্রাণবন্ত করে সাজানো। শিশিরভেজা পথ দিয়ে যেতে যেতে মনের ভেতর গান আসছে; কিন্তু শীতে জবুথবু হয়ে গলা দিয়ে আর সে গান বের হয় না।গরুর গাড়ি আবার একটা গাঁয়ে ঢুকে পড়ল, আর কোথা থেকে সব ছোট ছোট ছেলেমেয়ে পিলপিল করে বের হয়ে পিছু নিল শোভাযাত্রার। বউরা-মেয়েরা লাউয়ের মাচা থেকে উঁকি দেয়, কেউ কেউ রোয়াকে এসে মুখে অঁাঁচল ঢেকে সলজ্জ হেসে জানতে চায় কোথায় যাচ্ছি, বরযাত্রী নাকি? তবে 'কইনা কই বাহে...'। আমাদের একজন বলে, 'বাহে' মানে কী? আরে 'ভাই', ভাই হে...। আহা, এমন মধুর সম্বোধনে অন্যকে কত সহজে কাছে টানা! 'কইনা'র কথায় আমাদের মেয়েরা অকারণে লজ্জা পেয়ে পুলকিত হয়। ছেলেদেরও কেমন যেন লাগে, পাড়ার দুই পাশ থেকে অমন ভিড় করে আসা মানুষের কৌতুক দৃষ্টির অত কাছ ঘেঁষে পার হতে হতে কারো চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না, অথচ মাটির দিকেও তো আর তাকিয়ে থাকা যায় না! এবার যেন সত্যি সত্যিই নিজেদের বরযাত্রী মনে হতে লাগল। ছোটবেলায় যেমন দুই-একবার গিয়েছিলাম তেমন করে গাঁয়ের বাড়িতে, গাড়ির পেছনে পা ঝুলিয়ে আর আখ চিবাতে চিবাতে। আজ নতুন বছরের নতুন দিনটা কুয়াশার চাদরে থেকেও ঝকঝকে সোনালি আলোয় ভরে গেল!দেয়ালে দেয়ালে লাল রংযেমন সোনালি আলোর সূর্যাস্ত দেখা হলো বছরের শেষ বিকেলে গতকাল বনের পাশে সাঁওতাল গ্রামে। তাদের বাড়ি নিকানো হয়েছে গেরুয়া রঙের মাটির প্রলেপ আর লোকজ নকশায়_ফুল, পাতা, বন্য প্রাণী এসবে। পাড়ার মাঝখানে মাটির চার্চে যিশু আছেন বেশ! আর সব কটা ঘরের মাঝখানে উঠান। দেয়ালে দেয়ালে লাল রঙের আলপনা। সেখানে এসে পড়েছিল শেষ বিকেলের লালচে আলো। সেই গেরুয়া মাটির নকশাকে আবহে রেখে সামনে ফসলের ক্ষেতের ওপর সিঁদুর ছড়িয়ে যখন বিদায় নিল হাস্যোজ্জ্বল সূর্যটা, তখন ভাবতেই পারিনি আজ এমন গুমরে থাকবে সারা দিন। কাল দুপুর অবধি আমরা হেঁটে হেঁটে ঘুরেছি শাল-সেগুনের বুকচেরা পথে, দেখেছি স্নিগ্ধ সাঁওতাল গ্রাম আর পৌষের শীর্ণ নদীর হাঁটু পানি। আর বিকেলে বনের আরেক পথে পাখির ডাক শুনে শুনে অলস হাঁটতে হাঁটতে পেঁৗছে গিয়েছি আরেক সাঁওতাল গ্রামে। 'তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও_/ আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে; দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে/ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে/নেচে চলে_একবার_ দুইবার_তারপর হঠাৎ তাহারে/বনের হিজলগাছ ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে';
গরুর গাড়ি এবার চলতে চলতে ঢলেপড়া দুপুরে এসে দাঁড়াল এক প্রাচীন দিঘির ধারে। তার চারধার উঁচু পাড়। আশপাশে জনমানবের চিহ্ন নেই। ধুধু বিরান প্রান্তরে এই দিঘির গায়ে হেলান দিয়ে আমাদের মধ্যাহ্নভোজন। পাড়গুলো ঘাসের পরিপাটি বুননে সবুজ হয়ে আছে। দিঘির গভীর শীতল জল আমাদের টানছে, ডাকছে, কিন্তু এই হিমশীতল দিনে কেউ সাড়া দিল না। অথচ কাল অনেকেই বলেছিল দিঘি পেলে সাঁতার কাটবে। ধোঁয়া ওঠা তপ্ত খিচুড়ি এই ঠাণ্ডায় অন্য রকম স্বাদ দিল যেন। তারপর আবার যাত্রা। সন্ধ্যার মুখে গাড়ির বহর ফিরে এল বাংলোর হাতায়।
আর আঁধার ঘনিয়ে এলে ভেসে এল মাদলের বোল। লাল ফুলে খোঁপা বেঁধে লালপাড় শাড়ি কোমরে পেঁচিয়ে হাতে হাত ধরে পায়ে পা মিলিয়ে ধামসা নাচে ঘোর লাগিয়ে দিল সাঁওতাল দল। গানের সুর তার সপ্তক ছেড়ে বহুদূর যেতে চায় সেগুনের মাথায় মাথায়। কী মায়ায় নিমতেলের গন্ধ মেশে চুলের বিনুনি থেকে বাতাসের কণায়। রাত ১০টায় বড় রাস্তায় আমাদের বাস এসে দাঁড়াবে। তারই মধ্যে আরো যতটুকু পারা যায় শুষে নাও, আরো যতটুকু পারা যায় দেখে নাও! শালবনের গাঢ় অন্ধকারে সাঁওতালি সুর আর আগুনের আভার মতো সব স্মৃতিময় রং ভাসিয়ে নিয়ে যায় একটু একটু করে সময়ের দায়ে। আমরা ফিরতে থাকি, কিন্তু অস্তিত্ব থাকে সেখানেই, যেখানে প্রকৃতি তার সবুজ বিছিয়ে রেখেছে অকৃপণ আঁচলে। '...তারপর দূরে নিরুদ্দেশে/চলে যায় কুয়াশায়,_তবু জানি কোনো দিন পৃথিবীর ভিড়ে/হারাব না তারে আমি_...।'কিভাবে যাবেন : ঢাকার গাবতলী থেকে ঠাকুরগাঁওগামী নাবিল বা শ্যামলী পরিবহনের বাসে চড়তে হবে। ভাড়া ৩৫০ টাকা। নামতে হবে বীরগঞ্জের বটতলীতে। সেখান থেকে ভ্যানে করে সিঙরা বনের বিশ্রামাগারে (রেস্ট হাউস) যেতে ভাড়া লাগে ১৫ টাকা।
পাহাড়ে পুকুর আছে
Source: Daily Kalerkantho
Sunday, January 30, 2011
পার্কের আদলে মসজিদ
সাইনবোর্ড না পড়লে যে কেউ মনে করবেন এটি একটি পার্ক। আসলে এটি কোনো পার্ক নয়, পার্কের আদলে তৈরি মসজিদ। যার অবস্থান পূণ্যভূমি সিলেটের ওসমানীনগর থানার তাজপুরের দিঘিরপাড়ে। দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদ নির্মাণ করেছেন এলাকার বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি ধন মিয়া।
শৈল্পিক কারুকাজখচিত মসজিদের পাশেই রয়েছে সুবিন্যস্ত পাঠাগার। নামাজ আদায় ছাড়াও বিকালে লোকজন এখানে বই পড়তে আসেন। ভিড় করেন বিভিন্ন স্থান থেকে আগত সৌন্দর্যপিপাসুরাও। পাঠাগারের পেছনে রয়েছে সুবিশাল দিঘি। সুসজ্জিত ফুলের বাগান, নারিকেল গাছ, বসার ছাউনি, দোলনা, ছোট-বড় গেট। সব মিলিয়ে মনে হবে এটি কোনো পার্কের দৃশ্য। লোকমুখে শোনা যায়, ধন মিয়া স্বপ্নযোগে মসজিদ নির্মাণের আদেশ পেয়ে এটি নির্মাণ করেন। মসজিদের নির্মাণকাজ কয়েক বছর আগে শুরু হলেও শেষ হয়েছে দুই বছর আগে। পড়ন্ত বিকালে দিঘিরপাড়ের মনোরম দৃশ্য ঘুরতে আসা মানুষকে বিমোহিত করে। যান্ত্রিক জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে অবসরে ঘুরে আসতে পারেন ওসমানীনগরের দিঘিরপাড় মসজিদ।
-রামিল মাসুদ
Daily Bangladesh pratidin
টুকটুক ইকো ভিলেজ
টুকটুক ইকো ভিলেজ
রাঙামাটিতে এবার নিয়ে সপ্তমবারের মতো ভ্রমণ। তা সত্ত্বেও আমিসহ সহযাত্রীদের আনন্দ ও উত্সাহের শেষ নেই। নতুনদের মাঝে তা আরও উত্সাহ। সবার চোখে শুধু রাজ্যের বিস্ময়। হাজার হাজার টাকা খরচ করে অনেকেই নিজ দেশ ছেড়ে বিদেশ গেছেন পাহাড়-টিলা-হ্রদের সৌন্দর্যের খোঁজে। কিন্তু নিজ দেশে এত কাছে সেই আকাশসম পাহাড়, সবুজে মোড়া টিলা-উপটিলা, দিগন্ত বিস্মৃত কাপ্তাই লেকের স্বচ্ছ পানিধারা আছে, তা ক’জনের জানা ছিল? ভাবতে অবাক লাগে, মনের অজান্তে কণ্ঠে ভেসে ওঠে ‘ধন-ধন্যে পুষ্পে ভরা ... ... এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।’ এরকম হাজারো মন ভোলানো গান শিল্পীর কণ্ঠে এমনিতে যে ভেসে ওঠেনি, তা সহজেই বোঝা যায় কেবল রাঙামাটিতে গেলে।
রাঙামাটিতে আমাদের এবারের ভ্রমণ আয়োজন ছিল বেসরকারি ভ্রমণ আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠান নোঙর ট্যুরিজমের উদ্যোগে। বিচিত্র আর বৈচিত্র্যে ভরা এখানকার নানা উপজাতির সমাজ-সংস্কৃতি কাছ থেকে দেখা ছাড়াও কাপ্তাই লেকে নৌভ্রমণ ছিল ভ্রমণ পরিকল্পনায়। পরিকল্পনা অনুসারে কোনোটিই বাদ রইল না। সব স্মৃতিই মনের ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো। সে সবের মাঝে টুক টুক ইকো ভিলেজ দর্শনের স্মৃতিই মনের জানালায় ভেসে ওঠে বারবার। সম্পূর্ণ বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা এ পর্যটন কেন্দ্রটি ভ্রমণপ্রিয়দের কাছে দারুণ উপভোগ্য। রাঙামাটি এলে এটি না দেখে চলে যেতে মন চাইবে না।
জেলা সদরের বালুখালী ইউনিয়নের কিল্ল্যামুড়া এলাকায় অবস্থিত এই পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রটি। চারদিকে কাপ্তাই লেকের স্বচ্ছ পানি রাশির মাঝে হঠাত্ই জেগে ওঠা সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় গড়ে তোলা এই ভ্রমণ স্পটে খানিক বসতেই নিমিশেই হিমেল হাওয়ার ঝাপটা নিয়ে যাবে কোনো এক স্বর্গীয় অনুভূতির সন্ধানে। কাপ্তাই লেকে দীর্ঘ নৌভ্রমণে যখন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থা, তখন টুক টুক ইকো ভিলেজের রেস্তোরাঁর রকমারি খাবারের স্বাদ গ্রহণ জিবে এনে দেয় নতুন তৃপ্তি। কাঠ এবং বাঁশের কারুকাজে তৈরি এ রেস্তোরাঁয় মিলে দেশীয় ও পাহাড়ি আদিবাসীদের মজাদার সব খাবারের আইটেম। লেকের পথে সারা দিনের জন্য যারা নৌভ্রমণে বের হন দুপুরের খাবারটা তারা এখানেই সেরে নিতে বেশি পছন্দ করেন। চারদিকে কাপ্তাই হ্রদের সারি সারি পানিরাশি আর পাহাড়ি বন-বনানীর এমন নির্জন পরিবেশে আয়েশি মেজাজে পেটপুরে খেতে গিয়ে টাকার অংকটা একটু বেশি গুনতে হলেও এর মাঝেও আছে অন্য রকম আনন্দ।
পুরো ইকো ভিলেজটি ৫০ একর পাহাড়ি জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত। বহু টিলা-উপটিলা বিভক্ত এ পর্যটন কেন্দ্রে থেকে থেকে গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কয়েকটি কাঠের কটেজ। অ্যাটাশ বাথ, ব্যালকনি-সমেত এ কটেজগুলোয় থাকার জন্য রয়েছে সুব্যবস্থা। এগুলোয় রাত যাপনের আনন্দস্মৃতিতে অমলিন হয়ে থাকবে জীবনভর। জানালার ফাঁকগলিয়ে দূরে পাহাড়ের ঢালে কাপ্তাইয়ের পানিতে পূর্ণিমার চাঁদের খেলা করার দৃশ্য অসাধারণ। রাতে পাহাড়ি বন-বনানীর মাঝ থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝি পোকার একটানা ডাক সঙ্গে নাম জানা-অজানা নিশাচর পশু-পাখির বিচিত্র শব্দে কেবলই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে চায় মন। পর্যটকদের অবস্থান নির্বিঘ্ন করতে আছে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রাকৃতিক পরিবেশে আড্ডা দেয়ার জন্য ইকো ভিলেজে তৈরি করা হয়েছে ১৫টি গোলঘর। শিশুদের আনন্দ দিতে প্রশস্ত খেলার মাঠ, কাঠের ব্রিজ সবই আছে এখানে। চারদিকে পাহাড়ি গাছ-গাছালি ছাড়াও ইকো ভিলেজের চড়াই-উত্রাইয়ে থেকে থেকে লাগানো হয়েছে নানান রকমের ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ। লাল গোলাপ, সাদা গোলাপ, আফ্রিকান গাদায় ভরপুর পার্কটিতে পা ফেললেই বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসা কোমল গন্ধে মন জুড়িয়ে যায়। এগুলোর নির্মল ছায়ায় মাঝেমধ্যেই পিকনিক পার্টির লোকদের ভিড় জমাতে দেখা যায়। ভ্রমণ এবং পিকনিক পার্টির আয়োজনের বাইরে অনেককে গবেষণার কাজেও যেতে দেখা যায় এখানে। বিশেষ করে যারা প্রকৃতিপ্রেমী, প্রকৃতির একান্ত সান্নিধ্য পছন্দ করেন, তাদের জন্য নির্ঝঞ্ঝাট ও ঝামেলামুক্ত পরিবেশে কয়েকটি মুহূর্ত কাটানোর এমন সুযোগ আর দু-একটি মেলানো দায়।
পর্যটন এবং বিনোদন কেন্দ্রের বাইরে ইকো ভিলেজ কেন্দ্রটি আজ প্রাকৃতিক জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায়ও দারুণ ভূমিকা রেখে চলেছে। যদিও পুরোপুরি প্রতিষ্ঠার কাজ এখনও খানিকটা বাকি আছে, তা সত্ত্বেও আশা করা যায় প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পন্ন হলে এটি হবে দেশের ইকোপার্কগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। কারণ, একমাত্র এই ইকোপার্কেই রচিত হয়েছে প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত পাহাড়, হ্রদ, ঝরনাধারা আর কোমল পরিবেশের মিলন বন্ধন। প্রকৃতির সৌন্দর্য যে কত বিচিত্র্য হতে পারে, তা এখানের দৃশ্য দেখে বোঝা যায়। প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে একটু নান্দনিকতার ছোঁয়ায় যে ইকো পার্ক গড়ে উঠেছে রাঙামাটির এই স্বচ্ছ পানির মাঝে, তা পর্যটক মনে রাঙামাটির প্রতি ভ্রমণের আকর্ষণ ক্রমেই বাড়াবে—এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
রাঙামাটি শহর থেকে টুক টুক ইকো ভিলেজে যাওয়ার জন্য শহরের রিজার্ভ বাজারের শহীদ মিনার এলাকা থেকে রয়েছে নিজস্ব বোটের ব্যবস্থা। জনপ্রতি ভাড়া ২০ টাকা। তবে আমাদের ২০ জনের এই ক্ষুদ্র দলটি বহনের জন্য আলাদা রিজার্ভ ট্রলার ভাড়া করেছিল নোঙর ট্যুরিজম কর্তৃপক্ষ। সারা দিন লেকের পথে টুক টুক ইকো ভিলেজসহ রাঙামাটির অনন্য দর্শনীয় পর্যটন স্পট দেখা শেষে সন্ধ্যায় যখন রিজার্ভ বাজারের ট্রলারঘাটে আমাদের নামিয়ে দিল ততক্ষণে স্মৃতিতে জমা পড়েছে রাঙামাটি ভ্রমণের আরও কিছু নতুন অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতা ভোলার নয়। জীবনের সুখ স্মৃতিগুলোর মাঝে যেগুলো চির ভাস্বর হয়ে থাকে জীবনভর।
শীত এলে টুক টুক ইকো ভিলেজসহ রাঙামাটির পর্যটন কেন্দ্রেগুলোয় পর্যটকদের ঢল নামে । এ সময় রাঙামাটি ভ্রমণের মজাই আলাদা। বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করতে পারেন ০১৯২২১১২৬৭৬ নম্বরে।
Source: Daily Amardesh, 31-01-2011
রাঙামাটির ছবি ব্লগ [পর্ব-৫]
আজকের পর্বে থাকছে টুকটুক ইকো ভিলেজ-এ যাওয়ার সময় এবং অবস্থান করা কালীন কয়েকটি ছবি। রাঙামাটিতে গেলে কখনই ১ দিনে পুরোটা ঘুরে শেষ করতে পারবে না কেউ। ১ রাত থাকতেই হবে আপনাকে। রাত কাটানোর কাজটা আপনারা সেরে নিতে পারেন এই টুকটুক ইকো ভিলেজ এই। এখানে কয়েকটি রিসোর্ট গড়ে তোলা হয়েছে। সবগুলো রিসোর্টই পাহাড়ের কিনারায় কাঠের ভিত্তির উপড় তৈরী (ছবিতে দেখবেন)। ধারনা করছি সেগুলো খুবই সাধারন। প্রতি রুম ১ হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়। এক রুমে ৩ জন পর্যন্ত থাকতে পারবেন। সুতরাং তুলনামুলক অনেক সস্তা। এই সব রিসোর্টে ইলেক্টট্রিসিটির ব্যবস্থা করা হয়েছে সোলার এনার্জির মাধ্যমে। রাখা আছে জেনারেটর ও। আসুন কয়েকটি ছবি দেখি…১)
টুকটুক ইকো ভিলেজ-এ যাওয়ার সময়
২)
টুকটুক ইকো ভিলেজ-এর প্রবেশ পথ
৩)
টুকটুক রেষ্টুরেন্ট
৪)
সাদা ভাত এবং চিকেন ইন বেম্বু। স্থানীয় ভাষায় এই খাবারের নাম “কুমোতকুড়া”
৫)
সবুজের মাঝে টুকটুক রিসোর্ট
৬)
একটি নির্মানাধীন রিসোর্টের উপড় আমরা
৭)
টুকটুক ইকো ভিলেজের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি ছোট খাল
৮)
কাশফুল
৯)
পাহাড়ের উপড় থেকে তোলা
১০)
গহীন নীলিমা
১১)
নাম না জানা কোন ফুল
১২)
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, যাবার সময় হলো…
লেখক : আদনান আল বিরুনী
Prothom-alo Blog