মৌয়ালদের সঙ্গে সুন্দরবন
০০ লেখা মুস্তাফিজ মামুন
সুন্দরবনের অফুরন্ত সম্পদের একটি মধু। সাতক্ষীরা রেঞ্জের বিভিন্ন বনে পয়লা এপ্রিল থেকে শুরু হয় মধু সংগ্রহ অভিযান। বহুকাল ধরে মৌয়ালরা নিজস্ব পদ্ধতিতে বাঘের ভয়কে জয় করে মধু নিয়ে আসেন সুন্দরবনের গহীন থেকে। সুন্দরবন ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে মৌয়ালদের মধু সংগ্রহ দেখা হতে পারে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
রহস্যে ঘেরা সুন্দরবন। এ বনের একেকটি রেঞ্জ পর্যটকদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আমেজে ধরা দেয়। জালের মতো বিছানো লবণাক্ত নদী আর খালের পাড়ে ঠাসবুনোট জঙ্গল। সুন্দরবনের সুন্দরী, বাইন, পশুর, গেওয়া, কেওড়া, হেতাল, কাঁকড়া, গর্জন, ধুন্দল আরো কতশত গাছ। গ্রীষ্মের শুরুতে এসব গাছে ফুল ফোটে, ঘ্রাণ ছড়ায় জঙ্গলের বাতাসে বাতাসে।
মৌমাছিরা এসব ফুল থেকে মধু নিয়ে চাক বাঁধে গাছে গাছে। গাছের ডালে জমা হয় প্রকৃতির অমূল্য দান মধু।
পশ্চিম সুন্দরবনের লাগোয়া লোকালয়ে এই মধুর উৎসকে কেন্দ্র করে লোকেরা বাস গড়েছে বহুকাল ধরে। যুগ যুগ ধরে জঙ্গলের এই মধু 'মৌয়াল' নামের এক শ্রেণীর পেশাদারের জীবিকা নির্বাহের খোরাক জুগিয়ে আসছে।
বন বিভাগ তিন মাসের জন্য মৌয়ালদের বনের ভেতরে ঢুকে মধু সংগ্রহের অনুমতি দিয়ে থাকে। সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জ কার্যালয় থেকে মেলে এ অনুমতি। পয়লা এপ্রিল যাত্রা শুরুর আগে মৌয়ালদের বনের রাজস্ব আদায়সহ কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই নৌকা ছুটাতে হয় বনের উদ্দেশে। যাত্রার শুরুতে একটি প্রার্থনা সভার মাধ্যমে মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ শেষে নিরাপদে ফিরে আসার আকুতি জানান উপরওয়ালার কাছে। প্রার্থনা শেষে প্রত্যেক মৌয়ালের হাতে বেঁধে দেওয়া হয় লাল কাপড়। তাদের বিশ্বাস, এ কাপড় বিপদ-আপদ বিশেষ করে বনের রাজার হাত থেকে রক্ষা করবে তাদের। প্রার্থনা শেষে মৌয়ালরা তাদের নৌকা নিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে অপেক্ষা করেন। বন কর্মকর্তা আকাশে গুলি ছোঁড়েন, মৌয়ালরা জোরসে বৈঠায় হাত লাগান। কার আগে কে পেঁৗছুতে পারেন বনের পানে। লোনা পানি কেটে বৈঠা টানেন জোরেসোরে।
সাত থেকে তেরজন মৌয়াল থাকেন সাধারণত একেকটি দলে। বনে পৌঁছে একজনকে নৌকা পাহারায় রেখে সবাই ঢুকে পড়েন ভেতরে। গামছা দিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে নেন হুল ফোটার ভয়ে। মৌয়ালদের চোখ থাকে গাছে, গাছের ডালে ডালে। সবাই-ই ডালে ডালে খুঁজে ফেরেন মধু ভরা মৌচাক। তবে, চাক ভাঙার সিদ্ধান্তটি নেন দলনেতা, মৌয়ালরা যাকে বলেন বহরদার। সবার হাতে দা, ধামা। বহরদার অভিজ্ঞ মৌয়াল। বাতাসের গতি ও মৌমাছির উপস্থিতি ইত্যাদি লক্ষ্য করে মৌচাকের অবস্থান খুঁজে বের করেন তিনি। সাধারণত তারা মৌচাকের অস্তিত্ব টের পান গাছের পাতায় মৌমাছির মল কিংবা মৌমাছির উড়াউড়ি দেখে। বহরদারের অনুমতি মিললে গাছে চড়ে মৌচাকে আগুনের ধোঁয়া দেন একজন, একজন দা দিয়ে কাটেন চাক, নিচে বেতের তৈরি ধামা পেতে কাটা চাক ধরেন অরেকজন। এভাবেই জঙ্গলে জঙ্গলে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন মৌয়ালরা। সারা দিনের সংগ্রহ নিয়ে সন্ধ্যায় নৌকায় ফেরেন তারা। মাটির বড় মটকিতে পুরে ফেলেন দিন শেষের সংগ্রহ।
মৌয়ালদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সুন্দরবনের ভেতরে এসব রোমাঞ্চকর মধু সংগ্রহের দৃশ্য দেখার ব্যবস্থা করেছে বেসরকারী ভ্রমণ সংস্থা বেঙ্গল টু্যরস। সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে মৌয়ালদের মধু সংগ্রহ দেখতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন অভিজ্ঞ এ ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে। প্রতিবছরের মতো এবারও বেঙ্গল টু্যরস মধু সংগ্রহের বিশেষ প্যাকেজের ব্যবস্থা করেছে। যে কেউ তাই কাছে থেকে দেখে আসতে পারেন সুন্দরবনের মৌয়ালদের জীবনযাপন ও মধু সংগ্রহের রোমাঞ্চকর সব দৃশ্য। ৩১ মার্চ থেকে শুরু হবে এ ভ্রমণ। ৪ রাত ৩ দিনের এ প্যাকেজে জনপ্রতি খরচ হবে ৮ হাজার ৫০০ টাকা, বিদেশিদের জন্যে ১০ হাজার ৫০০ টাকা। ঢাকা থেকে তাপনিয়ন্ত্রিত বাসে করে সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালিনী। সেখান থেকে বেঙ্গলের নিজস্ব জলযানে চেপে পশ্চিম সুন্দরবনের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো আর মধু সংগ্রহ দেখা। যোগাযোগ :বাড়ি-৪৫, রোড-২৭, বস্নক-এ, বনানি, ঢাকা। ফোন :৮৮৫৭৪২৪, ৮৮৩৪৭১৬।
কিছু তথ্য
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের জন্য সাধারণত মৌয়ালরা প্রতিবারে পনের দিনের অনুমতি পান। সুন্দরবনের সবচেয়ে ভালো মানের মধু হলো খোলসী ফুলের 'পদ্ম মধু'। মানের দিক থেকে এরপরেই গরান ও গর্জন ফুলের 'বালিহার মধু'। মৌসুমের একেবারে শেষে আসা কেওড়া ও গেওয়া ফুলের মধু অপেক্ষাকৃত কম সুস্বাদু। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে ঐতিহ্যবাহী মৌয়াল পেশা এখন হুমকির মুখে। আরো আছে নানারকম সাপ আর বাঘের ভয়। প্রতিবছর গড়ে আট থেকে দশজন মৌয়াল বাঘের আক্রমণের শিকার হন। মৌয়ালরা তাদের সংগৃহীত মধু বিক্রির পসরা সাজান সাতক্ষীরার গাবুরা গ্রামে। খাঁটি মধু চেনার সহজ উপায় হলো, এক টুকরা কাপড় কিংবা কাগজ মধুতে ডুবিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেখা। মধু ভেজানো কাপড় টুকরা ভালোভাবে জ্বললে মধু খাঁটি, না জ্বললে ভেজাল।
রহস্যে ঘেরা সুন্দরবন। এ বনের একেকটি রেঞ্জ পর্যটকদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আমেজে ধরা দেয়। জালের মতো বিছানো লবণাক্ত নদী আর খালের পাড়ে ঠাসবুনোট জঙ্গল। সুন্দরবনের সুন্দরী, বাইন, পশুর, গেওয়া, কেওড়া, হেতাল, কাঁকড়া, গর্জন, ধুন্দল আরো কতশত গাছ। গ্রীষ্মের শুরুতে এসব গাছে ফুল ফোটে, ঘ্রাণ ছড়ায় জঙ্গলের বাতাসে বাতাসে।
মৌমাছিরা এসব ফুল থেকে মধু নিয়ে চাক বাঁধে গাছে গাছে। গাছের ডালে জমা হয় প্রকৃতির অমূল্য দান মধু।
পশ্চিম সুন্দরবনের লাগোয়া লোকালয়ে এই মধুর উৎসকে কেন্দ্র করে লোকেরা বাস গড়েছে বহুকাল ধরে। যুগ যুগ ধরে জঙ্গলের এই মধু 'মৌয়াল' নামের এক শ্রেণীর পেশাদারের জীবিকা নির্বাহের খোরাক জুগিয়ে আসছে।
বন বিভাগ তিন মাসের জন্য মৌয়ালদের বনের ভেতরে ঢুকে মধু সংগ্রহের অনুমতি দিয়ে থাকে। সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জ কার্যালয় থেকে মেলে এ অনুমতি। পয়লা এপ্রিল যাত্রা শুরুর আগে মৌয়ালদের বনের রাজস্ব আদায়সহ কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই নৌকা ছুটাতে হয় বনের উদ্দেশে। যাত্রার শুরুতে একটি প্রার্থনা সভার মাধ্যমে মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ শেষে নিরাপদে ফিরে আসার আকুতি জানান উপরওয়ালার কাছে। প্রার্থনা শেষে প্রত্যেক মৌয়ালের হাতে বেঁধে দেওয়া হয় লাল কাপড়। তাদের বিশ্বাস, এ কাপড় বিপদ-আপদ বিশেষ করে বনের রাজার হাত থেকে রক্ষা করবে তাদের। প্রার্থনা শেষে মৌয়ালরা তাদের নৌকা নিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে অপেক্ষা করেন। বন কর্মকর্তা আকাশে গুলি ছোঁড়েন, মৌয়ালরা জোরসে বৈঠায় হাত লাগান। কার আগে কে পেঁৗছুতে পারেন বনের পানে। লোনা পানি কেটে বৈঠা টানেন জোরেসোরে।
সাত থেকে তেরজন মৌয়াল থাকেন সাধারণত একেকটি দলে। বনে পৌঁছে একজনকে নৌকা পাহারায় রেখে সবাই ঢুকে পড়েন ভেতরে। গামছা দিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে নেন হুল ফোটার ভয়ে। মৌয়ালদের চোখ থাকে গাছে, গাছের ডালে ডালে। সবাই-ই ডালে ডালে খুঁজে ফেরেন মধু ভরা মৌচাক। তবে, চাক ভাঙার সিদ্ধান্তটি নেন দলনেতা, মৌয়ালরা যাকে বলেন বহরদার। সবার হাতে দা, ধামা। বহরদার অভিজ্ঞ মৌয়াল। বাতাসের গতি ও মৌমাছির উপস্থিতি ইত্যাদি লক্ষ্য করে মৌচাকের অবস্থান খুঁজে বের করেন তিনি। সাধারণত তারা মৌচাকের অস্তিত্ব টের পান গাছের পাতায় মৌমাছির মল কিংবা মৌমাছির উড়াউড়ি দেখে। বহরদারের অনুমতি মিললে গাছে চড়ে মৌচাকে আগুনের ধোঁয়া দেন একজন, একজন দা দিয়ে কাটেন চাক, নিচে বেতের তৈরি ধামা পেতে কাটা চাক ধরেন অরেকজন। এভাবেই জঙ্গলে জঙ্গলে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন মৌয়ালরা। সারা দিনের সংগ্রহ নিয়ে সন্ধ্যায় নৌকায় ফেরেন তারা। মাটির বড় মটকিতে পুরে ফেলেন দিন শেষের সংগ্রহ।
মৌয়ালদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সুন্দরবনের ভেতরে এসব রোমাঞ্চকর মধু সংগ্রহের দৃশ্য দেখার ব্যবস্থা করেছে বেসরকারী ভ্রমণ সংস্থা বেঙ্গল টু্যরস। সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে মৌয়ালদের মধু সংগ্রহ দেখতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন অভিজ্ঞ এ ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে। প্রতিবছরের মতো এবারও বেঙ্গল টু্যরস মধু সংগ্রহের বিশেষ প্যাকেজের ব্যবস্থা করেছে। যে কেউ তাই কাছে থেকে দেখে আসতে পারেন সুন্দরবনের মৌয়ালদের জীবনযাপন ও মধু সংগ্রহের রোমাঞ্চকর সব দৃশ্য। ৩১ মার্চ থেকে শুরু হবে এ ভ্রমণ। ৪ রাত ৩ দিনের এ প্যাকেজে জনপ্রতি খরচ হবে ৮ হাজার ৫০০ টাকা, বিদেশিদের জন্যে ১০ হাজার ৫০০ টাকা। ঢাকা থেকে তাপনিয়ন্ত্রিত বাসে করে সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালিনী। সেখান থেকে বেঙ্গলের নিজস্ব জলযানে চেপে পশ্চিম সুন্দরবনের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো আর মধু সংগ্রহ দেখা। যোগাযোগ :বাড়ি-৪৫, রোড-২৭, বস্নক-এ, বনানি, ঢাকা। ফোন :৮৮৫৭৪২৪, ৮৮৩৪৭১৬।
কিছু তথ্য
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের জন্য সাধারণত মৌয়ালরা প্রতিবারে পনের দিনের অনুমতি পান। সুন্দরবনের সবচেয়ে ভালো মানের মধু হলো খোলসী ফুলের 'পদ্ম মধু'। মানের দিক থেকে এরপরেই গরান ও গর্জন ফুলের 'বালিহার মধু'। মৌসুমের একেবারে শেষে আসা কেওড়া ও গেওয়া ফুলের মধু অপেক্ষাকৃত কম সুস্বাদু। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে ঐতিহ্যবাহী মৌয়াল পেশা এখন হুমকির মুখে। আরো আছে নানারকম সাপ আর বাঘের ভয়। প্রতিবছর গড়ে আট থেকে দশজন মৌয়াল বাঘের আক্রমণের শিকার হন। মৌয়ালরা তাদের সংগৃহীত মধু বিক্রির পসরা সাজান সাতক্ষীরার গাবুরা গ্রামে। খাঁটি মধু চেনার সহজ উপায় হলো, এক টুকরা কাপড় কিংবা কাগজ মধুতে ডুবিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেখা। মধু ভেজানো কাপড় টুকরা ভালোভাবে জ্বললে মধু খাঁটি, না জ্বললে ভেজাল।
No comments:
Post a Comment