চারদিক: রামগড়ে রাত, ভোরটাও
মৃত্যুঞ্জয় রায় | তারিখ: ০৩-০৩-২০১০হেয়াকো বাজার পেরোতেই বেলাটা হেলে পড়ল। সন্ধ্যা নাগাদ কিছুতেই খাগড়াছড়ি পৌঁছাতে পারব না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, রাতে পাহাড়ি পথে আর পা না বাড়িয়ে রামগড়েই থেকে যাব। সাঁই সাঁই করে গাড়ি পাহাড়ি পথে ছুটে চলেছে। পাহাড় বললে বোধ হয় ভুল হবে। ফটিকছড়ির হেয়াকো বাজারের পর থেকে উঁচু-নিচু টিলা আর টিলার ওপর কিছু রুক্ষ্ম-শুষ্ক চা-বাগান চোখে পড়ছে। ডানে-বাঁয়ে দাঁতমারার বিশাল বিশাল রাবার বাগান। টিলার ঢালে পাতাটাতা ঝরিয়ে দিগম্বর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বসন্তের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। রাবারগাছগুলোর পেছনের আকাশজমিনটা ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠছে। গাছগুলোকে কয়লাপোড়া কালো ছায়ার মতো মনে হচ্ছে। এও তো প্রকৃতি ও ক্ষণের একটা সৌন্দর্য। তবে আমাদের আর বুঝতে বাকি রইল না যে কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ে সন্ধ্যা নামবে, সন্ধ্যার পর রাত। রাত মানেই পাহাড়ের আতঙ্ক। তখন এতটা পথ অচেনা জায়গায় ড্রাইভ করা বোকামি, পায়ে পায়ে ঝুঁকি। তাই রামগড়েই থাকার জায়গা খোঁজার জন্য ফোন লাগালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মোবাইল ফোনে নিশ্চিত হয়ে গেল রামগড় উপজেলা পরিষদ চত্বরে জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় থাকার ব্যবস্থা।
লেকের পাড়ে নাতিউচ্চ একটা টিলার ঠিক মাথায় চমত্কার ডাকবাংলো। টিনের ছাউনি। রুমে ঢুকতেই হাড়কাঁপানো শীত এসে জেঁকে বসল। সেই সঙ্গে বিদ্যুত্ না থাকা। বাইরে পূর্ণিমার আলোয় সব ফকফক করছে। ইচ্ছে করছে রাতের জোছনায় রামগড়ের অদেখা রূপটা দেখে নিই। কিন্তু শীতে কে বেরোবে কম্বলের নিচ থেকে? দরজা-জানালা খুললেই শীতের ঝাপটা। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দরজা-জানালা আটকে জাহিদ ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। তিনিই আমাদের এখানে থাকার ব্যবস্থা করেছেন, রাতে খাওয়ার জন্য নিতে আসবেন।
বাংলোটায় বেশ কটা রুম। কিন্তু আমরা দুজন একটা রুমে ছাড়া আর কেউ নেই। সুনসান অপার্থিব এক নীরবতা। ঝিঁঝি ডাকছে, ডাকছে নিশাচর পাখিরা। ওরাই জানিয়ে দিচ্ছে আমরা এখনো পৃথিবীর মাটিতে আছি। বাংলোর আশপাশের গাছ থেকে শীতের শুকনো পাতা খসে পড়ার খসখস শব্দ হচ্ছে। আটটা বাজতেই জাহিদ ভাই এসে হাজির হলেন। রামগড়ে ট্রানজিট ব্রেক। তবু এসেই যখন পড়েছি, তখন এ জায়গাটা একটু দেখে যেতে দোষ নেই। খাগড়াছড়ির এ উপজেলাটা খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে অনেক দূরে। ঠিক পাহাড়িও নয়, সমতলও নয়। একটাি ঝিরি বয়ে গেছে পাশ দিয়ে। তার দুই পাশে সমতল ভূমি। সেখানে নানা রকম সবজি ফলছে। টিলায় টিলায় বনজ বৃক্ষরাজি। শীতে মরা চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টিলার ঢালে ঢালে বাংলা কলার ঝোপ, ফুরিয়ে আসা নলখাগড়ার ফুলে ম্রিয়মাণ সৌন্দর্য। আসার সময় এসব দেখেছি। সকালে রওনা হওয়ার আগে কিছুটা সময় হাতে আছে। অতএব আর একটু ঘুরে দেখা যায়। জাহিদ ভাইকেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী কী দেখার আছে রামগড়ে?’
‘কেউ তো সহসা এখানে বেড়াতে আসে না। দেখার মতো কোনো জায়গাও নেই। যেখানে এখন আছেন, ওটাই বলতে পারেন রামগড়ের একমাত্র দর্শনীয় স্থান। একটা লেক, লেকের ওপর ঝুলন্ত সেতু, লেককে ঘিরে উদ্যান, বেঞ্চ, অবজারভেটরি রুম। অনেকেই এখানে পিকনিকে আসে। বর্ষায় লেকে বোটিংয়ের ব্যবস্থাও আছে।’
‘রাত পোহালে না হয় লেকের পাড়ে প্রাতর্ভ্রমণে বেরোনো যাবে।’ বলে শুয়ে পড়লাম।
চেনা-অচেনা অনেক পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল। ভোর হতেই বাংলোর বারান্দায় পায়চারি করতে লাগলাম। টিলার চূড়ায় বাংলোর বারান্দায় কুয়াশামাখা ভোরের রোদ আছড়ে পড়েছে। এল প্যাটার্নের ডাকবাংলোটার পেছনে একফালি ঘাসের গালিচাঢাকা আয়তাকার উঠোন। উঠোনের কিনারা ঢাল বেয়ে সোজা নিচে নেমে গেছে। ঢালে পাহাড়ি গাছপালা। সামনের উঠোনটা পাকা, স্টিলের রেলিংঘেরা। তার নিচ দিয়েই পথ, পথের ওপাশে লেক। বাংলোর গেটে একটা কাঠগোলাপের গাছ পাতাটাতা ঝরিয়ে ন্যাংটো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদিক দিয়ে বেরিয়েই লেকের ধারে সরু পথটা ধরলাম প্রাতর্ভ্রমণের জন্য। লেকের শান্ত নিথর জলের ওপর কুয়াশার দাপাদাপি, যেন জলের চাতাল থেকে ধানসেদ্ধ গরম ভাপ উঠছে, পাতলা ধোঁয়া উঠছে। লেকের ওপর একটা চমত্কার ঝুলন্ত ব্রিজ। পাশে গোলাকার একটা অবজারভেটরি সেন্টার। রাঙামাটির বিস্তীর্ণ সৌন্দর্য নেই রামগড়ে, তবু যেন এই লেকটাই রামগড়ে এক টুকরো রাঙামাটি। লেকের ওপারে পরিষদের দালানকোঠা। ধীরে ধীরে রোদ উঠছে, পেটও চোঁ চোঁ করছে। অতএব নাশতার জন্য ফিরতে হলো। নাশতা সেরে উঠতেই জাহিদ ভাই বললেন, ‘খুব কাছেই বর্ডার। যাবেন নাকি? ওপারে ত্রিপুরা।’ যেতে মন চাইল। কিন্তু সময় কম। তাই ওখানে না গিয়ে রামগড়ে শতবর্ষী দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি মন্দিরটাই দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। সেটা দেখার পর জাহিদ ভাই বললেন, ‘বরং এখানে সময় নষ্ট না করে আপনারা খাগড়াছড়ি যওয়ার পথে ডাইভারশন থেকে চিটাগাংয়ের দিকে ছয়-সাত কিলোমিটার এগিয়ে মানিকছড়িটা ঘুরে যেতে পারেন। সেখানে মং রাজার বাড়িটা দেখে আসতে পারেন।’ জানি যে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের তিনটি সার্কেলে তিনজন রাজা আছেন, রাজবাড়িও তিনটি। খাগড়াছড়ি সার্কেলের মং রাজার রাজত্ব। রাঙামাটিতে চাকমা রাজা আর বান্দরবানে বম রাজা। খাগড়াছড়ি চলে গেলে আর এ রাজবাড়ি দেখা হবে না। তাই চলতি পথে ওটাই দেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে রামগড়কে বিদায় জানিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম।
Source: Daily Ptothom-alo
লেকের পাড়ে নাতিউচ্চ একটা টিলার ঠিক মাথায় চমত্কার ডাকবাংলো। টিনের ছাউনি। রুমে ঢুকতেই হাড়কাঁপানো শীত এসে জেঁকে বসল। সেই সঙ্গে বিদ্যুত্ না থাকা। বাইরে পূর্ণিমার আলোয় সব ফকফক করছে। ইচ্ছে করছে রাতের জোছনায় রামগড়ের অদেখা রূপটা দেখে নিই। কিন্তু শীতে কে বেরোবে কম্বলের নিচ থেকে? দরজা-জানালা খুললেই শীতের ঝাপটা। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দরজা-জানালা আটকে জাহিদ ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। তিনিই আমাদের এখানে থাকার ব্যবস্থা করেছেন, রাতে খাওয়ার জন্য নিতে আসবেন।
বাংলোটায় বেশ কটা রুম। কিন্তু আমরা দুজন একটা রুমে ছাড়া আর কেউ নেই। সুনসান অপার্থিব এক নীরবতা। ঝিঁঝি ডাকছে, ডাকছে নিশাচর পাখিরা। ওরাই জানিয়ে দিচ্ছে আমরা এখনো পৃথিবীর মাটিতে আছি। বাংলোর আশপাশের গাছ থেকে শীতের শুকনো পাতা খসে পড়ার খসখস শব্দ হচ্ছে। আটটা বাজতেই জাহিদ ভাই এসে হাজির হলেন। রামগড়ে ট্রানজিট ব্রেক। তবু এসেই যখন পড়েছি, তখন এ জায়গাটা একটু দেখে যেতে দোষ নেই। খাগড়াছড়ির এ উপজেলাটা খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে অনেক দূরে। ঠিক পাহাড়িও নয়, সমতলও নয়। একটাি ঝিরি বয়ে গেছে পাশ দিয়ে। তার দুই পাশে সমতল ভূমি। সেখানে নানা রকম সবজি ফলছে। টিলায় টিলায় বনজ বৃক্ষরাজি। শীতে মরা চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টিলার ঢালে ঢালে বাংলা কলার ঝোপ, ফুরিয়ে আসা নলখাগড়ার ফুলে ম্রিয়মাণ সৌন্দর্য। আসার সময় এসব দেখেছি। সকালে রওনা হওয়ার আগে কিছুটা সময় হাতে আছে। অতএব আর একটু ঘুরে দেখা যায়। জাহিদ ভাইকেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী কী দেখার আছে রামগড়ে?’
‘কেউ তো সহসা এখানে বেড়াতে আসে না। দেখার মতো কোনো জায়গাও নেই। যেখানে এখন আছেন, ওটাই বলতে পারেন রামগড়ের একমাত্র দর্শনীয় স্থান। একটা লেক, লেকের ওপর ঝুলন্ত সেতু, লেককে ঘিরে উদ্যান, বেঞ্চ, অবজারভেটরি রুম। অনেকেই এখানে পিকনিকে আসে। বর্ষায় লেকে বোটিংয়ের ব্যবস্থাও আছে।’
‘রাত পোহালে না হয় লেকের পাড়ে প্রাতর্ভ্রমণে বেরোনো যাবে।’ বলে শুয়ে পড়লাম।
চেনা-অচেনা অনেক পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল। ভোর হতেই বাংলোর বারান্দায় পায়চারি করতে লাগলাম। টিলার চূড়ায় বাংলোর বারান্দায় কুয়াশামাখা ভোরের রোদ আছড়ে পড়েছে। এল প্যাটার্নের ডাকবাংলোটার পেছনে একফালি ঘাসের গালিচাঢাকা আয়তাকার উঠোন। উঠোনের কিনারা ঢাল বেয়ে সোজা নিচে নেমে গেছে। ঢালে পাহাড়ি গাছপালা। সামনের উঠোনটা পাকা, স্টিলের রেলিংঘেরা। তার নিচ দিয়েই পথ, পথের ওপাশে লেক। বাংলোর গেটে একটা কাঠগোলাপের গাছ পাতাটাতা ঝরিয়ে ন্যাংটো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদিক দিয়ে বেরিয়েই লেকের ধারে সরু পথটা ধরলাম প্রাতর্ভ্রমণের জন্য। লেকের শান্ত নিথর জলের ওপর কুয়াশার দাপাদাপি, যেন জলের চাতাল থেকে ধানসেদ্ধ গরম ভাপ উঠছে, পাতলা ধোঁয়া উঠছে। লেকের ওপর একটা চমত্কার ঝুলন্ত ব্রিজ। পাশে গোলাকার একটা অবজারভেটরি সেন্টার। রাঙামাটির বিস্তীর্ণ সৌন্দর্য নেই রামগড়ে, তবু যেন এই লেকটাই রামগড়ে এক টুকরো রাঙামাটি। লেকের ওপারে পরিষদের দালানকোঠা। ধীরে ধীরে রোদ উঠছে, পেটও চোঁ চোঁ করছে। অতএব নাশতার জন্য ফিরতে হলো। নাশতা সেরে উঠতেই জাহিদ ভাই বললেন, ‘খুব কাছেই বর্ডার। যাবেন নাকি? ওপারে ত্রিপুরা।’ যেতে মন চাইল। কিন্তু সময় কম। তাই ওখানে না গিয়ে রামগড়ে শতবর্ষী দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি মন্দিরটাই দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। সেটা দেখার পর জাহিদ ভাই বললেন, ‘বরং এখানে সময় নষ্ট না করে আপনারা খাগড়াছড়ি যওয়ার পথে ডাইভারশন থেকে চিটাগাংয়ের দিকে ছয়-সাত কিলোমিটার এগিয়ে মানিকছড়িটা ঘুরে যেতে পারেন। সেখানে মং রাজার বাড়িটা দেখে আসতে পারেন।’ জানি যে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের তিনটি সার্কেলে তিনজন রাজা আছেন, রাজবাড়িও তিনটি। খাগড়াছড়ি সার্কেলের মং রাজার রাজত্ব। রাঙামাটিতে চাকমা রাজা আর বান্দরবানে বম রাজা। খাগড়াছড়ি চলে গেলে আর এ রাজবাড়ি দেখা হবে না। তাই চলতি পথে ওটাই দেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে রামগড়কে বিদায় জানিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম।
Source: Daily Ptothom-alo
No comments:
Post a Comment