হোয়াইকংয়ের কুদুম গুহা
যেতে চাইলে
ঢাকা থেকে কক্সবাজার। নিজস্ব বাহনে অথবা লিংক রোড থেকে টেকনাফের গেটলক বাসে। নামতে হবে হোয়াইকং বাজার। স্থানীয় ফাঁড়ি থেকে পুলিশ স্কট নিয়ে যেতে হবে কুদুম গুহা। জনপ্রতি সর্বমোট খরচ যাই হোক কক্সবাজারে কাঁকড়া ভাজার স্বাদ নিতে কিন্তু ভুলবেন না। পরিশেষে বলতে হয়, প্রকৃতির দান কুদুম গুহার প্রতি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি সুদৃষ্টি দেয় তাহলে দার্জিলিংয়ের রক গার্ডেনের চেয়ে আমাদের হোয়াইকংয়ের কুদুম গুহার নয়ন জুড়ানো অপার সৌন্দর্যের প্রাকৃতিক দৃশ্য কোনো অংশে কম হবে কি?
Source: Daily Amardesh
নাইক্ষ্যংকে চিনি বহুদিনের। মূলত বন্যপ্রাণীর টানেই ভবঘুরের মতো বারবার ছুটে যাওয়া হয় সেখানে। বন্যহাতি, প্যারাইল্লা বানর আর সাম্বার হরিণের জন্য সবাই নাইক্ষ্যংকে আলাদা করে চেনেন। এখন বানর আর হরিণের জাতটির দেখা বেশ কষ্টকর হলেও হাতির পাল দেখা যায় সহজেই। হাতি হিংস্র আর ভয়ঙ্কর বলেই সবাই জানেন। ওই নাইক্ষ্যং-এ যাওয়া হয়েছে বহুবার। কত রকমের পথ বেয়ে যে তাকে উপভোগ করেছি তা বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু যতবারই গেছি সবসময়ই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই গুহার কথা মনে পড়েছে। চক্কর দিয়েছি, পথের সন্ধান করেছি, তবে খুঁজে পাইনি। সবশেষে শেখ আইনউদ্দিনের কথার সুর ধরে চলতে থাকলাম এবং পথ শেষে ঠিকানা ঠিকই মিলল গুহাটির। বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে একটি দুর্গম পাহাড়ে বিশ্বযুদ্ধের চিহ্ন খুঁজে পেয়ে বহুদিনের দেখার স্বাদ পূরণ হলো। গুহাটি কীভাবে আজও দরজা ফাঁক করে জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে আছে মিয়ানমারের দিকে তা ভাবতেই অবাক লাগে। যুদ্ধের দাবানল যখন তুঙ্গে তখন মিয়ানমারের দিক থেকে এক্সিস বাহিনী বাংলার সীমানার দিকে ধেয়ে আসছিল। জার্মানি, ইতালি, জাপানিজসহ অন্যরা এ দলে ছিল। এর আগে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইনের মতো আরও কিছু দেশ এ বাহিনীর কাছে ধরাশায়ী হয়েছিল। সেসময় ভারতবর্ষজুড়ে ব্রিটিশ বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করলেও তাদের সঙ্গে ইউএসএসহ অন্য মিত্ররা মিলে স্পেশাল অ্যালাইড বাহিনী গঠন করেছিল। এক্সিস বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের ভয়ে পাহাড়ি এলাকার অ্যালাইড গ্রুপ নাইক্ষ্যং পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। মিয়ানমারের দিক থেকে নাইক্ষ্যংয়ের দিকে ছুটে আসা এক্সিস সৈনিকদের সামনে তখন শুধুই ছিল নাফ নদী। ঠিক এমন সময় আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা মেরে যুদ্ধের মোড় পুরো ঘুরিয়ে দেয়। যুদ্ধ চলে যায় অ্যালাইডদের হাতে। নাফ থেকে পিছু হঠতে থাকে এক্সিস বাহিনী। এ সময় অ্যালাইডের সৈন্যরা নাইক্ষ্যংয়ের গুহার ভেতর থেকে মুখ খুলে গর্জন ছাড়ে। জয় হয় নাইক্ষ্যংয়ের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এ গুহাটি তাই পাহাড়টিকে এনে দিয়েছে বাড়তি এক মর্যাদা। নাইক্ষ্যংয়ের আশপাশের আরও দুটি আশ্চর্য আকর্ষণ হলো তৈগা চূড়া ও কুদুমের গুহা। ভয়ঙ্কর কুদুম গুহার ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর রয়েছে হাজারও চামচিকার ভিড়।
নাইক্ষ্যং পাহাড়ের চূড়া স্বপ্নের মতো সুন্দর। এখন থেকে মিয়ানমারের পর্বতশ্রেণী দেখার মজা আরও আনন্দের। আর এই দুই পর্বতের মধ্য দিয়ে বেয়ে গেছে এ দেশে সবচেয়ে সুন্দর নদী নাফ। নাফের বেয়ে চলা, সাগরের সঙ্গে তার মিলন দেখলে সবাই পাগল হবেন তার রূপের মোহনায়। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো দু'দেশের জেলেরা এ নদীতে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে মিলেমিশে মাছ ধরে, দেখা হলে কুশল বিনিময় হয়। নদীতে আছে হরেক রকমের পরিযায়ী পাখি। আরও আছে গানজেজ ও ইরাবতি ডলফিনের দল। শুধু এই একটি পাহাড়কে ঘিরেই কত যে স্বপ্ন সমষ্টিবদ্ধ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
খুঁজে পাওয়া নাইক্ষ্যং পাহাড়ের। গুহার দরজায় দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের পর্বতশ্রেণী দেখে মুগ্ধ হওয়ার মতো। পেয়েছিলাম। সে যুগে জয় হয়েছিল নাইক্ষ্যংয়েরই। পাহাড়টি এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, অ্যালাইড বাহিনী চলে গেছে। তৈরি হয়েছে দুটি দেশের আলাদা মানচিত্র। এখন এর একপাশের পাহারাদার বিডিআর, অন্যপাশে আছে নাসাকা বাহিনী। দু'দেশের সীমানার ভেতর চাইলেই আর কেউ ঢুকতে পারেন না। অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে, আছে আইন মেনে চলার কঠোর সিদ্ধান্ত। তবে সে যুগের আদিপ্রথা এখনও টিকে আছে পাহাড়ি বন্যহাতিদের বেলায়। তাদের কোনো পাসপোর্ট লাগে না। মাঝেমধ্যে মিয়ানমার পাহাড় থেকে হাতির পাল খাবার সন্ধানে চলে আসে নাইক্ষ্যংয়ের দিকে। একটা বিশেষ সময় পার করে আবার ফিরে যায় নিজ দেশে। বন্যপ্রাণীর মতো এই সম্প্রীতি সবার মধ্যে তৈরি হলেই কেবল যুদ্ধের মতো ক্ষতচিহ্নগুলো আর হবে না।
Source: Daily Samakal