Search This Blog
FCO Travel Advice
Bangladesh Travel Advice
AFRICA Travel Widget
Asia Travel Widget
Friday, August 27, 2010
Tuesday, August 17, 2010
বান্দরবানে সবুজ নিসর্গে
বাস ছেড়েছিল মাঝরাতেরও একটু পর।
‘বান্দরবান খুব সুন্দর, না?’
দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের এই প্রশ্নের উত্তরে বান্দরবান নিয়ে নানা ইতিবাচক কথা বলা হয়। তার পর থেকেই ওর চোখে স্বপ্ন। সে স্বপ্ন বাকি কজন শিশুর মধ্যেও ছড়িয়ে যায়। শিশুরা উত্তেজনায় ঘুমাতে পারছিল না। কিন্তু আমরা জানি, বাসের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের চোখে ভর করা স্বপ্ন আরও বড় হবে…।
গন্তব্য বান্দরবান। উপলক্ষ ঈদের ছুটিতে বেড়ানো। ঈদের ছুটিতে বান্দরবানে যেতে চাইলে আগে থেকেই হোটেল, রেস্টহাউস বা রিসোর্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিতে হবে, নইলে থাকার জায়গা পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশ যেখানে সবচেয়ে বেশি আকাশের কাছাকাছি, সে জেলাই বান্দরবান। ঈদ কবে হচ্ছে, সে দ্বিধা কেটে গেছে সন্ধ্যার পরপরই। সুতরাং ভোর হতে শুরু করলেই ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ গানটি সার্থকতা পেয়ে যাবে।
যাঁরা কাজের চাপে বছরের অন্য সময় বের হতে পারেন না, ঈদের বড় ছুটিটাকেই তাঁরা বেছে নেন বেড়ানোর জন্য। ঢাকার কলাবাগান বাসপাড়ায় অপেক্ষমাণ ব্যক্তিদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী-সন্তানসমেত অনেকগুলো পরিবার দেখে সে কথাই মনে হয়েছিল। বাক্সপেটরা বেঁধে নিয়ে তিন দিনের জন্য ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’ সব পরিবার।
দ্রুতগতিতে চলা বাসের জানালার বাইরে মেঘের সঙ্গে চাঁদের লুকোচুরি। সরু একফালি চাঁদ কী আনন্দটাই না দিচ্ছে মানুষকে! মহাসড়কের এখানে-ওখানে মাঝেমধ্যেই সৃষ্টি হওয়া যানজটও মাটি করতে পারছে না সে আনন্দকে। বাসটি সবাইকে শুধু বান্দরবানে পৌঁছে দেবে না, পৌঁছে দেবে ঈদ-উৎসবের কাছেও।
২.
ভোরের আকাশ এসে যখন রাঙিয়ে দিচ্ছিল দিগন্ত, তখন অনেকের চোখই জানালার বাইরে। অন্ধকার ছিন্ন করে সূর্য ওঠার আগেই আকাশে লাগছিল লালের পরত। চট্টগ্রাম কালুরঘাট সেতু পেরিয়ে বাস ছুটে চলেছে কক্সবাজার সড়ক দিয়ে। এ পথে কিছুদূর যাওয়ার পর সাতকানিয়া থেকে বাঁ-দিকের আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু পথটিতে পৌঁছে জুড়িয়ে গেল মন। এ পথই আমাদের পৌঁছে দেবে বান্দরবানে।
সূর্য উঠছে। সমতল থেকে পাহাড়ি পথে পড়তেই দৃশ্যবদল। সবুজ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে পথ। কালো রাস্তাটি ছাড়া আশপাশের সবই সবুজ। নীল আকাশে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘ। ঘন কালো মেঘও স্থায়ী হচ্ছে কিছুক্ষণের জন্য—বৃষ্টির সম্ভাবনা নিয়ে। ভ্রমণে থাকা মানুষ দেখতে পেল, পথে-ঘাটে নেমে এসেছে মানুষ। এই মানুষের ভিড়েই কিছু মানুষকে কোলাকুলি করতে দেখে বোঝা গেল, ঈদের নামাজ শেষ হয়েছে।
৩.
থাকব মিলনছড়িতে গাইড ট্যুরের রিসোর্টে। বান্দরবান শহরে পৌঁছে অটোরিকশায় করে তিন মাইল দূরের রিসোর্টটিতে পৌঁছানো গেল দ্রুতই। ধাপের পর ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে ওদের রেস্তোরাঁয় বসার সঙ্গে সঙ্গেই বাটিতে করে এল সেমাই। ঠান্ডা জল। ঈদ উপলক্ষে খাবারটি রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের উপহার।
‘কখন বেড়াতে যাব?’—আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকা শিশুদের প্রশ্ন।
দলের কনিষ্ঠ সদস্যরা এরই মধ্যে দল পাকিয়ে ফেলেছে। ভ্রমণজনিত ক্লান্তির পর বড়রা যখন বিশ্রামের কথা ভাবছেন, তখনই শিশুরা জানিয়ে দিল, মাত্র তিন দিনের ছুটির একটি মুহূর্তও নষ্ট করা চলবে না। অতঃপর ঠিক করা চাঁদের গাড়িতে উঠে পড়া। গন্তব্য চিম্বুক পাহাড়। পথটি আকর্ষণীয়। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে গভীর খাদ। চিম্বুক পাহাড়ের নিচে এসে আমরা গাড়ি থেকে নেমে পড়ি। হেঁটে হেঁটে উঠি। একটু একটু করে উঠি, আর মনে হয় আকাশের সিঁড়ি ধরেই বুঝি উঠছি।
চিম্বুক থেকে ফেরার পথে ঢুকে পড়ি শৈলপ্রপাতে। এটি একটি পার্কের মতো জায়গা, ঝরনা নেমে এসেছে ওপর থেকে। বড় বড় পাথরের চাঁই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ক্ষীণ জলের ধারা ছুটে চলেছে। জল দেখেই আমাদের মনে হয় বান্দরবানের নদটি দেখব। তাই চলে যাই শঙ্খ নদে। নদটিকে সাঙ্গু নদও বলা হয়। এত স্বচ্ছ জলের নদ দেখা ভাগ্যের ব্যাপার। নৌকায় বসে জলের দিকে তাকালে দেখা যায় মাছের সাঁতার।
এরই মধ্যে আমরা জেনে ফেলেছি, বান্দরবানে আছে মুরং, ত্রিপুরা, বম, তঞ্চ্যঙ্গা, চাকমা, চাক, খ্যাং, খুমি, লুসাই ও পাঙ্খো আদিবাসীরা। বমপাড়ায় গিয়ে আমরা দেখে আসি ভাটিয়াপাড়া স্কুল। সেখানে বমদের বাড়িতে হূষ্টপুষ্ট মোরগ-মুরগি, শূকর দেখা গেল।
দুপুরে খাবার পর আবার যাত্রা। সঙ্গে হালকা খাবার। কক্ষ্যাংঝিরি থেকে নৌকায় করে রুমাবাজার। শঙ্খ নদ বেয়ে যেতে যেতে দুই তীরের জীবনযাত্রা দেখা যায়। রুমা বাজারে কিছুক্ষণ ঘোরার পরই সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে। আমরা নৌকায় উঠে বসি। ফিরতে হবে। ঈদের দিনটি এত অসাধারণ আনন্দের সঙ্গে কাটবে, তা কে জানত আগে! আফসোস থেকে যায়, নীলগিরি যাওয়া হলো না!
রাতে খাবার পর আমরা একটু হাঁটতে বের হই। একজন বলে ওঠে, আকাশের দিকে তাকাও!
যাঁরা হাঁটছিলেন, তাঁরা কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ান। আকাশে নক্ষত্রের মেলা! একসঙ্গে এত তারা কখনো কি কেউ দেখেছে! পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটতে থাকা মানুষেরা মাঝেমধ্যেই আকাশের দিকে তাকায় আর হয়তো ভাবে, ‘সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটির কথা হয়’ (জীবনানন্দ দাশ)।
এই বান্দরবানেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুটি শৃঙ্গ: তাজিনডং আর কেওক্রাডাং; কিন্তু তা অনেক দূরে। তিন দিনের ছোট ছুটিতে সেখানে পৌঁছানো যায় না। বেশি সময় নিয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে যাওয়ার জন্যও প্রস্তুতি শুরু হয় সেদিন থেকেই।
ঈদের ছুটিতে রাঙামাটি ও বান্দরবানে
অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের হাতছানি দেয় রাঙামাটি ও বান্দরবান। এই ঈদের ছুটিতে পরিবার-পরিজন, বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন এসব অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে। তার আগে জেনে নিন কয়েকটি ভ্রমণ সংস্থার ঠিকানা ও বিভিন্ন প্যাকেজ।
রিভার অ্যান্ড গ্রিন
বান্দরবান: এখানে প্রতিজন ঘুরে আসতে পারেন দুই রাত তিন দিনের প্যাকেজে। এতে খরচ পড়বে চার হাজার ৫০০ টাকা।
এর মধ্যে নন-এসি বাস, এসি বাস, সকালের নাশতা ও বেড়ানোর সময় গাইড-সুবিধা পাওয়া যাবে।
এ ছাড়া বান্দরবান ও নিলাগিরি দুই রাত তিন দিনের প্যাকেজে নন এসি বাসে করে যাওয়া, গাড়িতে ঘোরা ও থাকার ব্যবস্থাসহ প্রতিজন প্যাকেজের খরচ পড়বে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা।
রাঙামাটি: দুই রাত তিন দিনের প্যাকেজে ঢাকা থেকে নন-এসি বাস, নন-এসি রুম ও রাঙামাটির আশপাশে ঘুরতে প্রতিজন খরচ পড়বে তিন হাজার ৫০০ টাকা। ফোন: ৮৮২৬৭৫৯।
পেট্রো অ্যান্ড এভিয়েশন
বান্দরবান: ঢাকা-রাঙামাটি-ঢাকা দুই রাত তিন দিন প্রতিজন থাকা-খাওয়া চাহিদাভেদে তিন থেকে ছয় হাজার টাকা খরচ পড়বে।
রাঙামাটি: ঢাকা থেকে রাঙামাটি দুই রাত তিন দিন প্রতিজন থাকা-খাওয়া ও ঘুরে বেড়ানো চাহিদাভেদে দুই হাজার ৪৫০ থেকে সাত হাজার ৮০০ টাকা খরচ পড়বে। ফোন: ০১৭৩০০৪৩৬১৯।
বেঙ্গল ট্যুর: এই প্রতিষ্ঠানের আলাদাভাবে রাঙামাটি ও বান্দরবানের কোনো প্যাকেজ নেই। তবে দলবেঁধে বা পরিবার-পরিজন নিয়ে যেতে চাইলে তারা ব্যবস্থা করে দেয়। খরচটাও পড়বে চাহিদা অনুযায়ী। ফোন: ৮৮৫৭৪২৪।
জার্নি প্লাস: এই প্রতিষ্ঠানটিও রাঙামাটি ও বান্দরবান ঘুরে বেড়ানোর আয়োজন করে। তবে আলাদা কোনো প্যাকেজ নেই। যেতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন। ফোন: ৯৬৬০২৩৪।
জাহীদ রেজা নূর
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৭, ২০১০
Wednesday, August 11, 2010
খাগড়াছড়ির বাঁকে
খাগড়াছড়ির বাঁকে
আগেও অনেকবার পাহাড়ে, এমনকি খাগড়াছড়িতেও গিয়েছি, কিন্তু বর্ষায় পাহাড়ের সজীবতা দেখার ইচ্ছা ছিল অনেক দিন থেকেই। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে বৃষ্টিভেজা বন, সবুজ পাহাড় আর নদী দেখার জন্য আষাঢ়ের প্রথম দিনে রওনা হয়ে গেলাম খাগড়াছড়িতে।
যে রাস্তা দিয়ে খাগড়াছড়ি যেতে হয়, সেটাও দেখার মতো। রাঙামাটি অথবা বান্দরবানের মূল শহরে যাওয়ার চেয়ে খাগড়াছড়িতে যেতে অনেক বেশি পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হয়। এখানে যাওয়ার সময় শুধু পাহাড় নয়; ঝরনা, প্যাগোডা, জুমঘরসহ অনেক কিছুই চোখে পড়বে।
তাই রাস্তায় চোখ খোলা রেখে যেখানে ইচ্ছা থেমে ছবি তুলতে শুরু করে দিলাম। বৃষ্টির সময় পাহাড়গুলোকে সবুজরূপে দেখা গেল। নদী ও ঝরনাগুলোও পরিপূর্ণ প্রমত্ত রূপ নিয়ে হাজির। পথে বেশ কিছু প্যাগোডাও চোখে পড়ল। তবে দিনের আলো থাকতে থাকতে পৌঁছানোর তাড়া থাকায় বেশিক্ষণ থামা গেল না।
পাহাড়ের কোলে দূরে একটি জুমঘর অথবা দূরে পাহাড়ের চূড়ায় কর্মরত পাহাড়িদের দেখতে দেখতে চলে এলাম খাগড়াছড়িতে ঢোকার প্রবেশপথে। আলুটিলাতে স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞাসা করেও নামকরণের শানে নজুল জানা গেল না। তবে এটুকু জানা গেল, আলুটিলা পার্ক ও এর মধ্যে অবস্থিত গুহা প্রধান পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম।
আলুটিলার গুহাটি পানির স্রোতের কারণে সৃষ্টি। এই গুহার মধ্য দিয়ে পাহাড়ের এক পাশ থেকে আরেক পাশে হেঁটে যাওয়া যায়। এখানে গাইড আছে, মশালও কিনতে পাওয়া যায়। সুতরাং মশাল জ্বালিয়ে গাইডের সঙ্গে আমরা চলে গেলাম হাঁটু পানি ভেঙে গুহার ভেতরে। প্রায় ২৫ থেকে ৩০ মিনিট গুহার ভেতর দিয়ে হাঁটার পর বেরিয়ে এলাম অন্যদিকে, গা ছমছম করা এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, ঝড়বৃষ্টির সময় গুহাতে পানির স্রোত অনেক বেশি থাকে এবং মাঝেমধ্যে পুরো গুহা পানিতে ভরে যায়। সে জন্য আকাশ দেখে ঢোকা উচিত। এখানে একটি পিকনিক স্পটও আছে, ভাড়া নিয়ে এটা ব্যবহার করা যায়।
আলুটিলা ঘুরে আমরা হোটেল থেকে হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম শহরে ঘুরতে। সৌভাগ্য যে আমাদের, চাকমা বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসেছিলাম। তারা আমাদের প্রথমেই নিয়ে গেল মারমাদের একটি রেস্তোরাঁ ‘সিস্টেম ফ্যামিলি হোটেল’-এ খাওয়ার জন্য।
কখনো ভাবিনি এ রকম একটি ঘরোয়া রেস্তোরাঁ পাব খাগড়াছড়িতে এসে। অনেক বাঙালিও এখানে প্রতিদিন খাওয়ার জন্য আসেন। এখানে বাঙালি খাবারের পাশাপাশি পাহাড়ি খাবারও পাওয়া যায়। আমরা যে যার মতো খেয়ে নিলাম। যেমন, কেউ কপি বাঁশের তরকারি ও মুরগির ঝোল, আবার অনেকে আগ্রহ নিয়ে পাহাড়ি রান্না খেল। যারা ঝাল সহ্য করতে পারে, তাদের জন্য সুবিধা হবে খেতে। কারণ, পাহাড়ি রান্না ঝাল ছাড়া কল্পনাই করা যায় না।
এরপর চলে গেলাম চেঙ্গি নদীর তীরে সময় কাটাতে। বৃষ্টির সময় না এলে চেঙ্গির আসল রূপ দেখা যায় না। সমতলের নদী থেকে এটা পুরো আলাদা—অনেক বেশি বাঁক আর স্রোত। বৃষ্টির পরে প্রমত্তা নদীতে গাছের গুঁড়ি, বাঁশ চোখে পড়ল। তবে বৃষ্টি শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরই চেঙ্গি নদী আবার তার শান্ত রূপে ফিরে এল।
রাতে আমরা জামতলার একটি চাকমা হোটেলে গেলাম। এখানে আমাদের চাকমা বন্ধুদের পরামর্শে ভুনা শামুক খেলাম, চিংড়ি মাছের মতো খেতে। তবে বেশি মিল পাবেন কাঁকড়ার স্বাদের সঙ্গে।
পরদিন সকালে উঠে রওনা দিলাম ছোট মেরুং বাজারের দিকে। এখান থেকে আরও ভেতরে গিয়ে জুম চাষ দেখলাম এবং জুমঘরে বসে পাহাড়ি চাষি ও বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করলাম। এখানকার বেশির ভাগ আদিবাসী সরাসরি জুম চাষের সঙ্গে জড়িত। জুমে প্রথমে পাহাড় পুড়িয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে তার গর্ত করে, প্রতিটি গর্তে তিন থেকে চার-পাঁচ ধরনের বীজ বপন করা হয়। প্রধানত ধান, ভুট্টা, শসা ও বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ পাহাড়িদের মধ্যে জনপ্রিয়। জুমের মিষ্টি ভুট্টা পাহাড়িরা সেদ্ধ করে খায়, আমরাও খাওয়া শুরু করে দিলাম। পাহাড়িরা বিশেষ এক ধরনের সবজি রান্না করে ৩২ ধরনের তরকারি দিয়ে, সেই পাচন খেলাম আমরা সবাই। বিকেলে চেঙ্গি নদীতে নৌকা ভ্রমণ করে পুরো শহরের এক পাশ দিয়ে ঘুরে এলাম। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে নদীভ্রমণ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। যাঁরা খাগড়াছড়িতে ঘুরতে যাবেন, তাদের প্রতি অনুরোধ রইল, একবার অবশ্যই এটি চেষ্টা করে দেখবেন।
শহরের ভেতরে অসাধারণ সুন্দর পাহাড় আর ধানখেত থাকার কথা শুনে সেদিকে গেলাম। জায়গাটার নাম নিউজিল্যান্ড পাড়া। জানা গেল, অনেক আগে এক পাহাড়ি ভদ্রলোক এই এলাকা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, ‘নিউজিল্যান্ডের মতো বাতাস;’ সেই থেকে এলাকার নাম হয়ে গেছে নিউজিল্যান্ড পাড়া। আমাদের মধ্যে তর্ক শুরু হয়ে গেল, যিনি নামটা রেখেছেন, তিনি আদৌ নিউজিল্যান্ডে গিয়েছেন কি না। স্থানীয় বন্ধুদের কাছ থেকে জানা গেল, না, তিনি কখনো নিউজিল্যান্ডে যাননি। তিনি ক্রিকেট খেলা দেখতেন, তা থেকে ধারণা করেছেন, নিউজিল্যান্ডে প্রচুর বাতাস।
এখানে নিউজিল্যান্ড ক্যাফে নামের একটি রেস্তোরাঁ আছে। তাজা ফলের শরবত এবং নানা ধরনের স্ন্যাক্স পাবেন এখানে, ফ্রেঞ্চফ্রাই থেকে শুরু করে হালিম পর্যন্ত। তবে যাওয়ার আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য। চার বন্ধুর উদ্যোগে শুরু এই রেস্তোরাঁয় সামনের বার এলে ইন্টারনেটও পাওয়া যাবে বলে জানানো হলো আমাদের।
এই মৌসুমে আসার আরেকটা সুবিধা হলো তাজা, সস্তা ফল। শহরে ঢোকার ঠিক আগে প্রাকৃতিক পরিবেশে আনসারদের একটি অসাধারণ সুন্দর রেস্তোরাঁ আছে। এখানে সব সময় খাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও বসে চেঙ্গি নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করলাম প্রতিদিন।
কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি খাগড়াছড়িতে যাওয়ার বাস আছে। এই বাসগুলো প্রথমে চট্টগ্রামে না গিয়ে সরাসরি ফেনী থেকে রামগড় হয়ে খাগড়াছড়িতে চলে যায়। শান্তি পরিবহন, সৌদিয়া ও এস আলমের সরাসরি বাস আছে। টিকিটের দাম ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে। বাসে সরাসরি যেতে আট ঘণ্টার মতো সময় লাগে। ট্রেন বা প্লেনে চট্টগ্রামে গিয়ে, সেখান থেকেও বাসে যাওয়া যায়, তবে ট্রেনে সময় বেশি লাগবে। থাকার জন্য পর্যটনের হোটেল আছে। খুবই সুন্দর, নদীর ঠিক পাশে। ভাড়া পড়বে দেড় হাজার টাকা, ডাবল বেড এসি রুম। এ ছাড়া শৈল সুবর্ণা আছে, ভাড়া একটু বেশি। শহরের মধ্যে আছে হোটেল জিরান। চাকমা আতিথেয়তা পেতে হলে এখানে থাকতে পারেন। এখানে এসি রুম নেই, ভাড়াও অনেক কম, ৩০০-৫০০ টাকার মধ্যে ডাবল রুম আছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের আরও কিছু হোটেল আছে বিভিন্ন ভাড়ার মধ্যে।
আসিফ মাহফুজ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২০, ২০১০
Sunday, August 8, 2010
বেড়ানো : জামালপুর
হযরত শাহ জামাল-এর (র) সমাধি:
জামালপুর শহরে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের পাশে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত এ অঞ্চলের সাধক পুরুষ হযরত শাহ জামাল-এর (র) সমাধি। একটি সমাধিক্ষেত্র ছাড়াও পুরনো একটি মসজিদ আছে এখানে।
দয়াময়ী মন্দির
জামালপুর শহরের জিরো পয়েন্টের কাছে অবস্থিত প্রাচীন মন্দির। প্রাচীন ও আধুনিক স্থাপত্য রীতির সংমিশ্রণে এ মন্দিরটি নির্মিত। প্রতিবছর অষ্টমী পূজা উপলক্ষ্যে এখানে প্রচুর লোক সমাগম হয়।
হস্তশিল্পের দোকান
জামালপুর হস্তশিল্পের জন্য বিখ্যাত। এ শহরে তাই হস্তশিল্পের বিপণিবিতানও অনেক। শহরের আশিক মাহমুদ কলেজ সড়কে এরকম অনেক বিক্রয় কেন্দ্র আছে, যেখানে অনেক কম দামে পাওয়া যাবে জামালপুরের বিখ্যাত নকশি কাঁথা ও সূচিকর্মের বিভিন্ন সামগ্রী।
হযরত শাহ কামাল-এর (র) সমাধি:
জেলার মোলান্দহ উপজেলার দুরমুট ইউনিয়নে ব্্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত হযরত শাহ কামাল-এর (র) সমাধি। এ অঞ্চলের বিস্তর্ীর্ণ এলাকা ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে বিলীন হলেও এ সমাধিক্ষেত্রটি আজও টিকে আছে। বৈশাখ মাসের শুরু থেকে এখানে মাসব্যাপি ওরস অনুষ্ঠিত হয়। ওরস উপলক্ষে পুরো মাসজুড়ে এখানে গ্রামীণ মেলা বসে। জামালপুর সদর থেকে বাস ও ট্রেনে সহজেই অঅসা যায় এখানে।
লাউচাপড়া
জামালপুর জেলার বকশিগঞ্জের লাউচাপড়ায় অবস্থিত পাহাড়িকা অবকাশ কেন্দ্র। এখানে চারিদিকে গারো পাহাড়ের সবুজ বন। পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা একটি সিঁড়ি উঠে গেছে একেবারে চূড়ায়। সেখানে আবার রয়েছে মস্ত বড় এক ওয়াচ টাওয়ার। দশ-বারোটি সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলে চারিদিকে সবুজ ছাড়া কিছুই আর চোখে পড়ে না। দূরে দেখা যায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের আকাশছোঁয়া সব পাহাড়। চারিদিকটা যেন ছবির মতো। এই পাহাড়ি জঙ্গলে আছে নানা জাতের পশু-পাখি। ধান পাকার মৌসুমে আবার মেঘালয় থেকে চলে আসে বুনো হাতির দল। কাঠঠোকরা, হলদে পাখি, কালিম পাখি আরো কত ধরনের পাখি চোখে পড়বে এখানে। পুরো জায়গাটি অবসর বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছে জামালপুর জেলা পরিষদ। এ অবসর কেন্দ্রে প্রবেশে কোনো টাকা লাগে না। তবে কোনো বাহন নিয়ে গেলে তার জন্য পার্কিং ফি দিতে হবে। পার্কিং ফি প্রতিটি বাস কিংবা কোস্টারের জন্য ২০০ টাকা, মাইক্রোবাস ১০০ টাকা, জিপ, টেম্পো, কার ৫০ টাকা, বেবি টেক্সি, ঘোড়ার গাড়ি ২০ টাকা, মোটর সাইকেল, ভ্যান গাড়ি ১০ টাকা, রিকশা ৫ টাকা, বাই সাইকেল ২ টাকা। এছাড়া লেকে নৌ বিহার করতে জনপ্রতি লাগবে ১০ টাকা, ওয়াচ টাওয়ারে উঠতে ৩ টাকা এবং পিকনিক পার্টির রান্নাঘর ও প্রতি চুলা ব্যবহারের জন্য দিতে হবে ৫০ টাকা।
দিকলাকোনা নামে এখানে আছে গারো আদিবাসীদের ছোট্ট একটি গ্রাম। এ গ্রামে বাইশ পরিবারে রয়েছে একশ জন গারো। তারা সবাই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। এ গ্রামের মাতব্বর প্রীতি সন সারমা। ভীষণ সদালাপি এ লোকটির আতিথেয়তায় মুগ্ধ হবেন যে কেউ। প্রতিবছর বড়দিন, ইংরেজি নববর্ষ, ইস্টার সানডে উপলক্ষে এ গ্রামে হয় নানা উৎসব।
দিকলাকোনা গ্রামের শুরুতেই রয়েছে 'দিকলাকোনা সালগিত্তাল হোস্টেল'। খ্রিস্টান মিশনারিজ পরিচালিত এ হোস্টেলে প্রথম শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণীর প্রায় ৭০জন ছাত্র-ছাত্রী থাকে। এখান থেকে শুরু করে গ্রামটি ঘুরে ফিরে গারোদের দৈনন্দিন জীবনের নানান কাজ কর্ম উপভোগ করতে পারেন।
লাউচাপড়ায় রাত কাটানো হতে পারে স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। এখানকার শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ রাতে যেন আরো শান্ত, আরো সি্নগ্ধ। রাতে এখানে থাকার জন্য দুটি রেস্ট হাউস অছে। একটি জামালপুর জেলা পরিষদের পাহাড়িকা বাংলো এবং অন্যটি ব্যক্তি মালিকানাধীন বনফুল রিসর্ট। জেলা পরিষদের রেস্ট হাউসে থাকতে হলে আগে থেকে অনুমতি নিয়ে আসতে হবে। যোগাযোগ করতে হবে প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা, জেলা পরিষদ, জামালপুর। ফোন- ০৯৮১-৬২৭১৬, ০৯৮১-৬৩৫১৪, ০৯৮১-৬৩২৪০। তবে বেসরকারি বনফুল রিজর্টটি আরো বেশি সজ্জিত ও সুযোগ-সুবিধা সংবলিত। নিরাপত্তাও এখানে তুলনামূলক অনেক বেশি। এই রিসর্টে সাধারণ কক্ষের ভাড়া ১০০০ টাকা এবং তাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষের ভাড়া ১৫০০ টাকা।
জায়গাটি জামালপুর জেলার অধীনে হলেও যাওয়ার সহজপথ হলো শেরপুর হয়ে। ঢাকা থেকে সরাসরি শেরপুরে যায় ড্রিমল্যান্ড পরিবহনের বাস। ভাড়া ১৮০-২০০ টাকা। শেরপুর থেকে বাসে বকশীগঞ্জের ভাড়া জনপ্রতি ২৫ টাকা। সেখান থেকে রিকশা কিংবা ভ্যানে লাউচাপড়ার ভাড়া জনপ্রতি ৩০-৪০ টাকা।
জেলা শহরে কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়ক ও রেল পথে আসা যায় জামালপুর। তবে সড়কপথের চেয়ে রেলপথটাই সুবিধাজনক। ঢাকার কমলাপুর থেকে আন্তঃনগর তিস্তা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও অগি্নবীনা ট্রেন যায় জামালপুর। ভাড়া প্রথম শ্রেণী ১৫০ টাকা এবং সাধারণ শ্রেণী ৫০-৮০ টাকা।
ঢাকার মহাখালী বাস স্টেশন থেকে মহানগর ও রাজীব পরিবহনের বাস সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আধাঘণ্টা পরপর ছেড়ে যায়। ভাড়া ১৬০-১৮০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে প্রতিনিধি পরিবহন, সিলেট থেকে শাহজামাল পরিবহন, রাজশাহী ও বগুড়া থেকে পদ্মা পরিবহনের বাসে সরাসরি জামালপুর আসা যায়।
কোথায় থাকবেন
জামালপুর শহরে থাকার জন্য বেশ কিছু হোটেল আছে। শহরের সবচেয়ে ভালো হোটেল সকাল বাজারে হোটেল স্টার ইন্টারন্যাশনাল, ফোন- ০১৭১৩২১১৪৯৪। এ হোটেল শীতাতপ নিয়ান্ত্রিত ও সাধারণ মানের কক্ষ আছে। ভাড়া ৪০০-১২০০ টাকা। এছাড়া শহরের অন্যান্য সাধারণ মানের হোটেল হলো: গেইট পাড়ে হোটেল আল সিরাজ, ফোন-০৯৮১-৬২৫৯২। গেইেট পাড়ে হোটেল রাসেল, ফোন- ০৯৮১-৬৩২৯৪। স্টেশন রোডে হোটেল আল করিম, ফোন-০১৭১৬০৩৬৮০৮। মেডিকেল রোডে হোটেল সানোয়ার ইন্টারন্যাশনাল, ফোন- ০১৭২৫২৪৬৯৬০। পুরাতন বাস স্টেশনে হোটেল আল সামাদ, ফোন- ০৯৮১-৬৩৪০১"এসব হোটেলে ২০০-৫০০ টাকায় থাকা যাবে।