বর্ষায় বাংলার দার্জিলিং
- রফিকুল আমীন খান
রাজধানীর ফকিরাপুলের দূরপাল্লার বাস কাউন্টারগুলোতে সারাদিনই যাত্রীদের ভিড় লেগে থাকে। তবে এই বৃষ্টির দিনেও যাত্রীর এত সমাগম হবে ভাবিনি। টানা তিন দিনের বর্ষণে মালিবাগ ও রাজারবাগের কোমর সমান পানি কেটে যখন ফকিরাপুলের শ্যামলীর কাউন্টারে পৌঁছলাম তখন রাত ১০টা। বান্দরবানের একমাত্র গাড়িটি ছাড়ার এখনও ৩০ মিনিট বাকি। আমাদের পনের জনের গ্রুপটির এখনও অনেকেই এসে পৌঁছেনি। মুঠোফোনে খোঁজ নিয়ে জানা গেল দু’তিনজন যাচ্ছে না। এরকম খারাপ আবহাওয়ায় বান্দরবান যেতে দিতে কিছুতেই তাদের বাবা-মা রাজি নন। সে যাই হোক, ১০টা ২৫ মিনিটে আমাদের গ্রুপটি বাসে উঠতেই চালক ঠিক সময়েই বাস ছেড়ে দিলেন।
এত খারাপ আবহাওয়ার মাঝেও যাদের উত্সাহে আমরা এবারের গ্রীষ্মের ছুটিটা বান্দরবানে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সেই নোঙর ট্যুরিজমের কামরুল ভাই কথামত ঠিক সামনের দিকের ১৫টি সিট আমাদের জন্য আগেই বুকিং করে রেখেছিলেন। ফলে এরকম খারাপ আবহাওয়ার মাঝে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে বাসের চাকার হঠাত্ লাফিয়ে ওঠার ঝাঁকুনি থেকে সামান্য হলেও রক্ষা পাওয়া যাবে ভেবে ভালো লাগল। এরকম ভাবনার মাঝে কখন যে বাস চলতে শুরু করেছে খেয়াল করিনি। খোলা জানালা দিয়ে ফকিরাপুল থেকে কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত খানাখন্দে ভরা সড়কের জায়গায় জায়গায় হাঁটু সমান কাদাপানি কেটে বাসের ছুটে চলা দেখতে দেখতে কখন যে দু’চোখজুড়ে ঘুম চলে এসেছে খেয়াল করিনি। মাঝে দু’একবার ঘুম ভাঙলেও অন্যদের বেঘোরে ঘুমোতে দেখে খানিক জেগে থেকে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। সকালের বৃষ্টিভেজা সতেজ আলোতে যখন ঘুম ভাঙল তখন আমাদের বহনকারী বাসটি দু’পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ছুটে চলেছে। আমরা এখন কোথায়, কামরুল ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলে জানালেন, সাতকানিয়ার কেরানিহাট থেকে বান্দরবান শহরে যাওয়ার মাঝামাঝি রাস্তায়। শহরে পৌঁছতে আরও ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে।
বাস টিলা-উপটিলার মতো ছোটখাটো পাহাড় ডিঙিয়ে ছুটে চলছে। হঠাত্ অঝোরে বৃষ্টি নামল। খানিক বাদে চালকের গিয়ার পরিবর্তনের শব্দে সামনে তাকালাম। দেখলাম সামনের রাস্তা আকাশ ছুঁয়েছে। পাহাড় বেয়ে নামা বৃষ্টির পানি তীব্রবেগে সোজা বাসের দিকে ছুটে আসছে। চালকের একটু ভুল ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ পরিণতি। ভেজা সড়ক থেকে চাকা পিছলে সোজা কয়েকশ’ ফুট নিচে... ভাবতেই মেরুদণ্ডের মাঝখান দিয়ে শীতল রক্তস্রোত বয়ে গেল। তবে চালক বেশ সতর্ক। দক্ষ হাতে কয়েক মিনিটের মধ্যে গাড়ি পাহাড় চূড়ায় নিয়ে পৌঁছলেন। চূড়ায় পৌঁছতেই চারপাশের প্রকৃতি বেশ পরিচিত লাগল। বাম পাশে মেঘলা পর্যটন মোটেলকে পেছনে ফেলে বাস যখন আরেকটু উপরে উঠল, তখন বুঝতে বাকি রইল না এটা কোন জায়গা। আমরা মেঘলা পাহাড়ের উপর। বান্দরবান ভ্রমণকারীদের অন্যতম পছন্দের জায়গা। এ পাহাড় চূড়ায় রয়েছে অনিন্দ্য সুন্দর মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স, যা সারা বছরই পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত থাকে। বান্দরবান বেড়াতে এসে কেউ এর সৌন্দর্য না দেখে ফেরেন না। এর আসল সৌন্দর্য পাহাড়ঘেরা সর্পিলাকার স্বচ্ছ পানির লেক ও দু’টি ঝুলন্ত ব্রিজ। অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে ব্রিজ দুটির কাছাকাছি যেতে হয়। ব্রিজ পার হওয়া অনেক আনন্দের। পাশে প্রিয়জন থাকলে কথা নেই, তার হাতে হাত রেখে যখন ওপারে চলবেন তখন স্মৃতির ফ্রেমে বাসা বাঁধবে নানা বর্ণের স্বর্গীয় সুখের অনুভূতি।
বান্দরবানে আমাদের দুই দিনের সংক্ষিপ্ত ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনের বিকালটা রাখা হয়েছে এই মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স দর্শনের জন্য। তাই এ নিয়ে ভাবনার বেশি সময় না দিয়ে চালক বাস নিয়ে ছুটে চললেন সোজা শহরের দিকে। মেঘলার চূড়া থেকে সমতলের দিকে তাকালে মনে হবে বিশাল এক অজগর এঁকে-বেঁকে নেমে গেছে শহরের দিকে। আসলে এটি শহরে যাওয়ার রাস্তা। মেঘলা চূড়া থেকে সবুজ বেষ্টনীর মাঝে দু’একটি দালান-কোঠায় ভরা শহরটিকে বেশ ছোটই মনে হয়। শহরের মতো বাসস্ট্যান্ডটিও বেশ ছোট। এখানে বাস থেকে নেমে কাছেই হোটেলের উদ্দেশে ছুটে চললাম আমরা। হোটেলে পৌঁছে ঝটপট নাস্তাসহ প্রয়োজনীয় কাজ সেরে শুরু হলো বান্দরবানে আমাদের এবারের ভ্রমণ।
সকালের শিডিউলে রয়েছে নীলগিরি, চিম্বুক ও পাহড়ি ঝরনা শৈলাপ্রপাত দর্শন। তিনটিই একই পথে। তবে সব শেষে নীলগিরি। ঠিক হলো সবার আগে নীলগিরি, ফিরতি পথে বাকি দু’টি দর্শন। পরিকল্পনামত সাড়ে নয়টার দিকে চান্দের গাড়িতে চড়ে বসলাম। পাহাড়ের কোলঘেঁষে বহু চড়াই-উতরাই, ছড়া-ঝরনা পেছনে ফেলে ছুটে চললাম নীলগিরির অপার সৌন্দর্যের টানে। দু’পাশের সবুজ ছাউনি আর দূর-বহুদূরে পাহাড়ের চূড়ায় খেলা করা মেঘেদের মেলা দেখছিলম বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে। হঠাত্ বাঁয়ে পাহাড়ি নদ সাঙ্গুর মাথার ওপর কোথা থেকে যেন একদলা কালোমেঘ এসে জমাট বেঁধেছে। বুঝতে বাকি রইল না কী হতে চলেছে। মেঘ ফুঁড়ে শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। বলা নেই কওয়া নেই, খানিক বাদে সেই বৃষ্টি ধেয়ে এসে পাহাড়ের উপর আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে গেল। এই হলো বর্ষায় বান্দরবানের রূপ। এই রোদ, এই বৃষ্টি। রোদ-বৃষ্টির এরকম বিচিত্র খেলা আর সাঙ্গু নদের চোখজুড়ানো সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের নীলগিরিতে, যেখানে পাহাড় ছুঁয়েছে আকাশকে। মনে পড়ল কবিগুরুর সেই বিখ্যাত কবিতার কথা—
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।
ভূমি থেকে নীলগিরির উচ্চতা ৩ হাজার ফুট। উচ্চতার কারণে বর্ষায় বান্দরবান বেড়ানোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা এই নীলগিরি। এর চারপাশে মেঘেরা খেলা করে। যারা প্রকৃতির এই খেলা খুব কাছে থেকে দেখতে চান তারা একটা রাত থেকে যেতে পারেন সেনাবাহিনী পরিচালিত কটেজে। এর পাশে খাবারের জন্য রয়েছে ভালোমানের রেস্টুরেন্ট। এখানে বসে পেট পুরে খেতে খেতে ডানে-বাঁয়ে চোখ বুলালে দূর-বহুদূরে দেখতে পাবেন দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাহাড় কেওক্রাডং, পাহাড় চূড়ার বগা লেক, কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর।
নীলগিরির সৌন্দর্য লিখে শেষ করার নয়। আমাদের লক্ষ্য এবার বাংলার দার্জিলিং চিম্বুকের দিকে। শহর থেকে এর দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার। এর ২৫শ’ ফুট উচ্চতায় না উঠলে বান্দরবান ভ্রমণের মূল আনন্দই অধরা থেকে যাবে আপনার। বর্ষা মৌসুমে এর পাশ দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘ দেখে মনে হয় মেঘের স্বর্গরাজ্য। মেঘের হালকা হিম ছোঁয়া মেঘ ছোঁয়ার অনুভূতি এনে দেয় মনে। পর্যাপ্ত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত ও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ আরও উন্নত করা গেলে চুম্বকের সৌন্দর্য ভারতের দার্জিলিংয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম হতো না মনে করেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। তাই একে তারা বাংলার দার্জিলিং বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আমরা এর চূড়ায় পৌঁছে ম্রোদের হাতে তৈরি এক কাপ চা খেয়ে নিজেকে চাঙ্গা করে ফের হোটেল অভিমুখে রওনা দিলাম। পথে পাহাড়ি ঝরনা শৈলাপ্রপাতে ১০ মিনিটের যাত্রাবিরতি। স্থানীয় কয়েক বাম উপজাতি তরুণ জানালেন, বর্ষায় শ্যাঁওলাধরা এ পাথুরে ঝরনায় নামা খুবই বিপজ্জনক।
বিকালের পুরো সময়টা আমরা হোটেল ও এর আশপাশে কাটিয়ে দিলেও বন্ধু হালিম তার নববধূকে নিয়ে এক ফাঁকে স্বর্ণমন্দির ঘুরে এলো। আমাদের মধ্যে ওরাই একমাত্র নবদম্পতি। আমরা চেয়েছিলাম ওদের নিজেদের মতো ঘোরার জন্য আলাদা একটা সময় বের করে দিতে। প্রথমে ওরা একটু ইতস্তত করলেও পড়ন্ত বিকালে আসমা ভাবীর ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি দেখে মনে হলো ওরা সময়টা ভালোই কাটিয়েছে।
দ্বিতীয় দিন রাতে আমাদের ফেরার পালা। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। নিজেদের এদিন কোনো শক্ত শিডিউলে বেঁধে রাখতে মন চাইল না। সকালের সময়টা যে যার মতো কাটিয়ে বিকালে নীলাচল ও মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স ঘুরে রাতে ঢাকার পথ ধরলাম। পেছনে রয়ে গেল বর্ষাস্নাত দু’টি দিনের সেই বিমুগ্ধ স্মৃতি। যে স্মৃতিতে বর্ষা এলে বারবার হারিয়ে যায় মন। আবার ছুটে যেতে চায় বাংলার দার্জিলিংয়ের টানে।
বান্দরবানের পথে ঢাকার ফকিরাপুল ও সায়েদাবাদ থেকে শ্যামলী, সৌদিয়া, ডলফিন পরিবহনের কয়েকটি গাড়ি রাতে ছেড়ে যায়। ভাড়া ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। যারা সেখানে যেতে যান, নিজেরা উদ্যোগী হয়ে কিংবা বেড়ানোর জন্য কোনো ভ্রমণ আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠানের প্যাকেজে নাম লেখাতে পারেন। আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়া, সাইট সিং সব ব্যবস্থাই করে এ প্রতিষ্ঠানগুলো। নোঙর ট্যুরিজম এ ধরনের একটি প্যাকেজের আয়োজন করেছে।
Source: Daily Amardesh
এত খারাপ আবহাওয়ার মাঝেও যাদের উত্সাহে আমরা এবারের গ্রীষ্মের ছুটিটা বান্দরবানে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সেই নোঙর ট্যুরিজমের কামরুল ভাই কথামত ঠিক সামনের দিকের ১৫টি সিট আমাদের জন্য আগেই বুকিং করে রেখেছিলেন। ফলে এরকম খারাপ আবহাওয়ার মাঝে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে বাসের চাকার হঠাত্ লাফিয়ে ওঠার ঝাঁকুনি থেকে সামান্য হলেও রক্ষা পাওয়া যাবে ভেবে ভালো লাগল। এরকম ভাবনার মাঝে কখন যে বাস চলতে শুরু করেছে খেয়াল করিনি। খোলা জানালা দিয়ে ফকিরাপুল থেকে কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত খানাখন্দে ভরা সড়কের জায়গায় জায়গায় হাঁটু সমান কাদাপানি কেটে বাসের ছুটে চলা দেখতে দেখতে কখন যে দু’চোখজুড়ে ঘুম চলে এসেছে খেয়াল করিনি। মাঝে দু’একবার ঘুম ভাঙলেও অন্যদের বেঘোরে ঘুমোতে দেখে খানিক জেগে থেকে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। সকালের বৃষ্টিভেজা সতেজ আলোতে যখন ঘুম ভাঙল তখন আমাদের বহনকারী বাসটি দু’পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ছুটে চলেছে। আমরা এখন কোথায়, কামরুল ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলে জানালেন, সাতকানিয়ার কেরানিহাট থেকে বান্দরবান শহরে যাওয়ার মাঝামাঝি রাস্তায়। শহরে পৌঁছতে আরও ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে।
বাস টিলা-উপটিলার মতো ছোটখাটো পাহাড় ডিঙিয়ে ছুটে চলছে। হঠাত্ অঝোরে বৃষ্টি নামল। খানিক বাদে চালকের গিয়ার পরিবর্তনের শব্দে সামনে তাকালাম। দেখলাম সামনের রাস্তা আকাশ ছুঁয়েছে। পাহাড় বেয়ে নামা বৃষ্টির পানি তীব্রবেগে সোজা বাসের দিকে ছুটে আসছে। চালকের একটু ভুল ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ পরিণতি। ভেজা সড়ক থেকে চাকা পিছলে সোজা কয়েকশ’ ফুট নিচে... ভাবতেই মেরুদণ্ডের মাঝখান দিয়ে শীতল রক্তস্রোত বয়ে গেল। তবে চালক বেশ সতর্ক। দক্ষ হাতে কয়েক মিনিটের মধ্যে গাড়ি পাহাড় চূড়ায় নিয়ে পৌঁছলেন। চূড়ায় পৌঁছতেই চারপাশের প্রকৃতি বেশ পরিচিত লাগল। বাম পাশে মেঘলা পর্যটন মোটেলকে পেছনে ফেলে বাস যখন আরেকটু উপরে উঠল, তখন বুঝতে বাকি রইল না এটা কোন জায়গা। আমরা মেঘলা পাহাড়ের উপর। বান্দরবান ভ্রমণকারীদের অন্যতম পছন্দের জায়গা। এ পাহাড় চূড়ায় রয়েছে অনিন্দ্য সুন্দর মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স, যা সারা বছরই পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত থাকে। বান্দরবান বেড়াতে এসে কেউ এর সৌন্দর্য না দেখে ফেরেন না। এর আসল সৌন্দর্য পাহাড়ঘেরা সর্পিলাকার স্বচ্ছ পানির লেক ও দু’টি ঝুলন্ত ব্রিজ। অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে ব্রিজ দুটির কাছাকাছি যেতে হয়। ব্রিজ পার হওয়া অনেক আনন্দের। পাশে প্রিয়জন থাকলে কথা নেই, তার হাতে হাত রেখে যখন ওপারে চলবেন তখন স্মৃতির ফ্রেমে বাসা বাঁধবে নানা বর্ণের স্বর্গীয় সুখের অনুভূতি।
বান্দরবানে আমাদের দুই দিনের সংক্ষিপ্ত ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনের বিকালটা রাখা হয়েছে এই মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স দর্শনের জন্য। তাই এ নিয়ে ভাবনার বেশি সময় না দিয়ে চালক বাস নিয়ে ছুটে চললেন সোজা শহরের দিকে। মেঘলার চূড়া থেকে সমতলের দিকে তাকালে মনে হবে বিশাল এক অজগর এঁকে-বেঁকে নেমে গেছে শহরের দিকে। আসলে এটি শহরে যাওয়ার রাস্তা। মেঘলা চূড়া থেকে সবুজ বেষ্টনীর মাঝে দু’একটি দালান-কোঠায় ভরা শহরটিকে বেশ ছোটই মনে হয়। শহরের মতো বাসস্ট্যান্ডটিও বেশ ছোট। এখানে বাস থেকে নেমে কাছেই হোটেলের উদ্দেশে ছুটে চললাম আমরা। হোটেলে পৌঁছে ঝটপট নাস্তাসহ প্রয়োজনীয় কাজ সেরে শুরু হলো বান্দরবানে আমাদের এবারের ভ্রমণ।
সকালের শিডিউলে রয়েছে নীলগিরি, চিম্বুক ও পাহড়ি ঝরনা শৈলাপ্রপাত দর্শন। তিনটিই একই পথে। তবে সব শেষে নীলগিরি। ঠিক হলো সবার আগে নীলগিরি, ফিরতি পথে বাকি দু’টি দর্শন। পরিকল্পনামত সাড়ে নয়টার দিকে চান্দের গাড়িতে চড়ে বসলাম। পাহাড়ের কোলঘেঁষে বহু চড়াই-উতরাই, ছড়া-ঝরনা পেছনে ফেলে ছুটে চললাম নীলগিরির অপার সৌন্দর্যের টানে। দু’পাশের সবুজ ছাউনি আর দূর-বহুদূরে পাহাড়ের চূড়ায় খেলা করা মেঘেদের মেলা দেখছিলম বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে। হঠাত্ বাঁয়ে পাহাড়ি নদ সাঙ্গুর মাথার ওপর কোথা থেকে যেন একদলা কালোমেঘ এসে জমাট বেঁধেছে। বুঝতে বাকি রইল না কী হতে চলেছে। মেঘ ফুঁড়ে শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। বলা নেই কওয়া নেই, খানিক বাদে সেই বৃষ্টি ধেয়ে এসে পাহাড়ের উপর আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে গেল। এই হলো বর্ষায় বান্দরবানের রূপ। এই রোদ, এই বৃষ্টি। রোদ-বৃষ্টির এরকম বিচিত্র খেলা আর সাঙ্গু নদের চোখজুড়ানো সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম স্বপ্নের নীলগিরিতে, যেখানে পাহাড় ছুঁয়েছে আকাশকে। মনে পড়ল কবিগুরুর সেই বিখ্যাত কবিতার কথা—
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।
ভূমি থেকে নীলগিরির উচ্চতা ৩ হাজার ফুট। উচ্চতার কারণে বর্ষায় বান্দরবান বেড়ানোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা এই নীলগিরি। এর চারপাশে মেঘেরা খেলা করে। যারা প্রকৃতির এই খেলা খুব কাছে থেকে দেখতে চান তারা একটা রাত থেকে যেতে পারেন সেনাবাহিনী পরিচালিত কটেজে। এর পাশে খাবারের জন্য রয়েছে ভালোমানের রেস্টুরেন্ট। এখানে বসে পেট পুরে খেতে খেতে ডানে-বাঁয়ে চোখ বুলালে দূর-বহুদূরে দেখতে পাবেন দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাহাড় কেওক্রাডং, পাহাড় চূড়ার বগা লেক, কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর।
নীলগিরির সৌন্দর্য লিখে শেষ করার নয়। আমাদের লক্ষ্য এবার বাংলার দার্জিলিং চিম্বুকের দিকে। শহর থেকে এর দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার। এর ২৫শ’ ফুট উচ্চতায় না উঠলে বান্দরবান ভ্রমণের মূল আনন্দই অধরা থেকে যাবে আপনার। বর্ষা মৌসুমে এর পাশ দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘ দেখে মনে হয় মেঘের স্বর্গরাজ্য। মেঘের হালকা হিম ছোঁয়া মেঘ ছোঁয়ার অনুভূতি এনে দেয় মনে। পর্যাপ্ত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত ও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ আরও উন্নত করা গেলে চুম্বকের সৌন্দর্য ভারতের দার্জিলিংয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম হতো না মনে করেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। তাই একে তারা বাংলার দার্জিলিং বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আমরা এর চূড়ায় পৌঁছে ম্রোদের হাতে তৈরি এক কাপ চা খেয়ে নিজেকে চাঙ্গা করে ফের হোটেল অভিমুখে রওনা দিলাম। পথে পাহাড়ি ঝরনা শৈলাপ্রপাতে ১০ মিনিটের যাত্রাবিরতি। স্থানীয় কয়েক বাম উপজাতি তরুণ জানালেন, বর্ষায় শ্যাঁওলাধরা এ পাথুরে ঝরনায় নামা খুবই বিপজ্জনক।
বিকালের পুরো সময়টা আমরা হোটেল ও এর আশপাশে কাটিয়ে দিলেও বন্ধু হালিম তার নববধূকে নিয়ে এক ফাঁকে স্বর্ণমন্দির ঘুরে এলো। আমাদের মধ্যে ওরাই একমাত্র নবদম্পতি। আমরা চেয়েছিলাম ওদের নিজেদের মতো ঘোরার জন্য আলাদা একটা সময় বের করে দিতে। প্রথমে ওরা একটু ইতস্তত করলেও পড়ন্ত বিকালে আসমা ভাবীর ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি দেখে মনে হলো ওরা সময়টা ভালোই কাটিয়েছে।
দ্বিতীয় দিন রাতে আমাদের ফেরার পালা। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। নিজেদের এদিন কোনো শক্ত শিডিউলে বেঁধে রাখতে মন চাইল না। সকালের সময়টা যে যার মতো কাটিয়ে বিকালে নীলাচল ও মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স ঘুরে রাতে ঢাকার পথ ধরলাম। পেছনে রয়ে গেল বর্ষাস্নাত দু’টি দিনের সেই বিমুগ্ধ স্মৃতি। যে স্মৃতিতে বর্ষা এলে বারবার হারিয়ে যায় মন। আবার ছুটে যেতে চায় বাংলার দার্জিলিংয়ের টানে।
বান্দরবানের পথে ঢাকার ফকিরাপুল ও সায়েদাবাদ থেকে শ্যামলী, সৌদিয়া, ডলফিন পরিবহনের কয়েকটি গাড়ি রাতে ছেড়ে যায়। ভাড়া ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। যারা সেখানে যেতে যান, নিজেরা উদ্যোগী হয়ে কিংবা বেড়ানোর জন্য কোনো ভ্রমণ আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠানের প্যাকেজে নাম লেখাতে পারেন। আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়া, সাইট সিং সব ব্যবস্থাই করে এ প্রতিষ্ঠানগুলো। নোঙর ট্যুরিজম এ ধরনের একটি প্যাকেজের আয়োজন করেছে।
Source: Daily Amardesh