Search This Blog

FCO Travel Advice

Bangladesh Travel Advice

AFRICA Travel Widget

Asia Travel Widget

Sunday, February 20, 2011

বে ড়া নো : ভ্রমণের আনন্দ জনবিহীন ছেঁড়াদ্বীপ

বে ড়া নো : ভ্রমণের আনন্দ জনবিহীন ছেঁড়াদ্বীপ

‘বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি, পৃথিবীর রূপ আর দেখিতে চাই না’ রূপসী বাংলা সম্পর্কে কবির বিখ্যাত উক্তির সত্যতা মেলাতে আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে ঘর-সংসার ত্যাগ করে, ব্যাপারটি তা নয়। তবে সুযোগ খুঁঁজতে হবে। প্রকৃতির লীলভূমি অবলোকনে আগ্রহ থাকতে হবে। সময় সুযোগে স্বল্প সময়ের জন্য ঘরছাড়া হতে হবে। অন্বেষণ করতে হবে বাংলার বুকে ধারণ করা লুকায়িত সৌন্দর্য।
মায়াবী প্রশান্তির খোঁজে দুই রাত তিন দিন কর্মহীন ভ্রমণবিলাসী জীবন ধারণ করেছিলাম গত ১৯ জানুয়ারি ভোরবেলা থেকে। উদ্দেশ্য কক্সবাজার, পেঁচার দ্বীপ, ইনানী, মহেষখালী, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন ও ছেঁড়াদ্বীপ। সঙ্গে ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কেএম আবু বাকের ও পরিজন, ডা. কামরুজ্জামান ও পরিবার, ডা. সজিদ খান ও পরিবার এবং আমার স্ত্রী মিত্রা দেব এবং আমাদের সন্তান ত্রিয়মা রায়। এর আগেও এসব স্থান ভ্রমণ এবং পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু এবারেরটা ভিন্ন আঙ্গিকে, খোশ মেজাজে, শ্বেতশুভ্র অবস্থানে। তিন দিন দুই রাতের কর্মপরিকল্পনা এবং পরিভ্রমণ ঠিকানার বিস্তারিত প্যাকেজ চূড়ান্ত হয়েছিল চট্টগ্রামে বসে। পর্যটক আকর্ষণের দীনতা, দুর্বলতা এবং পেশাদারিত্বের সীমাহীন অব্যবস্থাপনার দৃশ্য পীড়াদায়ক লেগেছে। যদিও আমরা ছিলাম শতভাগ নিশ্চয়তা আর আন্তরিক আতিথেয়তার সুগভীর অবস্থানে। কক্সবাজারে আমাদের ভ্রমণকে আনন্দদায়ক নির্ঝঞ্ঝাট প্রফুল্লময় করেছে সেখানকার সিআইপি আনোয়ার ভাইয়ের কল্যাণে। বিলাসবহুল গাড়ির আয়োজনে পরদিন ভোরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাইক্রো আমাদের পৌঁছে দেয় টেকনাফের কেয়ারি ঘাটে। শীতের ভোরের চাদর ঢাকা হালকা কুয়াশা পাহাড়ি রাস্তার মায়াবী পরিবেশে মোহাবিষ্ট না হয়ে পারা যায় না। আমদানি সিদ্ধান্তের কারণে ক্রম বিলুপ্তির পথে টেকনাফের ঐতিহ্যবাহী লবণ চাষ প্রক্রিয়ার শ্রীহীন মলিন স্তূপাকৃত অপরিশোধিত লবণ প্রত্যক্ষ করে ব্যথিত হলাম। স্বচোখে দেখলাম আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বেড়াজালে জড়িয়ে আমাদের ঐতিহ্যময় শিল্পের ধ্বংস প্রক্রিয়া। যেমনটা হয়েছে পাট, চামড়া, চা ও লবণ।
সপ্তাহান্ত ছাড়াও কেয়ারিঘাটে পর্যটকের উত্ফুল্ল ভিড় দেখে প্রফুল্ল হলাম। নতুন সংযোজিত বিলাসবহুল কেয়ারি ক্রুজে উঠে মনোপীড়ার কারণ হলো, এত বড় জাহাজে আমরা মাত্র ১৫-১৬ জন যাত্রী। অবশ্য তাদের প্রচারণা এবং খরচাধিক্য অন্যতম কারণ বলে জানানো হলো। সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্য জাহাজ ছাড়ার অল্প সময়ের মধ্যেই টের পেলাম কেয়ারি ক্রুজের আসল রহস্য। সাধারণ মানের এক কাপ চা ৫২ টাকা। কি সাংঘাতিক! অবশ্য ম্যানেজার মাহাতাব সাবেরের যৌক্তিক বর্ণনা আমাকেও ভাবিয়ে তুলল।
সত্তর দশকের শেষ প্রান্তে ইউনিয়ন মর্যাদা পাওয়া রত্নাকার বঙ্গোপসাগরের সর্বদক্ষিণ প্রান্তে মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করা ৭ বর্গ কিলোমিটারের সাগরকন্যা সেন্টমার্টিনে যখন পৌঁছলাম, তখন সূর্যিমামা ঠিক মাথার মাঝখানে, দুপুর ১২টা।
টেকনাফের মূল ভূখণ্ড থেকে ৪৫ কিলোমিটার সাগর অভ্যন্তরে সাড়ে সাত হাজার মানুষের ভারাক্রান্ত পদভারে ন্যূব্জ ৫ হাজার বছরের ইতিহাস জানা নীলাভ দ্বীপ ‘সেন্টমার্টিন’। ব্লু মেরিন রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের স্বপ্নিল আতিথেয়তা, সুন্দরী আর উড়ন্ত মাছের স্বাদ গ্রহণের মধ্য দিয়ে পার হলো আমাদের দলের দুপুরটি। হুমায়ূন আহম্মদের ‘সমুদ্র বিলাস’ সেন্টমার্টিনকে দিয়েছে আলাদা প্রচারণা, নতুন করে প্রেরণা। ঘটনাও তাই দেখলাম। এর আগে সমুদ্র বিলাসকে দেখেছিলাম ভঙ্গুর, ক্ষয়িষ্ণু, নিষ্প্রভ। আজ এখানে কয়েকটি কটেজ বাঁশ, কাঠ, খড়, টিন আর মাচানের মাতামাতি। কাজ চলছে দ্রুতলয়ে, রাতারাতি। নোয়াখালী, চট্টগ্রাম আর মিয়ানমার ভাষার সংমিশ্রণে শ্রমিকরা জানাল ব্যবসাবান্ধব কার্যক্রমের উদ্বোধনও খুব সন্নিকটে।
আড়াই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের, দেড় কিলোমিটার প্রস্থের পুরো সেন্টমার্টিনকে পায়ে হেঁটে পরিভ্রমণ করা যায় ২ ঘণ্টা সময়ে। আমরা সে রকম যাত্রায় না গিয়ে রিকশাভ্যান সঙ্গী করলাম। পরিবেশ দফতরের নয়নাভিরাম অবকাঠামো থাকলেও সতর্ক ও সচেতনতামূলক কয়েকটা সাইনবোর্ড ছাড়া তেমন কোনো জোরালো কাজ চোখে পড়ল না। নীল সমুদ্র, নীলদিগন্ত, নীলাকাশ, নীলাচল ইত্যাদি নামীয় রিসোর্টগুলো এর আগে বাঁশ, বেত, কাঠের সুদৃশ্য মিলন দেখেছিলাম। এখন আইন বিরুদ্ধ ইট, লৌহ কংক্রিটের সংমিশ্রণে রীতিমত প্রাসাদোপম।
সরকার নির্ধারিত সুনির্দিষ্ট তারিখের যে পাঁচ মাস সেন্টমার্টিন ভ্রমণের সুযোগ থাকে, তাতে পূর্ণিমা থাকে কয় দিন? সেদিন ছিল পূর্ণিমা, আলোকিত জোত্স্না রাত। আয়োজন হলো বারবি কিউর। আমরা মিশে গেলাম ওখানে অবস্থান নেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকমণ্ডলীর আয়োজনে। হলো কবিতা, গান, বক্তৃতা, অভিজ্ঞতার আলোচনা। ভাটার টানে গর্জনহীন নীল সমুদ্রের দিগন্ত জোড়া বিশাল জলরাশির ওপর যখন পূর্ণিমার নিষ্পাপ আলোকিত ছায়া পড়েছিল, সে দৃশ্য কেবলই দেখার, অনুভবের, উপলব্ধির; কিন্তু প্রকাশের নয়। আমরা বীচ এলাকায় আয়োজন করলাম স্থানীয় শিল্পী আবদুলের গম্ভীরা গানের আসর। খমক, জুরি, ঢোলক আর দোতারার সমন্বয়হীন বাদন, আঞ্চলিক উচ্চারণ, অর্থ উদ্ধার না করতে পারা গীতের সুর ঝংকারও আমাদের নির্ঘুম রাত যাপনে উদ্বুদ্ধ করেছে। তিন বছর যাবত্ নিধনহীন কুকুরের বিশালাকার দলবদ্ধ উদ্দেশ্যহীন ঘেউ ঘেউর মধ্যেও স্মৃতিময় জোছনালোক অবলোকনে রাত ৩টা, কখনও বাজে অনুভব করতে কষ্ট হয়েছে।
পরদিন ভোরে ইঞ্জিন নৌকায় করে ২৫ মিনিট সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম মনুষ্যহীন ছেঁড়াদ্বীপে। ব্রিটিশ সরকার মিয়ানমার আর বাংলাদেশ সীমান্ত পিলার গেড়েছিল ওখানে। ধ্বংসাবশেষ এখনও দেশ দুটিকে আলাদা মর্যাদা দিয়ে থাকে। ছেঁড়াদ্বীপ মূলত মূল সেন্টমার্টিনের অখণ্ড রূপ। চামচের মতো এর লেজ সংযুক্ত সেন্টমার্টিনের সঙ্গে। ভাটার সময় পরিষ্কার হয়ে ওঠে লেজ। মূল অংশ থেকে ছিঁড়ে গেছে বলেই ছেঁড়াদ্বীপ। কয়েক বিঘার এ দ্বীপের চার পাশে রয়েছে সমুদ্রের নানা প্রজাতির জীবন্ত প্রবাল। পরিষ্কার নীল জলের গভীর তলদেশে সামুদ্রিক প্রাণীর মায়াময় কোলাকুলি, দুঃসাহসিক ভ্রমণের সার্থকতা এনে দেয়।
আমরা কথা বললাম পরীর মতো অবস্থান করা দ্বীপের পাহাড়াদার একমাত্র পরিবার হোসান আলীর সঙ্গে। দুই মেয়ে চার ছেলের সংসারের সব কিছু আসে সেন্টমার্টিন থেকে। ছেঁড়াদ্বীপে মনুষ্য খাদ্যতালিকার কোনো কিছুই নেই। চাষাবাদও সম্ভব নয়। কেবলই প্রবাল আর প্রবাল। এত বড় সংসার হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করতে হোসান আলী লজ্জাবনত হাসিতে বললেন, ওঁনার দাদা মিয়ানমারের লোক। বলেছিল কোনটা আলী হবে আর কোনটা অলি হবে কেউ জানে না। কিন্তু হোসান আলী এতদিনে উপলব্ধি করেছেন তার সন্তানরা কেউ আলীও হয়নি, কেউ অলিও হয়নি। তিনি ভুল করেছেন। আমি সেন্টমার্টিনের ১০ শয্যা হাসপাতালের একমাত্র চিকিত্সক ডা. সুমনের ঠিকানা দিলাম। আগের দিন প্রাণময় জোছনা রাতে ডা. সুমনের সঙ্গে দ্বীপসংক্রান্ত বিশেষ তথ্যবহুল মজাদার আলোচনা হয়েছিল। জন্মনিয়ন্ত্রণ থেকে যাবতীয় চিকিত্সা ও ওষুধ সংগ্রহের সুযোগ নিতে হোসান আলীকে অনুরোধ করলাম। সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের দীর্ঘকালের নির্বাচিত চেয়ারম্যান মাওলানা ফিরোজ আলমের সঙ্গে যখন কথা হয়েছিল, তখন তিনি জনসংখ্যার অতিদ্রুত বর্ধনশীলতা সেন্টমার্টিনের জন্য হুমকি বলে মন্তব্য করেছিলেন। ৬৫০ জন ভোটার দিয়ে ৩ দশক আগে ইউনিয়নের যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল। বর্তমানে ২৮০০ ভোটার। ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশু রয়েছে ২৩০০। এমন ঘটনাও চলমান যে ১৫টি বিবাহ ৭ স্ত্রীর একত্র সংসার ২৪ সন্তান নিয়ে এক পরিবার। হোসান আলীর সঙ্গে কথা বলে এর রূঢ় সত্যতার বাস্তব মিল খুঁজে পেয়ে বিমর্ষিত হলাম। উপলব্ধি করলাম ব্যক্তি, সমাজ এবং সরকারের সব অর্জন, বিসর্জন হবে, যদি না জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়। সোলার প্যানেল বাধ্যতামূলক নয়, রাত ১১টা পর্যন্ত বিশালাকার সব জেনারেটরের গোঙ্গানি আর কম্পন সেন্টমার্টিনের অবস্থা অনেক আগেই নিয়ন্ত্রণহীন পাগলা ষাঁড়ের মতো। ছেঁড়াদ্বীপের জীবন্ত প্রবালের সঙ্গে মুখোমুখি আর স্মৃতিপূর্ণ কোলাকুলির পর আমরা বিষণ্ন চিত্তে রওনা হলাম আমাদের ফিরতি গন্তব্যে, আমাদের জীবনচক্রে।
Source: Daily Amardesh


সমুদ্র আর সূর্যের আলিঙ্গন ছেঁড়াদ্বীপ

'গোধূলির কোলে ঢলে পড়া সূর্যের সঙ্গে সমুদ্রজলের আলিঙ্গন, প্রবালের বুকে হেঁটে বেড়ানো রঙিন মাছেরা অথবা আকাশপানে ডানা মেলা কোন নাম না জানা পাখির সঙ্গে মিতালি' জলের কাছে জীবনের নোঙ্গর ফেলতে ডাক দেয় ছেঁড়াদ্বীপ_ জানাচ্ছেন_ মোস্তাফিজুর চৌধুরী মোস্তাক
সমুদ্রের সঙ্গে সূর্যের মিতালি দেখতে কার না ভালো লাগে। অনেকে এ মিতালি দেখতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। সমুদ্র আর সূর্যের আলিঙ্গন দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন পর্যটকরা। ভূমির প্রকৃতি ও আকৃতির কারণে বাংলাদেশকে বলা হয় বদ্বীপ। এ বদ্বীপ সদৃশ বাংলাদেশেই আছে দেখার মতো অনেক কিছু। এ দেশের বন-জঙ্গল পাহাড় আর সমুদ্রের সৌন্দর্য দেখে থমকে দাঁড়াতে হয় যে কোন পর্যটককে। আরএ সৌন্দর্য দেখতে প্রতিবছর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক ভিড় জমায় বাংলাদেশে। বলছিলাম সূর্য আর সমুদ্রের আলিঙ্গনের কথা। বাংলাদেশের ছেঁড়াদ্বীপে গেলে আপনি দেখতে পাবেন আলিঙ্গনের সেই সন্ধিক্ষণ। প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই ছেঁড়াদ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের গা ঘেঁষে জেগে উঠেছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। আর সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে অবস্থিত ছেঁড়াদ্বীপ। স্থানীয়রা ছেঁড়াদ্বীপকে সেন্টমার্টিনের লেজ বলে থাকেন। তবে ছেঁড়াদ্বীপকে সেন্টমার্টিনের লেজ বললেও সাম্প্রতিক সময়ে ছেঁড়াদ্বীপ সেন্টমার্টিন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যে কারণে ছেঁড়াদ্বীপের সৌন্দর্য বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। গভীর সমুদ্রের জলরাশির মধ্যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসেবে এর সৌন্দর্য অন্যরকম। যেন সুন্দর কোন মুখশ্রীর কপালের মাঝে জেগে থাকা টিপ। সুন্দর তবে সৌন্দর্য প্রকাশের ধরনটা একটু ভিন্ন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট দ্বীপ হলো ছেঁড়াদ্বীপ। অনেকে ছেঁড়াদ্বীপকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের অংশ মনে করলেও আসলে ছেঁড়াদ্বীপ একটি প্রবাল দ্বীপ। সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রাণীর অস্তিত্ব থাকলেও ছেঁড়াদ্বীপে প্রবাল ও পলি মাটির ওপর জেগে ওঠা সবুজের সমারোহ ছাড়া আর কিছু নেই। তবে এ সবুজের সমারোহই ছেঁড়াদ্বীপকে দিয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। ভাটার সময় সামুদ্রিক কাঁকড়া ফেরে আপন আলয়ে। তাই বলা যায়, সামুদ্রিক কাঁকড়া ও ছোট প্রজাতির মাছদের বেড়ানোর জায়গা ছেঁড়াদ্বীপ। জোয়ার-ভাটার মধ্যবর্তী সময় এখানে বেড়াতে আসে দেশি-বিদেশি অসংখ্য পর্যটক। তখন সমুদ্রের অতিথিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের একটা সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে। সামুদ্রিক প্রাণীদের সঙ্গে দুষ্টুমি করতে করতে কখন যে সময় পার হয়ে যাবে তা বুঝতেও পারা যায় না। ছেঁড়াদ্বীপের প্রবালের সৌন্দর্য দেখে অনেকেই অভিভূত হয়ে পড়েন। প্রবালকে অনেকে সামদ্রিক জীব, কেউ কেউ আবার সামুদ্রিক উদ্ভিদ বলে থাকেন। স্তরে স্তরে সাজানো প্রবালের সঙ্গে প্রবালের নিবিড়তম সম্পর্ক ইচ্ছে করলেই ক্যামেরাবন্দী করা সম্ভব। দেশের সবচেয়ে ছোট এ দ্বীপের যে সৌন্দর্য দেখতে পর্যটকরা ভিড় করেন, তা হলো সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত।
মূল ভূখ- থেকে ছেঁড়াদ্বীপ অনেকটা দূরে। আর তাই সূর্যোদয় দেখাটা অনেকাংশেই কঠিন। তবে সূর্যোদয় না দেখতে পারলেও সূর্যাস্তের সৌন্দর্য অবশ্যই দেখতে পাওয়া যায়। সূর্যাস্তের সময় পশ্চিমাকাশ টকটকে লাল হয়ে যায়। সেই সঙ্গে লাল রঙের আভায় ভরে ওঠে সমুদ্রের গভীর জলরাশি।
সূর্যটা আকাশ থেকে নামতে নামতে হঠাৎ করে এমনভাবে উধাও হয়ে যায় মনে হয় নিমিষেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল। মনে হবে সূর্যটা পানির নিচে ডুবে গেছে। ছেঁড়াদ্বীপে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালে জলরাশি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়বে না। সূর্যাস্তের পর গোধূলির আলোয় মূল ভূখ-ে ফিরতে হবে। তা না হলে জোয়ারের সময় বড় বড় ঢেউয়ে ভয়ের জুজু ধরে বসতে পারে।
কীভাবে যাবেন
টেকনাফ থেকে ট্রলার কিংবা সি-ট্রাকে করে সেন্টমার্টিন ঘেঁষে ছেঁড়াদ্বীপ যাওয়া যায়। যাওয়ার সময় মনে করে অবশ্যই ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা সঙ্গে নেবেন।
Source: Daily Sangbad

পাথর উত্তোলন, প্রবাল শৈবাল আহরণ চলছে:

হুমকির মুখে ছেঁড়াদ্বীপ

আবদুল কুদ্দুস, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে | তারিখ: ০৩-০২-২০১০
বাংলাদেশের মানচিত্রে সর্বদক্ষিণের বিন্দুটি হচ্ছে ছেঁড়াদিয়া বা ছেঁড়াদ্বীপ। এই দ্বীপে এখনো জনবসতি গড়ে ওঠেনি। দ্বীপের চারদিকে পাথরের রাজ্য। ভূ-ভাগ সবুজ কেয়াগাছে ভরা। জোয়ারের সময় চার একরের দ্বীপটির চারদিক ডুবে গেলে বাকি ভূখণ্ড মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে।
গত সোমবার সকালে এই দ্বীপ পরিদর্শন করে এখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন দেখে হতাশ হন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) নূর মোহাম্মদ।
দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার ব্যাপারে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে গত রোববার দুপুর সাড়ে ১২টায় আইজিপি নূর মোহাম্মদ সেন্ট মার্টিনে যান। ওই দিন বেলা তিনটা পর্যন্ত তিনি হেঁটে হেঁটে দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাথর উত্তোলন, সৈকত দখল করে দোকানপাট, বসতবাড়িসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ পরিদর্শন করেন। বিকেল পাঁচটায় তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে মতবিনিময় সভা করেন। সভায় দ্বীপের কয়েক শ মানুষ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে পাথর উত্তোলন, প্রবাল-শৈবাল আহরণ ও বিক্রি বন্ধসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষার শপথ নেয়। পরদিন সকাল ১০টায় আইজিপি সেন্ট মার্টিন থেকে কোস্টগার্ড বাহিনীর একটি স্পিডবোটে করে ছেঁড়াদ্বীপ পরিদর্শনে যান।
আইজিপি নূর মোহাম্মদ জীবনের প্রথম ছেঁড়াদ্বীপের মাটিতে পা রেখে বললেন, ‘কী সুন্দর দ্বীপ! জীবনে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আরেকবার আসার সুযোগ পাই কিনা আল্লাহ জানে।’
আইজিপির সঙ্গে ছিলেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আসাদুজ্জামান মিয়া, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসাইনসহ পুলিশ ও কোস্টগার্ডের কয়েকজন সদস্য।
দ্বীপে উঠে সবাইকে নিয়ে আইজিপি হাঁটা শুরু করেন। ২০ কদম যেতেই তাঁর সামনে পড়েন নারায়ণগঞ্জ থেকে ভ্রমণে আসা এক ব্যক্তি। তাঁর হাতে তিন টুকরো প্রবাল। আইজিপির প্রশ্নের জবাবে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘প্রবালগুলো সুন্দর লেগেছে, তাই ভেঙে সঙ্গে নিলাম।’ নূর মোহাম্মদ প্রবাল-শৈবাল, শামুক-ঝিনুক আহরণকারী এ রকম আরও কয়েকজনকে ডেকে বলেন, ‘প্রবাল-শৈবাল আহরণ ও বিপণন নিষিদ্ধ তা আপনারা জানেন না? এর কারণে যে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়, আপনারা নিশ্চয় জানেন? বাংলাদেশের সর্বশেষ ভূখণ্ডটিকে অন্তত বাঁচিয়ে রাখুন।’ এরপর লোকজন হাতে থাকা, ব্যাগে রাখা প্রবাল-শৈবালগুলো সাগরের পানিতে রেখে দেয়।
ছেঁড়াদ্বীপে পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রত্যয় নামের একটি বেসরকারি সংস্থার তিনটি সাইনবোর্ড নজরে পড়লেও এদের কাউকে দ্বীপে দেখা যায়নি। ছোট্ট দ্বীপটিও পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, ডাবের খোসায় ভরা।
সেখানকার অস্থায়ী রেস্তোরাঁর মালিক সেন্ট মার্টিনের আবদুল শুক্কুর (৪৫) জানান, স্থানীয় লোকজন প্রবাল-শৈবাল আহরণ করে না। পর্যটকেরা ফিরে যাওয়ার সময় এসব আহরণ করে নিয়ে যায়। নিষেধ করলে তারা শোনে না। ডাব বিক্রেতা সৈয়দ নূর জানান, আগে সেন্ট মার্টিনের কয়েকজন প্রভাবশালী ছেঁড়াদ্বীপ থেকে বিপুল পরিমাণ প্রবাল-শৈবাল, শামুক-ঝিনুক আহরণ করে ট্রলারযোগে কক্সবাজারে পাচার করতেন। গত রোববার থেকে তা বন্ধ রয়েছে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান জানান, দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পুলিশের এই উদ্যোগে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে এবং দায়িত্ববোধ কাজ করছে।
বিকেল সাড়ে তিনটায় ছেঁড়াদ্বীপ ত্যাগ করে সেন্ট মার্টিন থেকে টেকনাফগামী জাহাজে ওঠার সময় জেটির মাঝপথে দেখা গেল, তিন ব্যক্তি হাতমাইকে ঘোষণা করছেন, ‘সম্মানীত পর্যটকবৃন্দ। আপনাদের হাতে প্রবাল ও শৈবাল থাকলে দয়া করে এখানে রেখে যান। এসব আহরণ, সংগ্রহ, সরবরাহ একেবারে নিষিদ্ধ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।’
লোকজন ব্যাগ, প্যান্ট, জ্যাকেট ও কোটের পকেট থেকে প্রবাল-শৈবাল, শামুক-ঝিনুক বের করে জমা দিয়ে জাহাজে উঠছে। উদ্ধারকর্মী আনোয়ার হোসেন জানান, এখন থেকে প্রতিদিন জাহাজ থেকে নামার সময় পর্যটকদের এ ব্যাপারে সতর্ক করা হবে এবং ওঠার সময় তল্লাশির ব্যবস্থা চলবে।
Source: Daily Prothom Alo

Friday, February 11, 2011

পর্যটন প্যারাডাইজ কক্সবাজার

পর্যটন প্যারাডাইজ কক্সবাজার
শহীদুল ইসলাম

কক্সবাজারের প্রাচীন নাম বাকোলী। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এর নাম চঊঘএডঅ হয়। রাখাইন শব্দ চঊঘএডঅ অর্থ হলুদ ফুল। পরবতর্ীতে ঈড়ী'ং ইধমধৎ নামের পিছনে আছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। সংক্ষেপে বলতে গেলে ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা বোধপায়া (১৭৮২-১৮১৯) আরাকান দখল করে আরাকানীদের উপর নৃশংস অত্যাচার চালায়। বমর্ীদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আরাকানীরা দলে দলে কক্সবাজার অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। জঙ্গলাকীর্ণ এলাকাকে আবাদযোগ্য করে তোলার উদ্দেশ্যে কোম্পানী উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেয়। ১৭৯৯ সালে আরাকানী উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের জন্য ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তিনি প্রতিটি উদ্বাস্তু পরিবারকে ১ হেক্টর জমি বন্দোবস্ত দেন এবং ছয় মাসের রসদ বাবদ ২৬ মণ করে খাদ্যশষ্য ঋণ প্রাদন করেন। কিন্তু আরাকানী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কাজ শেষ করার আগেই হিরাম কক্স মৃতু্যবরণ করেন (১৭৯৯)। ক্যাপ্টেন কক্সের স্মৃতি রক্ষার্থে তার নামে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই থেকেই কক্সবাজার নামের উৎপত্তি।
মাইলের পর মাইল সোনালী বালুকাময় বেলাভূমি। লতা-গুল্ম বন-বনানী দিয়ে সুশোভিত তরঙ্গায়িত খাড়া পাহাড়। তরঙ্গ বিধৌত ফেনাযুক্ত ঢেউ। রঙ্গিন শামুক-ঝিনুকের সম্ভার, সু-স্বাদু সামুদ্রিক খাদ্য, ১২০ কিলোমিটার পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত যা বঙ্গোপসাগরের নীল জল রাশির দিকে ক্রম ঢালু। কক্সবাজারের উত্তরে আছে চট্টগ্রাম এবং পাহাড়ি জেলা বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি, পূর্বের দিকে মায়ানমার, দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বঙ্গোপসাগর, সুসজ্জিত সমুদ্র তীর, প্রধান সড়কের দুইধারে সৌখিক দ্রব্যাদিসহ সজ্জিত দোকান, রাখাইনদের কুঁড়ে ঘর। এখানে আকাশ নীল। উচ্ছ্বসিত শিশুর মত ঢেউ খেলে যায় সাগরের বেলাভূমিতে। নারিকেলের বীথি মিতালি করে রাখাইন কিশোরীদের সাথে। পশ্চিম আকাশে আগুনে পুড়ে লাল করে ডুবে যায় দিনের সূর্য। বিদায়ী সেই লগন ব্যথাতুর করে মানব হূদয়কে । সারা রাত এইভাবে কাটিয়ে পাহাড়ের বুক চিরে ঝুটিওয়ালা মুরগীর ডিমের লাল কুসুমের মতো গোল সূর্য ওঠে আবার। সেটি আভা ছড়ায়, আকাশের গায়ে আবীর মাখায়। পাহাড়ের ঢালে লুকিয়ে থাকে ভোরের সূর্য। এ যেন এক তরুণীর না বলা অব্যক্ত গল্প গাঁথা। ঠিক এমনই ছবির মত সাজানো সাগর কন্যা কক্সবাজার।
মনে হয় স্রষ্টা আপন হাতে উপুড় করে দিয়েছেন তার সৌন্দর্য। এ যেন স্বর্গ নরকের রহস্যপুরী।
পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত ও বনভূমির নয়নাভিরাম দৃশ্য কক্সবাজারকে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। এখানে প্রতি বছর ১৫ মিলিয়ন লোক আগমন করে যার ৩% হলো বিদেশী। প্রায় দুই শত কোটি টাকা সরকারের প্রতি বছর রাজস্ব আয় হয়। পর্যটনকে কেন্দ্র করে এখানে বহুধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বহু হোটেল, মোটেল, কটেজ গড়ে উঠেছে। কক্সবাজারকে ঘিরে বিজ্ঞাপন টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকায় প্রচার হচ্ছে-নতুন নতুন সুরম্য অট্টালিকা তৈরি হচ্ছে যা কক্সবাজারকে টু্যরিস্ট প্যারাডাইজে পরিণত করেছে।
সরকারও শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে পর্যটন শিল্পকে আরও আকর্ষণীয় করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন।
পর্যটনকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারে গড়ে উঠেছে মৎস্য, গবাদি পশু ও হাঁস মুরগীর খামার। এছাড়া সীমান্ত পথে বার্মা, থাইল্যান্ড, চীন প্রভৃতি দেশ থেকে আগত বিলাস সামগ্রীর বাজার বার্মিজ মার্কেট। বার্মিজ মার্কেটে সুন্দরীদের জিনিসপত্র বিক্রি কার না দৃষ্টি কাড়ে। প্রভৃতির মাধ্যমে সরকারের আয় ছাড়াও স্থানীয়দের কর্ম সংস্থানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বাণিজ্যের পথ প্রশস্ত করেছে। কক্সবাজারের খনিজ সম্পদের মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস, গন্ধক, জিরকন, ইলমেনাইট, ব্রুটাইল, ম্যাগিনাটাইট, সোনাজাইট, কয়নাইট প্রভৃতি উলেস্নখযোগ্য। তাছাড়া সৈকতে মূল্যবান ইউরেনিয়াম এবং ইষধপশ এড়ষফ পাওয়ার ঘটনাও ঘটছে যা আমাদের অর্থনৈতিক চাকা ঘুরাতে পারে।
একুশ শতকে বাঙালির অতীতের জ্বরা জীর্ণ অবস্থা কাটিয়ে নতুনভাবে জাগার ডাক পড়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পর্যটন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভূমিকা পালন করে চলেছে। থাইল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের বহু দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একমাত্র পথ হল পর্যটন শিল্প। নেপালের মোট রাজস্ব আয়ের প্রায় চলিস্নশ ভাগই এই খাত হতে অর্জিত হয়। পর্যটনকে বলা হয় ওহারংরনষব বীঢ়ড়ৎঃ মড়ড়ফং- বা অদৃশ্য রপ্তানি পণ্য। বাংলাদেশের মত অনেক দেশে যেখানে রপ্তানি পণ্য বই কম সেখানে কক্সবাজার এর মত সমুদ্র সৈকত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অফুরন্ত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি বেকারত্ব দূরীকরণ, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রীতি সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
[ লেখক : গবেষক]

Thursday, February 3, 2011

শরণখোলা রেঞ্জের আরণ্যক সৌন্দর্য

শরণখোলা রেঞ্জের আরণ্যক সৌন্দর্য

টিএম মিজানুর রহমান শরণখোলা (বাগেরহাট)
বিশ্ববিখ্যাত বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ও নয়নাভিরাম প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জকে ঘিরে রয়েছে পর্যটন শিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, ব্যাপক প্রচার ও সদিচ্ছার অভাব এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়হীনতার কারণে এই অপার সম্ভাবনাময় খাতটি বিকশিত হতে পারছে না। তবে সাইনবোর্ড-শরণখোলা আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ায় শরণখোলা রেঞ্জ ভিত্তিক পর্যটন শিল্পকে ঘিরে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য এই সুন্দরবনকে এরই মধ্যে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উপকমিটি (ইউনেস্কো) বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। সুন্দরবনকে আকর্ষণীয় করে বিশ্বের বুকে পরিচিত করে তুলতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন সুন্দরবনে পর্যটকদের নিয়ে কাজ করলেও তাদের রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। এরপরও সরকার সুন্দরবনে পর্যটনখাতে প্রতিবছর মোটা অংকের রাজস্ব আয় করছে। সরকারের সদিচ্ছা, বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ ও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় সম্ভব হলে এ খাতের রাজস্ব বেড়ে যেতে পারে কয়েকগুণ। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ হবে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।
সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির ছোট-বড় বৃক্ষ, ১৬৫ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৩ প্রজাতির পরাশ্রয়ী অর্কিড রয়েছে। সুন্দরী এ বনের প্রধানতম বৃক্ষ, যা মোট বনাঞ্চলের ৭৩ ভাগ। এছাড়া কেওড়া, বাইন, পশুর, ধুন্দল, কাঁকড়া, পশুর, গরান, হেতাল ও গোলপাতা উল্লেখযোগ্য। এ বনের ২৬৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, ১৮৬ প্রজাতির পাখি ও ২১০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। বন্যপ্রাণীর মধ্যে বিশ্বনন্দিত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী চিত্রল হরিণ, লোনাপানির ভয়ঙ্কর কুমির, বানর, শূকর ও গুইসাপ প্রধান।
এসব বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ সংরক্ষণ, বৃদ্ধি, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৭৭ সালে সুন্দরবনের ৩টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য চিহ্নিত করা হয়। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের পাশাপাশি এসব অভায়রণ্য জনসাধারণের জন্য বন্যপ্রাণীর বিচরণ পর্যবেক্ষণ ও উপভোগের জন্য উন্মুক্ত। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ও সমুদ্রের বিশাল জলরাশির কারণে সুন্দরবনের পূর্ব অভায়ারণ্য সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সুন্দরবনের এ অংশের নৈসর্গিক দৃশ্য ও ভয়াবহ নিস্তব্ধতার সঙ্গে সরকারি ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার সমন্বয়ে গড়ে উঠতে পারে পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।
এ অংশটি সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত। সমগ্র সুন্দরবনের সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় অঞ্চল কটকা ও কচিখালী নিয়ে এ অংশ গঠিত। কটকা, কচিখালী ছাড়াও শরণখোলা রেঞ্জের সুপতি, বাদামতলা, জামতলা, তিনকোনা আইল্যান্ড ও জেলে পল্লী দুবলা পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় স্থান।
কটকা : সুন্দরবন পূর্ব অভয়ারণ্যের পশ্চিমাংশে সাগর তীরে অবস্থিত কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্র। এখানকার নৈসর্গিক ও মনোরম পরিবেশ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। ঘন বনানীর ছায়ায় নির্মিত বিশ্রামাগারের বারান্দায় বসে চোখের সামনে উত্তাল সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ পর্যটকদের উচ্ছ্বসিত করে তোলে। বিকালে বিশ্রামাগারের চারপাশে হাজার হাজার চিত্রল হরিণের ছোটাছুটি, বানরের কোলাহল আর সকালে নদীর পাড়ে কুমিরের রোদ পোহানোর দৃশ্য যেন স্বপ্ন ও সত্যির অপূর্ব সমন্বয়। এখানে বিশ্রামাগার প্রান্তিকে ৪ শয্যাবিশিষ্ট ২টি কক্ষ রয়েছে। বরাদ্দপ্রাপ্তি ও রাজস্ব প্রদান সাপেক্ষ এটা ব্যবহার করা যায়।
কচিখালী : সুন্দরবনের পূর্ব অভয়ারণ্যের দক্ষিণ-পূর্বপ্রান্তে সাগর তীরে গড়ে উঠেছে কচিখালী কেন্দ্র। সুন্দরবনের ভ্রমণকারী এবং পর্যটকদের জন্য এখানে গড়ে উঠেছে একটি বড় ধরনের বিশ্রামাগার। এক শয্যাবিশিষ্ট তিনটি ও দুই শয্যাবিশিষ্ট একটি বেডরুম, ড্রইংরুম ও ডাইনিং রুমের সমন্বয়ে এ বিশ্রামাগারটি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। প্রতি শীত মৌসুম অর্থাত্ অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি এখানে কৌতূহলী পর্যটকদের ভিড় থাকে। তারা এখানকার সাগরপাড় আর ছন ক্ষেতের ভেতর খুঁজে ফেরে বহু প্রত্যাশিত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দর্শন। ঝাঁক বাঁধা চিত্রল হরিণ ছুটে বেড়িয়ে বন্ধুদের জানিয়ে দেয় পর্যটকদের আগমন বার্তা।
জামতলা : কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্রের নিকটবর্তী পর্যটকদের একটি আকর্ষণীয় স্থান জামতলা। জামতলায় রয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। যেখান থেকে বিস্তীর্ণ ছন ক্ষেতে হাজার হাজার হরিণের ছোটাছুটি, আবার কখনও রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখা যেতে পারে।
বাদামতলা : কচিখালী আর কটকার ঠিক মধ্যবর্তী স্থানের নাম বাদামতলা। বাদামতলা অত্যন্ত নির্জন এক সমুদ্র সৈকত। সেখানে আছড়ে পড়া সামুদ্রিক ঢেউ পর্যটকদের মন কেড়ে নেয়। শীতকালে বাদামতলার সৈকতে অজস্ত্র বাঘের পায়ের ছাপ দেখা যায়। কচিখালী ও জামতলা থেকে পায়ে হেঁটে বাদামতলা পৌঁছানো সম্ভব।
দুবলার চরে মত্স্যপল্লী : সাগরদ্বীপ দুবলাসহ সন্নিবেশিত ১০টি চরে মাছ আহরণের মৌসুমে ৩০ থেকে ৪০ হাজার মত্স্যজীবী ভিড় জমায়। অক্টোবরে এরা আসা শুরু করলেও নভেম্বরে রাসমেলা নামক এক ধর্মীয় উত্সবের মধ্য দিয়ে তাদের বছরের কাজ শুরু হয়। দুশ’ বছরের ঐতিহ্যলালিত এ রাস উত্সবেও দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক ও দর্শনার্থী ভিড় জমায়।
যোগাযোগ : শরণখোলা রেঞ্জের সম্ভাবনা সুন্দরবনের অপরূপ প্রকৃতি, জীববৈচিত্র, গভীর সমুদ্রের অপরূপ দৃশ্য ছাড়াও যোগাযোগ ও যাতায়াতের জন্য এ রেঞ্জ বিশেষ উপযোগী। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বাগেরহাট থেকে বাসযোগে শরণখোলা উপজেলা সদর রায়েন্দা বাজারে আসতে হবে। মংলা বন্দরের তুলনায় এখানে সাশ্রয়ী ভাড়ায় বিভিন্ন ধরনের লঞ্চ ও ট্রলার ভাড়া পাওয়া যায়। আগে থেকে বনবিভাগের অনুমতি প্রাপ্তিসাপেক্ষে শরণখোলা থেকে কচিখালী ও কটকায় যেতে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় লাগে। শরণখোলা থেকে এর দূরত্ব যথাক্রমে ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার। শরণখোলা রেঞ্জের কটকা ও কচিখালীতে আরামপ্রদ বিশ্রামাগারে পর্যটকরা যেমন রাতযাপন করতে পারেন, তেমনি ইচ্ছা করলে একদিনের মধ্যে সমগ্র এলাকা ঘুরে ফিরে আসতে পারেন, যা নির্ভর করবে পর্যটকদের প্রস্তুতি ও সামর্থ্যের উপর।
প্রস্তাবনা : স্থানীয় বিশেষজ্ঞ ও পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলে শরখোলা রেঞ্জকে আকর্ষণীয় করতে বেশ কিছু প্রস্তাবনা পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে রয়েছে শরণখোলা রেঞ্জ অফিস থেকে পর্যটকদের বনে প্রবেশের রাজস্ব গ্রহণ ও অনুমতি প্রদানের ব্যবস্থা। শরণখোলা রেঞ্জভিত্তিক পর্যটকদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নিরাপদ জলযানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রস্তাবিত সাইনবোর্ড-শরণখোলা আঞ্চলিক মহাসড়কের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। বনদস্যু ও জলদস্যুদের কবল থেকে পর্যটকদের নিরাপদ রাখতে সন্নিবেশিত নিরাপদ রুট চিহ্নিত করতে হবে। নিরাপদ রুটে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সার্বক্ষণিক টহল জোরদার করতে হবে। সুন্দরবনের আকর্ষণীয় জায়গা চিহ্নিত করে পরিবেশ উপযোগী অবকাঠামো ও চিত্তবিনোদনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ রেঞ্জের উজ্জ্বলতম পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ বৃদ্ধি করতে হবে। সুপতি স্টেশনে এবং কচিখালী থেকে জামতলা পর্যন্ত উডেন ট্রেইল তৈরি করে গভীর বনে পর্যটকদের নিরাপদ পথ চলার ব্যবস্থা করতে হবে। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস বা তেরাবেকা টহল ফাঁড়ি সংলগ্ন এলাকায় মংলা করমজলের মতো টুরিস্ট স্পট স্থাপন করতে হবে। এমন অভিমত দিয়েছেন সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জভিত্তিক পর্যটন কেন্দ্রের দাবিতে আন্দোলনরত শরণখোলা উন্নয়ন ফোরামের প্রধান সমন্বয়ক, সাংবাদিক আসাদুজ্জামান মিলন।
সুন্দরবন পূর্ব-বিভাগের ডিএফও মিহির কুমার দে বলেন, বর্তমানে সুন্দরবন থেকে প্রতিবছর পর্যটন খাতে সরকার এক কোটি টাকা রাজস্ব আয় করছে। ব্যাপকভিত্তিক প্রচারণা ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারলে রাজস্ব কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে শরণখোলা রেঞ্জ হতে পারে অপার সম্ভাবনাময় এক পর্যটক কেন্দ্র।
এ ব্যাপারে শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার জহিরুল ইসলাম জানান, সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জকে পর্যটন কেন্দ্রের আওতায় আনার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তবে এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।