বে ড়া নো : ভ্রমণের আনন্দ জনবিহীন ছেঁড়াদ্বীপ
‘বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি, পৃথিবীর রূপ আর দেখিতে চাই না’ রূপসী বাংলা সম্পর্কে কবির বিখ্যাত উক্তির সত্যতা মেলাতে আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে ঘর-সংসার ত্যাগ করে, ব্যাপারটি তা নয়। তবে সুযোগ খুঁঁজতে হবে। প্রকৃতির লীলভূমি অবলোকনে আগ্রহ থাকতে হবে। সময় সুযোগে স্বল্প সময়ের জন্য ঘরছাড়া হতে হবে। অন্বেষণ করতে হবে বাংলার বুকে ধারণ করা লুকায়িত সৌন্দর্য।
মায়াবী প্রশান্তির খোঁজে দুই রাত তিন দিন কর্মহীন ভ্রমণবিলাসী জীবন ধারণ করেছিলাম গত ১৯ জানুয়ারি ভোরবেলা থেকে। উদ্দেশ্য কক্সবাজার, পেঁচার দ্বীপ, ইনানী, মহেষখালী, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন ও ছেঁড়াদ্বীপ। সঙ্গে ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কেএম আবু বাকের ও পরিজন, ডা. কামরুজ্জামান ও পরিবার, ডা. সজিদ খান ও পরিবার এবং আমার স্ত্রী মিত্রা দেব এবং আমাদের সন্তান ত্রিয়মা রায়। এর আগেও এসব স্থান ভ্রমণ এবং পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু এবারেরটা ভিন্ন আঙ্গিকে, খোশ মেজাজে, শ্বেতশুভ্র অবস্থানে। তিন দিন দুই রাতের কর্মপরিকল্পনা এবং পরিভ্রমণ ঠিকানার বিস্তারিত প্যাকেজ চূড়ান্ত হয়েছিল চট্টগ্রামে বসে। পর্যটক আকর্ষণের দীনতা, দুর্বলতা এবং পেশাদারিত্বের সীমাহীন অব্যবস্থাপনার দৃশ্য পীড়াদায়ক লেগেছে। যদিও আমরা ছিলাম শতভাগ নিশ্চয়তা আর আন্তরিক আতিথেয়তার সুগভীর অবস্থানে। কক্সবাজারে আমাদের ভ্রমণকে আনন্দদায়ক নির্ঝঞ্ঝাট প্রফুল্লময় করেছে সেখানকার সিআইপি আনোয়ার ভাইয়ের কল্যাণে। বিলাসবহুল গাড়ির আয়োজনে পরদিন ভোরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাইক্রো আমাদের পৌঁছে দেয় টেকনাফের কেয়ারি ঘাটে। শীতের ভোরের চাদর ঢাকা হালকা কুয়াশা পাহাড়ি রাস্তার মায়াবী পরিবেশে মোহাবিষ্ট না হয়ে পারা যায় না। আমদানি সিদ্ধান্তের কারণে ক্রম বিলুপ্তির পথে টেকনাফের ঐতিহ্যবাহী লবণ চাষ প্রক্রিয়ার শ্রীহীন মলিন স্তূপাকৃত অপরিশোধিত লবণ প্রত্যক্ষ করে ব্যথিত হলাম। স্বচোখে দেখলাম আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বেড়াজালে জড়িয়ে আমাদের ঐতিহ্যময় শিল্পের ধ্বংস প্রক্রিয়া। যেমনটা হয়েছে পাট, চামড়া, চা ও লবণ।
সপ্তাহান্ত ছাড়াও কেয়ারিঘাটে পর্যটকের উত্ফুল্ল ভিড় দেখে প্রফুল্ল হলাম। নতুন সংযোজিত বিলাসবহুল কেয়ারি ক্রুজে উঠে মনোপীড়ার কারণ হলো, এত বড় জাহাজে আমরা মাত্র ১৫-১৬ জন যাত্রী। অবশ্য তাদের প্রচারণা এবং খরচাধিক্য অন্যতম কারণ বলে জানানো হলো। সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্য জাহাজ ছাড়ার অল্প সময়ের মধ্যেই টের পেলাম কেয়ারি ক্রুজের আসল রহস্য। সাধারণ মানের এক কাপ চা ৫২ টাকা। কি সাংঘাতিক! অবশ্য ম্যানেজার মাহাতাব সাবেরের যৌক্তিক বর্ণনা আমাকেও ভাবিয়ে তুলল।
সত্তর দশকের শেষ প্রান্তে ইউনিয়ন মর্যাদা পাওয়া রত্নাকার বঙ্গোপসাগরের সর্বদক্ষিণ প্রান্তে মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করা ৭ বর্গ কিলোমিটারের সাগরকন্যা সেন্টমার্টিনে যখন পৌঁছলাম, তখন সূর্যিমামা ঠিক মাথার মাঝখানে, দুপুর ১২টা।
টেকনাফের মূল ভূখণ্ড থেকে ৪৫ কিলোমিটার সাগর অভ্যন্তরে সাড়ে সাত হাজার মানুষের ভারাক্রান্ত পদভারে ন্যূব্জ ৫ হাজার বছরের ইতিহাস জানা নীলাভ দ্বীপ ‘সেন্টমার্টিন’। ব্লু মেরিন রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের স্বপ্নিল আতিথেয়তা, সুন্দরী আর উড়ন্ত মাছের স্বাদ গ্রহণের মধ্য দিয়ে পার হলো আমাদের দলের দুপুরটি। হুমায়ূন আহম্মদের ‘সমুদ্র বিলাস’ সেন্টমার্টিনকে দিয়েছে আলাদা প্রচারণা, নতুন করে প্রেরণা। ঘটনাও তাই দেখলাম। এর আগে সমুদ্র বিলাসকে দেখেছিলাম ভঙ্গুর, ক্ষয়িষ্ণু, নিষ্প্রভ। আজ এখানে কয়েকটি কটেজ বাঁশ, কাঠ, খড়, টিন আর মাচানের মাতামাতি। কাজ চলছে দ্রুতলয়ে, রাতারাতি। নোয়াখালী, চট্টগ্রাম আর মিয়ানমার ভাষার সংমিশ্রণে শ্রমিকরা জানাল ব্যবসাবান্ধব কার্যক্রমের উদ্বোধনও খুব সন্নিকটে।
আড়াই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের, দেড় কিলোমিটার প্রস্থের পুরো সেন্টমার্টিনকে পায়ে হেঁটে পরিভ্রমণ করা যায় ২ ঘণ্টা সময়ে। আমরা সে রকম যাত্রায় না গিয়ে রিকশাভ্যান সঙ্গী করলাম। পরিবেশ দফতরের নয়নাভিরাম অবকাঠামো থাকলেও সতর্ক ও সচেতনতামূলক কয়েকটা সাইনবোর্ড ছাড়া তেমন কোনো জোরালো কাজ চোখে পড়ল না। নীল সমুদ্র, নীলদিগন্ত, নীলাকাশ, নীলাচল ইত্যাদি নামীয় রিসোর্টগুলো এর আগে বাঁশ, বেত, কাঠের সুদৃশ্য মিলন দেখেছিলাম। এখন আইন বিরুদ্ধ ইট, লৌহ কংক্রিটের সংমিশ্রণে রীতিমত প্রাসাদোপম।
সরকার নির্ধারিত সুনির্দিষ্ট তারিখের যে পাঁচ মাস সেন্টমার্টিন ভ্রমণের সুযোগ থাকে, তাতে পূর্ণিমা থাকে কয় দিন? সেদিন ছিল পূর্ণিমা, আলোকিত জোত্স্না রাত। আয়োজন হলো বারবি কিউর। আমরা মিশে গেলাম ওখানে অবস্থান নেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকমণ্ডলীর আয়োজনে। হলো কবিতা, গান, বক্তৃতা, অভিজ্ঞতার আলোচনা। ভাটার টানে গর্জনহীন নীল সমুদ্রের দিগন্ত জোড়া বিশাল জলরাশির ওপর যখন পূর্ণিমার নিষ্পাপ আলোকিত ছায়া পড়েছিল, সে দৃশ্য কেবলই দেখার, অনুভবের, উপলব্ধির; কিন্তু প্রকাশের নয়। আমরা বীচ এলাকায় আয়োজন করলাম স্থানীয় শিল্পী আবদুলের গম্ভীরা গানের আসর। খমক, জুরি, ঢোলক আর দোতারার সমন্বয়হীন বাদন, আঞ্চলিক উচ্চারণ, অর্থ উদ্ধার না করতে পারা গীতের সুর ঝংকারও আমাদের নির্ঘুম রাত যাপনে উদ্বুদ্ধ করেছে। তিন বছর যাবত্ নিধনহীন কুকুরের বিশালাকার দলবদ্ধ উদ্দেশ্যহীন ঘেউ ঘেউর মধ্যেও স্মৃতিময় জোছনালোক অবলোকনে রাত ৩টা, কখনও বাজে অনুভব করতে কষ্ট হয়েছে।
পরদিন ভোরে ইঞ্জিন নৌকায় করে ২৫ মিনিট সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম মনুষ্যহীন ছেঁড়াদ্বীপে। ব্রিটিশ সরকার মিয়ানমার আর বাংলাদেশ সীমান্ত পিলার গেড়েছিল ওখানে। ধ্বংসাবশেষ এখনও দেশ দুটিকে আলাদা মর্যাদা দিয়ে থাকে। ছেঁড়াদ্বীপ মূলত মূল সেন্টমার্টিনের অখণ্ড রূপ। চামচের মতো এর লেজ সংযুক্ত সেন্টমার্টিনের সঙ্গে। ভাটার সময় পরিষ্কার হয়ে ওঠে লেজ। মূল অংশ থেকে ছিঁড়ে গেছে বলেই ছেঁড়াদ্বীপ। কয়েক বিঘার এ দ্বীপের চার পাশে রয়েছে সমুদ্রের নানা প্রজাতির জীবন্ত প্রবাল। পরিষ্কার নীল জলের গভীর তলদেশে সামুদ্রিক প্রাণীর মায়াময় কোলাকুলি, দুঃসাহসিক ভ্রমণের সার্থকতা এনে দেয়।
আমরা কথা বললাম পরীর মতো অবস্থান করা দ্বীপের পাহাড়াদার একমাত্র পরিবার হোসান আলীর সঙ্গে। দুই মেয়ে চার ছেলের সংসারের সব কিছু আসে সেন্টমার্টিন থেকে। ছেঁড়াদ্বীপে মনুষ্য খাদ্যতালিকার কোনো কিছুই নেই। চাষাবাদও সম্ভব নয়। কেবলই প্রবাল আর প্রবাল। এত বড় সংসার হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করতে হোসান আলী লজ্জাবনত হাসিতে বললেন, ওঁনার দাদা মিয়ানমারের লোক। বলেছিল কোনটা আলী হবে আর কোনটা অলি হবে কেউ জানে না। কিন্তু হোসান আলী এতদিনে উপলব্ধি করেছেন তার সন্তানরা কেউ আলীও হয়নি, কেউ অলিও হয়নি। তিনি ভুল করেছেন। আমি সেন্টমার্টিনের ১০ শয্যা হাসপাতালের একমাত্র চিকিত্সক ডা. সুমনের ঠিকানা দিলাম। আগের দিন প্রাণময় জোছনা রাতে ডা. সুমনের সঙ্গে দ্বীপসংক্রান্ত বিশেষ তথ্যবহুল মজাদার আলোচনা হয়েছিল। জন্মনিয়ন্ত্রণ থেকে যাবতীয় চিকিত্সা ও ওষুধ সংগ্রহের সুযোগ নিতে হোসান আলীকে অনুরোধ করলাম। সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের দীর্ঘকালের নির্বাচিত চেয়ারম্যান মাওলানা ফিরোজ আলমের সঙ্গে যখন কথা হয়েছিল, তখন তিনি জনসংখ্যার অতিদ্রুত বর্ধনশীলতা সেন্টমার্টিনের জন্য হুমকি বলে মন্তব্য করেছিলেন। ৬৫০ জন ভোটার দিয়ে ৩ দশক আগে ইউনিয়নের যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল। বর্তমানে ২৮০০ ভোটার। ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশু রয়েছে ২৩০০। এমন ঘটনাও চলমান যে ১৫টি বিবাহ ৭ স্ত্রীর একত্র সংসার ২৪ সন্তান নিয়ে এক পরিবার। হোসান আলীর সঙ্গে কথা বলে এর রূঢ় সত্যতার বাস্তব মিল খুঁজে পেয়ে বিমর্ষিত হলাম। উপলব্ধি করলাম ব্যক্তি, সমাজ এবং সরকারের সব অর্জন, বিসর্জন হবে, যদি না জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়। সোলার প্যানেল বাধ্যতামূলক নয়, রাত ১১টা পর্যন্ত বিশালাকার সব জেনারেটরের গোঙ্গানি আর কম্পন সেন্টমার্টিনের অবস্থা অনেক আগেই নিয়ন্ত্রণহীন পাগলা ষাঁড়ের মতো। ছেঁড়াদ্বীপের জীবন্ত প্রবালের সঙ্গে মুখোমুখি আর স্মৃতিপূর্ণ কোলাকুলির পর আমরা বিষণ্ন চিত্তে রওনা হলাম আমাদের ফিরতি গন্তব্যে, আমাদের জীবনচক্রে।
Source: Daily Amardeshমায়াবী প্রশান্তির খোঁজে দুই রাত তিন দিন কর্মহীন ভ্রমণবিলাসী জীবন ধারণ করেছিলাম গত ১৯ জানুয়ারি ভোরবেলা থেকে। উদ্দেশ্য কক্সবাজার, পেঁচার দ্বীপ, ইনানী, মহেষখালী, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন ও ছেঁড়াদ্বীপ। সঙ্গে ছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কেএম আবু বাকের ও পরিজন, ডা. কামরুজ্জামান ও পরিবার, ডা. সজিদ খান ও পরিবার এবং আমার স্ত্রী মিত্রা দেব এবং আমাদের সন্তান ত্রিয়মা রায়। এর আগেও এসব স্থান ভ্রমণ এবং পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু এবারেরটা ভিন্ন আঙ্গিকে, খোশ মেজাজে, শ্বেতশুভ্র অবস্থানে। তিন দিন দুই রাতের কর্মপরিকল্পনা এবং পরিভ্রমণ ঠিকানার বিস্তারিত প্যাকেজ চূড়ান্ত হয়েছিল চট্টগ্রামে বসে। পর্যটক আকর্ষণের দীনতা, দুর্বলতা এবং পেশাদারিত্বের সীমাহীন অব্যবস্থাপনার দৃশ্য পীড়াদায়ক লেগেছে। যদিও আমরা ছিলাম শতভাগ নিশ্চয়তা আর আন্তরিক আতিথেয়তার সুগভীর অবস্থানে। কক্সবাজারে আমাদের ভ্রমণকে আনন্দদায়ক নির্ঝঞ্ঝাট প্রফুল্লময় করেছে সেখানকার সিআইপি আনোয়ার ভাইয়ের কল্যাণে। বিলাসবহুল গাড়ির আয়োজনে পরদিন ভোরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাইক্রো আমাদের পৌঁছে দেয় টেকনাফের কেয়ারি ঘাটে। শীতের ভোরের চাদর ঢাকা হালকা কুয়াশা পাহাড়ি রাস্তার মায়াবী পরিবেশে মোহাবিষ্ট না হয়ে পারা যায় না। আমদানি সিদ্ধান্তের কারণে ক্রম বিলুপ্তির পথে টেকনাফের ঐতিহ্যবাহী লবণ চাষ প্রক্রিয়ার শ্রীহীন মলিন স্তূপাকৃত অপরিশোধিত লবণ প্রত্যক্ষ করে ব্যথিত হলাম। স্বচোখে দেখলাম আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বেড়াজালে জড়িয়ে আমাদের ঐতিহ্যময় শিল্পের ধ্বংস প্রক্রিয়া। যেমনটা হয়েছে পাট, চামড়া, চা ও লবণ।
সপ্তাহান্ত ছাড়াও কেয়ারিঘাটে পর্যটকের উত্ফুল্ল ভিড় দেখে প্রফুল্ল হলাম। নতুন সংযোজিত বিলাসবহুল কেয়ারি ক্রুজে উঠে মনোপীড়ার কারণ হলো, এত বড় জাহাজে আমরা মাত্র ১৫-১৬ জন যাত্রী। অবশ্য তাদের প্রচারণা এবং খরচাধিক্য অন্যতম কারণ বলে জানানো হলো। সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্য জাহাজ ছাড়ার অল্প সময়ের মধ্যেই টের পেলাম কেয়ারি ক্রুজের আসল রহস্য। সাধারণ মানের এক কাপ চা ৫২ টাকা। কি সাংঘাতিক! অবশ্য ম্যানেজার মাহাতাব সাবেরের যৌক্তিক বর্ণনা আমাকেও ভাবিয়ে তুলল।
সত্তর দশকের শেষ প্রান্তে ইউনিয়ন মর্যাদা পাওয়া রত্নাকার বঙ্গোপসাগরের সর্বদক্ষিণ প্রান্তে মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করা ৭ বর্গ কিলোমিটারের সাগরকন্যা সেন্টমার্টিনে যখন পৌঁছলাম, তখন সূর্যিমামা ঠিক মাথার মাঝখানে, দুপুর ১২টা।
টেকনাফের মূল ভূখণ্ড থেকে ৪৫ কিলোমিটার সাগর অভ্যন্তরে সাড়ে সাত হাজার মানুষের ভারাক্রান্ত পদভারে ন্যূব্জ ৫ হাজার বছরের ইতিহাস জানা নীলাভ দ্বীপ ‘সেন্টমার্টিন’। ব্লু মেরিন রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের স্বপ্নিল আতিথেয়তা, সুন্দরী আর উড়ন্ত মাছের স্বাদ গ্রহণের মধ্য দিয়ে পার হলো আমাদের দলের দুপুরটি। হুমায়ূন আহম্মদের ‘সমুদ্র বিলাস’ সেন্টমার্টিনকে দিয়েছে আলাদা প্রচারণা, নতুন করে প্রেরণা। ঘটনাও তাই দেখলাম। এর আগে সমুদ্র বিলাসকে দেখেছিলাম ভঙ্গুর, ক্ষয়িষ্ণু, নিষ্প্রভ। আজ এখানে কয়েকটি কটেজ বাঁশ, কাঠ, খড়, টিন আর মাচানের মাতামাতি। কাজ চলছে দ্রুতলয়ে, রাতারাতি। নোয়াখালী, চট্টগ্রাম আর মিয়ানমার ভাষার সংমিশ্রণে শ্রমিকরা জানাল ব্যবসাবান্ধব কার্যক্রমের উদ্বোধনও খুব সন্নিকটে।
আড়াই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের, দেড় কিলোমিটার প্রস্থের পুরো সেন্টমার্টিনকে পায়ে হেঁটে পরিভ্রমণ করা যায় ২ ঘণ্টা সময়ে। আমরা সে রকম যাত্রায় না গিয়ে রিকশাভ্যান সঙ্গী করলাম। পরিবেশ দফতরের নয়নাভিরাম অবকাঠামো থাকলেও সতর্ক ও সচেতনতামূলক কয়েকটা সাইনবোর্ড ছাড়া তেমন কোনো জোরালো কাজ চোখে পড়ল না। নীল সমুদ্র, নীলদিগন্ত, নীলাকাশ, নীলাচল ইত্যাদি নামীয় রিসোর্টগুলো এর আগে বাঁশ, বেত, কাঠের সুদৃশ্য মিলন দেখেছিলাম। এখন আইন বিরুদ্ধ ইট, লৌহ কংক্রিটের সংমিশ্রণে রীতিমত প্রাসাদোপম।
সরকার নির্ধারিত সুনির্দিষ্ট তারিখের যে পাঁচ মাস সেন্টমার্টিন ভ্রমণের সুযোগ থাকে, তাতে পূর্ণিমা থাকে কয় দিন? সেদিন ছিল পূর্ণিমা, আলোকিত জোত্স্না রাত। আয়োজন হলো বারবি কিউর। আমরা মিশে গেলাম ওখানে অবস্থান নেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকমণ্ডলীর আয়োজনে। হলো কবিতা, গান, বক্তৃতা, অভিজ্ঞতার আলোচনা। ভাটার টানে গর্জনহীন নীল সমুদ্রের দিগন্ত জোড়া বিশাল জলরাশির ওপর যখন পূর্ণিমার নিষ্পাপ আলোকিত ছায়া পড়েছিল, সে দৃশ্য কেবলই দেখার, অনুভবের, উপলব্ধির; কিন্তু প্রকাশের নয়। আমরা বীচ এলাকায় আয়োজন করলাম স্থানীয় শিল্পী আবদুলের গম্ভীরা গানের আসর। খমক, জুরি, ঢোলক আর দোতারার সমন্বয়হীন বাদন, আঞ্চলিক উচ্চারণ, অর্থ উদ্ধার না করতে পারা গীতের সুর ঝংকারও আমাদের নির্ঘুম রাত যাপনে উদ্বুদ্ধ করেছে। তিন বছর যাবত্ নিধনহীন কুকুরের বিশালাকার দলবদ্ধ উদ্দেশ্যহীন ঘেউ ঘেউর মধ্যেও স্মৃতিময় জোছনালোক অবলোকনে রাত ৩টা, কখনও বাজে অনুভব করতে কষ্ট হয়েছে।
পরদিন ভোরে ইঞ্জিন নৌকায় করে ২৫ মিনিট সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম মনুষ্যহীন ছেঁড়াদ্বীপে। ব্রিটিশ সরকার মিয়ানমার আর বাংলাদেশ সীমান্ত পিলার গেড়েছিল ওখানে। ধ্বংসাবশেষ এখনও দেশ দুটিকে আলাদা মর্যাদা দিয়ে থাকে। ছেঁড়াদ্বীপ মূলত মূল সেন্টমার্টিনের অখণ্ড রূপ। চামচের মতো এর লেজ সংযুক্ত সেন্টমার্টিনের সঙ্গে। ভাটার সময় পরিষ্কার হয়ে ওঠে লেজ। মূল অংশ থেকে ছিঁড়ে গেছে বলেই ছেঁড়াদ্বীপ। কয়েক বিঘার এ দ্বীপের চার পাশে রয়েছে সমুদ্রের নানা প্রজাতির জীবন্ত প্রবাল। পরিষ্কার নীল জলের গভীর তলদেশে সামুদ্রিক প্রাণীর মায়াময় কোলাকুলি, দুঃসাহসিক ভ্রমণের সার্থকতা এনে দেয়।
আমরা কথা বললাম পরীর মতো অবস্থান করা দ্বীপের পাহাড়াদার একমাত্র পরিবার হোসান আলীর সঙ্গে। দুই মেয়ে চার ছেলের সংসারের সব কিছু আসে সেন্টমার্টিন থেকে। ছেঁড়াদ্বীপে মনুষ্য খাদ্যতালিকার কোনো কিছুই নেই। চাষাবাদও সম্ভব নয়। কেবলই প্রবাল আর প্রবাল। এত বড় সংসার হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করতে হোসান আলী লজ্জাবনত হাসিতে বললেন, ওঁনার দাদা মিয়ানমারের লোক। বলেছিল কোনটা আলী হবে আর কোনটা অলি হবে কেউ জানে না। কিন্তু হোসান আলী এতদিনে উপলব্ধি করেছেন তার সন্তানরা কেউ আলীও হয়নি, কেউ অলিও হয়নি। তিনি ভুল করেছেন। আমি সেন্টমার্টিনের ১০ শয্যা হাসপাতালের একমাত্র চিকিত্সক ডা. সুমনের ঠিকানা দিলাম। আগের দিন প্রাণময় জোছনা রাতে ডা. সুমনের সঙ্গে দ্বীপসংক্রান্ত বিশেষ তথ্যবহুল মজাদার আলোচনা হয়েছিল। জন্মনিয়ন্ত্রণ থেকে যাবতীয় চিকিত্সা ও ওষুধ সংগ্রহের সুযোগ নিতে হোসান আলীকে অনুরোধ করলাম। সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের দীর্ঘকালের নির্বাচিত চেয়ারম্যান মাওলানা ফিরোজ আলমের সঙ্গে যখন কথা হয়েছিল, তখন তিনি জনসংখ্যার অতিদ্রুত বর্ধনশীলতা সেন্টমার্টিনের জন্য হুমকি বলে মন্তব্য করেছিলেন। ৬৫০ জন ভোটার দিয়ে ৩ দশক আগে ইউনিয়নের যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল। বর্তমানে ২৮০০ ভোটার। ১ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশু রয়েছে ২৩০০। এমন ঘটনাও চলমান যে ১৫টি বিবাহ ৭ স্ত্রীর একত্র সংসার ২৪ সন্তান নিয়ে এক পরিবার। হোসান আলীর সঙ্গে কথা বলে এর রূঢ় সত্যতার বাস্তব মিল খুঁজে পেয়ে বিমর্ষিত হলাম। উপলব্ধি করলাম ব্যক্তি, সমাজ এবং সরকারের সব অর্জন, বিসর্জন হবে, যদি না জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়। সোলার প্যানেল বাধ্যতামূলক নয়, রাত ১১টা পর্যন্ত বিশালাকার সব জেনারেটরের গোঙ্গানি আর কম্পন সেন্টমার্টিনের অবস্থা অনেক আগেই নিয়ন্ত্রণহীন পাগলা ষাঁড়ের মতো। ছেঁড়াদ্বীপের জীবন্ত প্রবালের সঙ্গে মুখোমুখি আর স্মৃতিপূর্ণ কোলাকুলির পর আমরা বিষণ্ন চিত্তে রওনা হলাম আমাদের ফিরতি গন্তব্যে, আমাদের জীবনচক্রে।
সমুদ্র আর সূর্যের আলিঙ্গন ছেঁড়াদ্বীপ
'গোধূলির কোলে ঢলে পড়া সূর্যের সঙ্গে সমুদ্রজলের আলিঙ্গন, প্রবালের বুকে হেঁটে বেড়ানো রঙিন মাছেরা অথবা আকাশপানে ডানা মেলা কোন নাম না জানা পাখির সঙ্গে মিতালি' জলের কাছে জীবনের নোঙ্গর ফেলতে ডাক দেয় ছেঁড়াদ্বীপ_ জানাচ্ছেন_ মোস্তাফিজুর চৌধুরী মোস্তাক
সমুদ্রের সঙ্গে সূর্যের মিতালি দেখতে কার না ভালো লাগে। অনেকে এ মিতালি দেখতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। সমুদ্র আর সূর্যের আলিঙ্গন দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন পর্যটকরা। ভূমির প্রকৃতি ও আকৃতির কারণে বাংলাদেশকে বলা হয় বদ্বীপ। এ বদ্বীপ সদৃশ বাংলাদেশেই আছে দেখার মতো অনেক কিছু। এ দেশের বন-জঙ্গল পাহাড় আর সমুদ্রের সৌন্দর্য দেখে থমকে দাঁড়াতে হয় যে কোন পর্যটককে। আরএ সৌন্দর্য দেখতে প্রতিবছর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক ভিড় জমায় বাংলাদেশে। বলছিলাম সূর্য আর সমুদ্রের আলিঙ্গনের কথা। বাংলাদেশের ছেঁড়াদ্বীপে গেলে আপনি দেখতে পাবেন আলিঙ্গনের সেই সন্ধিক্ষণ। প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই ছেঁড়াদ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের গা ঘেঁষে জেগে উঠেছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। আর সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে অবস্থিত ছেঁড়াদ্বীপ। স্থানীয়রা ছেঁড়াদ্বীপকে সেন্টমার্টিনের লেজ বলে থাকেন। তবে ছেঁড়াদ্বীপকে সেন্টমার্টিনের লেজ বললেও সাম্প্রতিক সময়ে ছেঁড়াদ্বীপ সেন্টমার্টিন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যে কারণে ছেঁড়াদ্বীপের সৌন্দর্য বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। গভীর সমুদ্রের জলরাশির মধ্যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসেবে এর সৌন্দর্য অন্যরকম। যেন সুন্দর কোন মুখশ্রীর কপালের মাঝে জেগে থাকা টিপ। সুন্দর তবে সৌন্দর্য প্রকাশের ধরনটা একটু ভিন্ন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট দ্বীপ হলো ছেঁড়াদ্বীপ। অনেকে ছেঁড়াদ্বীপকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের অংশ মনে করলেও আসলে ছেঁড়াদ্বীপ একটি প্রবাল দ্বীপ। সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রাণীর অস্তিত্ব থাকলেও ছেঁড়াদ্বীপে প্রবাল ও পলি মাটির ওপর জেগে ওঠা সবুজের সমারোহ ছাড়া আর কিছু নেই। তবে এ সবুজের সমারোহই ছেঁড়াদ্বীপকে দিয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। ভাটার সময় সামুদ্রিক কাঁকড়া ফেরে আপন আলয়ে। তাই বলা যায়, সামুদ্রিক কাঁকড়া ও ছোট প্রজাতির মাছদের বেড়ানোর জায়গা ছেঁড়াদ্বীপ। জোয়ার-ভাটার মধ্যবর্তী সময় এখানে বেড়াতে আসে দেশি-বিদেশি অসংখ্য পর্যটক। তখন সমুদ্রের অতিথিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের একটা সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে। সামুদ্রিক প্রাণীদের সঙ্গে দুষ্টুমি করতে করতে কখন যে সময় পার হয়ে যাবে তা বুঝতেও পারা যায় না। ছেঁড়াদ্বীপের প্রবালের সৌন্দর্য দেখে অনেকেই অভিভূত হয়ে পড়েন। প্রবালকে অনেকে সামদ্রিক জীব, কেউ কেউ আবার সামুদ্রিক উদ্ভিদ বলে থাকেন। স্তরে স্তরে সাজানো প্রবালের সঙ্গে প্রবালের নিবিড়তম সম্পর্ক ইচ্ছে করলেই ক্যামেরাবন্দী করা সম্ভব। দেশের সবচেয়ে ছোট এ দ্বীপের যে সৌন্দর্য দেখতে পর্যটকরা ভিড় করেন, তা হলো সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত।
মূল ভূখ- থেকে ছেঁড়াদ্বীপ অনেকটা দূরে। আর তাই সূর্যোদয় দেখাটা অনেকাংশেই কঠিন। তবে সূর্যোদয় না দেখতে পারলেও সূর্যাস্তের সৌন্দর্য অবশ্যই দেখতে পাওয়া যায়। সূর্যাস্তের সময় পশ্চিমাকাশ টকটকে লাল হয়ে যায়। সেই সঙ্গে লাল রঙের আভায় ভরে ওঠে সমুদ্রের গভীর জলরাশি।
সূর্যটা আকাশ থেকে নামতে নামতে হঠাৎ করে এমনভাবে উধাও হয়ে যায় মনে হয় নিমিষেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল। মনে হবে সূর্যটা পানির নিচে ডুবে গেছে। ছেঁড়াদ্বীপে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালে জলরাশি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়বে না। সূর্যাস্তের পর গোধূলির আলোয় মূল ভূখ-ে ফিরতে হবে। তা না হলে জোয়ারের সময় বড় বড় ঢেউয়ে ভয়ের জুজু ধরে বসতে পারে।
কীভাবে যাবেন
টেকনাফ থেকে ট্রলার কিংবা সি-ট্রাকে করে সেন্টমার্টিন ঘেঁষে ছেঁড়াদ্বীপ যাওয়া যায়। যাওয়ার সময় মনে করে অবশ্যই ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা সঙ্গে নেবেন।
Source: Daily Sangbad
সমুদ্রের সঙ্গে সূর্যের মিতালি দেখতে কার না ভালো লাগে। অনেকে এ মিতালি দেখতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। সমুদ্র আর সূর্যের আলিঙ্গন দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন পর্যটকরা। ভূমির প্রকৃতি ও আকৃতির কারণে বাংলাদেশকে বলা হয় বদ্বীপ। এ বদ্বীপ সদৃশ বাংলাদেশেই আছে দেখার মতো অনেক কিছু। এ দেশের বন-জঙ্গল পাহাড় আর সমুদ্রের সৌন্দর্য দেখে থমকে দাঁড়াতে হয় যে কোন পর্যটককে। আরএ সৌন্দর্য দেখতে প্রতিবছর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক ভিড় জমায় বাংলাদেশে। বলছিলাম সূর্য আর সমুদ্রের আলিঙ্গনের কথা। বাংলাদেশের ছেঁড়াদ্বীপে গেলে আপনি দেখতে পাবেন আলিঙ্গনের সেই সন্ধিক্ষণ। প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই ছেঁড়াদ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের গা ঘেঁষে জেগে উঠেছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। আর সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে অবস্থিত ছেঁড়াদ্বীপ। স্থানীয়রা ছেঁড়াদ্বীপকে সেন্টমার্টিনের লেজ বলে থাকেন। তবে ছেঁড়াদ্বীপকে সেন্টমার্টিনের লেজ বললেও সাম্প্রতিক সময়ে ছেঁড়াদ্বীপ সেন্টমার্টিন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যে কারণে ছেঁড়াদ্বীপের সৌন্দর্য বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। গভীর সমুদ্রের জলরাশির মধ্যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসেবে এর সৌন্দর্য অন্যরকম। যেন সুন্দর কোন মুখশ্রীর কপালের মাঝে জেগে থাকা টিপ। সুন্দর তবে সৌন্দর্য প্রকাশের ধরনটা একটু ভিন্ন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট দ্বীপ হলো ছেঁড়াদ্বীপ। অনেকে ছেঁড়াদ্বীপকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের অংশ মনে করলেও আসলে ছেঁড়াদ্বীপ একটি প্রবাল দ্বীপ। সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রাণীর অস্তিত্ব থাকলেও ছেঁড়াদ্বীপে প্রবাল ও পলি মাটির ওপর জেগে ওঠা সবুজের সমারোহ ছাড়া আর কিছু নেই। তবে এ সবুজের সমারোহই ছেঁড়াদ্বীপকে দিয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। ভাটার সময় সামুদ্রিক কাঁকড়া ফেরে আপন আলয়ে। তাই বলা যায়, সামুদ্রিক কাঁকড়া ও ছোট প্রজাতির মাছদের বেড়ানোর জায়গা ছেঁড়াদ্বীপ। জোয়ার-ভাটার মধ্যবর্তী সময় এখানে বেড়াতে আসে দেশি-বিদেশি অসংখ্য পর্যটক। তখন সমুদ্রের অতিথিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের একটা সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে। সামুদ্রিক প্রাণীদের সঙ্গে দুষ্টুমি করতে করতে কখন যে সময় পার হয়ে যাবে তা বুঝতেও পারা যায় না। ছেঁড়াদ্বীপের প্রবালের সৌন্দর্য দেখে অনেকেই অভিভূত হয়ে পড়েন। প্রবালকে অনেকে সামদ্রিক জীব, কেউ কেউ আবার সামুদ্রিক উদ্ভিদ বলে থাকেন। স্তরে স্তরে সাজানো প্রবালের সঙ্গে প্রবালের নিবিড়তম সম্পর্ক ইচ্ছে করলেই ক্যামেরাবন্দী করা সম্ভব। দেশের সবচেয়ে ছোট এ দ্বীপের যে সৌন্দর্য দেখতে পর্যটকরা ভিড় করেন, তা হলো সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত।
মূল ভূখ- থেকে ছেঁড়াদ্বীপ অনেকটা দূরে। আর তাই সূর্যোদয় দেখাটা অনেকাংশেই কঠিন। তবে সূর্যোদয় না দেখতে পারলেও সূর্যাস্তের সৌন্দর্য অবশ্যই দেখতে পাওয়া যায়। সূর্যাস্তের সময় পশ্চিমাকাশ টকটকে লাল হয়ে যায়। সেই সঙ্গে লাল রঙের আভায় ভরে ওঠে সমুদ্রের গভীর জলরাশি।
সূর্যটা আকাশ থেকে নামতে নামতে হঠাৎ করে এমনভাবে উধাও হয়ে যায় মনে হয় নিমিষেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল। মনে হবে সূর্যটা পানির নিচে ডুবে গেছে। ছেঁড়াদ্বীপে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালে জলরাশি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়বে না। সূর্যাস্তের পর গোধূলির আলোয় মূল ভূখ-ে ফিরতে হবে। তা না হলে জোয়ারের সময় বড় বড় ঢেউয়ে ভয়ের জুজু ধরে বসতে পারে।
কীভাবে যাবেন
টেকনাফ থেকে ট্রলার কিংবা সি-ট্রাকে করে সেন্টমার্টিন ঘেঁষে ছেঁড়াদ্বীপ যাওয়া যায়। যাওয়ার সময় মনে করে অবশ্যই ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা সঙ্গে নেবেন।
Source: Daily Sangbad
পাথর উত্তোলন, প্রবাল শৈবাল আহরণ চলছে:
হুমকির মুখে ছেঁড়াদ্বীপ
বাংলাদেশের মানচিত্রে সর্বদক্ষিণের বিন্দুটি হচ্ছে ছেঁড়াদিয়া বা ছেঁড়াদ্বীপ। এই দ্বীপে এখনো জনবসতি গড়ে ওঠেনি। দ্বীপের চারদিকে পাথরের রাজ্য। ভূ-ভাগ সবুজ কেয়াগাছে ভরা। জোয়ারের সময় চার একরের দ্বীপটির চারদিক ডুবে গেলে বাকি ভূখণ্ড মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে।
গত সোমবার সকালে এই দ্বীপ পরিদর্শন করে এখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন দেখে হতাশ হন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) নূর মোহাম্মদ।
দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার ব্যাপারে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে গত রোববার দুপুর সাড়ে ১২টায় আইজিপি নূর মোহাম্মদ সেন্ট মার্টিনে যান। ওই দিন বেলা তিনটা পর্যন্ত তিনি হেঁটে হেঁটে দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাথর উত্তোলন, সৈকত দখল করে দোকানপাট, বসতবাড়িসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ পরিদর্শন করেন। বিকেল পাঁচটায় তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে মতবিনিময় সভা করেন। সভায় দ্বীপের কয়েক শ মানুষ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে পাথর উত্তোলন, প্রবাল-শৈবাল আহরণ ও বিক্রি বন্ধসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষার শপথ নেয়। পরদিন সকাল ১০টায় আইজিপি সেন্ট মার্টিন থেকে কোস্টগার্ড বাহিনীর একটি স্পিডবোটে করে ছেঁড়াদ্বীপ পরিদর্শনে যান।
আইজিপি নূর মোহাম্মদ জীবনের প্রথম ছেঁড়াদ্বীপের মাটিতে পা রেখে বললেন, ‘কী সুন্দর দ্বীপ! জীবনে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আরেকবার আসার সুযোগ পাই কিনা আল্লাহ জানে।’
আইজিপির সঙ্গে ছিলেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আসাদুজ্জামান মিয়া, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসাইনসহ পুলিশ ও কোস্টগার্ডের কয়েকজন সদস্য।
দ্বীপে উঠে সবাইকে নিয়ে আইজিপি হাঁটা শুরু করেন। ২০ কদম যেতেই তাঁর সামনে পড়েন নারায়ণগঞ্জ থেকে ভ্রমণে আসা এক ব্যক্তি। তাঁর হাতে তিন টুকরো প্রবাল। আইজিপির প্রশ্নের জবাবে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘প্রবালগুলো সুন্দর লেগেছে, তাই ভেঙে সঙ্গে নিলাম।’ নূর মোহাম্মদ প্রবাল-শৈবাল, শামুক-ঝিনুক আহরণকারী এ রকম আরও কয়েকজনকে ডেকে বলেন, ‘প্রবাল-শৈবাল আহরণ ও বিপণন নিষিদ্ধ তা আপনারা জানেন না? এর কারণে যে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়, আপনারা নিশ্চয় জানেন? বাংলাদেশের সর্বশেষ ভূখণ্ডটিকে অন্তত বাঁচিয়ে রাখুন।’ এরপর লোকজন হাতে থাকা, ব্যাগে রাখা প্রবাল-শৈবালগুলো সাগরের পানিতে রেখে দেয়।
ছেঁড়াদ্বীপে পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রত্যয় নামের একটি বেসরকারি সংস্থার তিনটি সাইনবোর্ড নজরে পড়লেও এদের কাউকে দ্বীপে দেখা যায়নি। ছোট্ট দ্বীপটিও পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, ডাবের খোসায় ভরা।
সেখানকার অস্থায়ী রেস্তোরাঁর মালিক সেন্ট মার্টিনের আবদুল শুক্কুর (৪৫) জানান, স্থানীয় লোকজন প্রবাল-শৈবাল আহরণ করে না। পর্যটকেরা ফিরে যাওয়ার সময় এসব আহরণ করে নিয়ে যায়। নিষেধ করলে তারা শোনে না। ডাব বিক্রেতা সৈয়দ নূর জানান, আগে সেন্ট মার্টিনের কয়েকজন প্রভাবশালী ছেঁড়াদ্বীপ থেকে বিপুল পরিমাণ প্রবাল-শৈবাল, শামুক-ঝিনুক আহরণ করে ট্রলারযোগে কক্সবাজারে পাচার করতেন। গত রোববার থেকে তা বন্ধ রয়েছে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান জানান, দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পুলিশের এই উদ্যোগে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে এবং দায়িত্ববোধ কাজ করছে।
বিকেল সাড়ে তিনটায় ছেঁড়াদ্বীপ ত্যাগ করে সেন্ট মার্টিন থেকে টেকনাফগামী জাহাজে ওঠার সময় জেটির মাঝপথে দেখা গেল, তিন ব্যক্তি হাতমাইকে ঘোষণা করছেন, ‘সম্মানীত পর্যটকবৃন্দ। আপনাদের হাতে প্রবাল ও শৈবাল থাকলে দয়া করে এখানে রেখে যান। এসব আহরণ, সংগ্রহ, সরবরাহ একেবারে নিষিদ্ধ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।’
লোকজন ব্যাগ, প্যান্ট, জ্যাকেট ও কোটের পকেট থেকে প্রবাল-শৈবাল, শামুক-ঝিনুক বের করে জমা দিয়ে জাহাজে উঠছে। উদ্ধারকর্মী আনোয়ার হোসেন জানান, এখন থেকে প্রতিদিন জাহাজ থেকে নামার সময় পর্যটকদের এ ব্যাপারে সতর্ক করা হবে এবং ওঠার সময় তল্লাশির ব্যবস্থা চলবে।
Source: Daily Prothom Alo
গত সোমবার সকালে এই দ্বীপ পরিদর্শন করে এখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন দেখে হতাশ হন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) নূর মোহাম্মদ।
দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার ব্যাপারে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে গত রোববার দুপুর সাড়ে ১২টায় আইজিপি নূর মোহাম্মদ সেন্ট মার্টিনে যান। ওই দিন বেলা তিনটা পর্যন্ত তিনি হেঁটে হেঁটে দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাথর উত্তোলন, সৈকত দখল করে দোকানপাট, বসতবাড়িসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ পরিদর্শন করেন। বিকেল পাঁচটায় তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে মতবিনিময় সভা করেন। সভায় দ্বীপের কয়েক শ মানুষ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে পাথর উত্তোলন, প্রবাল-শৈবাল আহরণ ও বিক্রি বন্ধসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষার শপথ নেয়। পরদিন সকাল ১০টায় আইজিপি সেন্ট মার্টিন থেকে কোস্টগার্ড বাহিনীর একটি স্পিডবোটে করে ছেঁড়াদ্বীপ পরিদর্শনে যান।
আইজিপি নূর মোহাম্মদ জীবনের প্রথম ছেঁড়াদ্বীপের মাটিতে পা রেখে বললেন, ‘কী সুন্দর দ্বীপ! জীবনে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আরেকবার আসার সুযোগ পাই কিনা আল্লাহ জানে।’
আইজিপির সঙ্গে ছিলেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আসাদুজ্জামান মিয়া, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসাইনসহ পুলিশ ও কোস্টগার্ডের কয়েকজন সদস্য।
দ্বীপে উঠে সবাইকে নিয়ে আইজিপি হাঁটা শুরু করেন। ২০ কদম যেতেই তাঁর সামনে পড়েন নারায়ণগঞ্জ থেকে ভ্রমণে আসা এক ব্যক্তি। তাঁর হাতে তিন টুকরো প্রবাল। আইজিপির প্রশ্নের জবাবে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘প্রবালগুলো সুন্দর লেগেছে, তাই ভেঙে সঙ্গে নিলাম।’ নূর মোহাম্মদ প্রবাল-শৈবাল, শামুক-ঝিনুক আহরণকারী এ রকম আরও কয়েকজনকে ডেকে বলেন, ‘প্রবাল-শৈবাল আহরণ ও বিপণন নিষিদ্ধ তা আপনারা জানেন না? এর কারণে যে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়, আপনারা নিশ্চয় জানেন? বাংলাদেশের সর্বশেষ ভূখণ্ডটিকে অন্তত বাঁচিয়ে রাখুন।’ এরপর লোকজন হাতে থাকা, ব্যাগে রাখা প্রবাল-শৈবালগুলো সাগরের পানিতে রেখে দেয়।
ছেঁড়াদ্বীপে পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রত্যয় নামের একটি বেসরকারি সংস্থার তিনটি সাইনবোর্ড নজরে পড়লেও এদের কাউকে দ্বীপে দেখা যায়নি। ছোট্ট দ্বীপটিও পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, ডাবের খোসায় ভরা।
সেখানকার অস্থায়ী রেস্তোরাঁর মালিক সেন্ট মার্টিনের আবদুল শুক্কুর (৪৫) জানান, স্থানীয় লোকজন প্রবাল-শৈবাল আহরণ করে না। পর্যটকেরা ফিরে যাওয়ার সময় এসব আহরণ করে নিয়ে যায়। নিষেধ করলে তারা শোনে না। ডাব বিক্রেতা সৈয়দ নূর জানান, আগে সেন্ট মার্টিনের কয়েকজন প্রভাবশালী ছেঁড়াদ্বীপ থেকে বিপুল পরিমাণ প্রবাল-শৈবাল, শামুক-ঝিনুক আহরণ করে ট্রলারযোগে কক্সবাজারে পাচার করতেন। গত রোববার থেকে তা বন্ধ রয়েছে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান জানান, দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পুলিশের এই উদ্যোগে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে এবং দায়িত্ববোধ কাজ করছে।
বিকেল সাড়ে তিনটায় ছেঁড়াদ্বীপ ত্যাগ করে সেন্ট মার্টিন থেকে টেকনাফগামী জাহাজে ওঠার সময় জেটির মাঝপথে দেখা গেল, তিন ব্যক্তি হাতমাইকে ঘোষণা করছেন, ‘সম্মানীত পর্যটকবৃন্দ। আপনাদের হাতে প্রবাল ও শৈবাল থাকলে দয়া করে এখানে রেখে যান। এসব আহরণ, সংগ্রহ, সরবরাহ একেবারে নিষিদ্ধ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।’
লোকজন ব্যাগ, প্যান্ট, জ্যাকেট ও কোটের পকেট থেকে প্রবাল-শৈবাল, শামুক-ঝিনুক বের করে জমা দিয়ে জাহাজে উঠছে। উদ্ধারকর্মী আনোয়ার হোসেন জানান, এখন থেকে প্রতিদিন জাহাজ থেকে নামার সময় পর্যটকদের এ ব্যাপারে সতর্ক করা হবে এবং ওঠার সময় তল্লাশির ব্যবস্থা চলবে।
Source: Daily Prothom Alo