ভ্রমণ : গগনচুম্বী পর্বত ও রূপবৈচিত্র্যে অনন্য নেপাল
হাতে কিছু সময় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম নেপালের উদ্দেশে। আমার সফরসঙ্গী হাসান রকিব নামের এক সুদর্শন যুবক। আমরা দু’জনই নতুন। এর আগে কখনও নেপাল যাওয়া হয়নি। তাই ভরসা করতে হয়েছে শামসুল আলম বাবু ভাইয়ের ওপর। বাবু তখন নেপালে অবস্থান করছেন। একদিন আগে এই সুসংবাদটি হাসান রকিবই আমাকে দিয়েছে। এর আগে শামসুল আলম বাবু ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে আমার বিজয়নগরের অফিসে। রকিব তাকে অফিসে নিয়ে এসেছিল। পরিচিত হওয়ার সময় জেনেছি, তিনি একজন পর্বতারোহী। নেপালে যাচ্ছেন এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার জন্য। তখন তাকে বলে রেখেছিলাম, এভারেস্ট জয়ের পর নেপালে থাকা অবস্থায় দেশে আসার আগে আমাদের জানাবেন। আমরা নেপালে চলে আসব। বাবু ভাই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে পর্বতের চূড়ায় উঠতে না পারলেও কথা রেখেছেন। পর্বত থেকে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে আমাদের জানালেন। তাই যে কথা সেই কাজ। শুরু হলো নেপাল যাত্রা। মতিঝিলের ভার্সেন্টাইল ট্রাভেলস থেকে বাংলাদেশ বিমানের টিকিট নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নেপাল যাত্রা শুরু করলাম। দুপুর ১টায় বিমান ছাড়ার নির্দিষ্ট সময় থাকলেও বিমানবন্দরে পৌঁছতে হয়েছে বেলা ১১টায়। বিমান ছাড়ার ২০ মিনিট আগে বিমানে ওঠার সুযোগ হয়েছে।
যাত্রী কিছু কম থাকায় নিজ দায়িত্বে বসে পড়লাম জানালার পাশে। এয়ারপোর্ট থেকে বিমান ছাড়ার ১৫ মিনিট পর দূরের এক প্রান্তে দেখতে পেলাম মেঘে ঢাকা ধূসর পাহাড়। তুলোর মতো থোকা থোকা মেঘের কণা ভাসতে থাকে আকাশ পানে। চোখের দৃষ্টি এড়াতে পারল না এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। ক্ষণিকের জন্য হলেও ভ্রমণের সঙ্গী হলো বরফে ঢাকা হিমালয়ের উঁচু পাহাড়গুলো। যেন স্বপ্নের মাঝে বিলীন হয়ে গেলাম, হারিয়ে গেলাম অন্য জগতে। স্বপ্ন ভাঙল ঠিক দেড় ঘণ্টা পর, যখন বিমান নিচে নামতে শুরু করছে। নিচে তাকিয়ে দেখলাম একটু পরে বিমান ল্যান্ড করবে নেপালের ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের রানওয়েতে।
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। কোনো হৈ-হুল্লোড় নেই, কুলি-মজুর বা লাল-নীল বাহিনীর টানা-হেঁচড়া নেই, একেবারে শান্ত পরিবেশ। বিশাল এলাকা নিয়ে বিমানবন্দরের লাউঞ্জ। দেয়াল ও থামে প্রাচীন ঐতিহ্যের সাজসজ্জা। আধুনিকতার সঙ্গে প্রাচীন ঐতিহ্যের সমন্বয়ে সাজানো বিমানবন্দর এলাকা। বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনে সব মিলে সময় ব্যয় হলো এক ঘণ্টা। ইমিগ্রেশন থেকে দেয়া হলো পোর্ট এন্ট্রি, এক মাসের ট্যুরিস্ট ভিসা। কার্য সম্পাদন, এগিয়ে চলছি, এবার বের হওয়ার পালা। এক্সিট গেটের সামনে অনেকেই আসছে তাদের প্রিয়জনদের এগিয়ে নিয়ে যেতে। যাদের নেপালে কোনো প্রিয়জন নেই, আমাদের মতো ট্যুরিস্ট, যারা আগেই দেশ থেকে নেপালের হোটেলে রুম বুকিং দিয়ে এসেছেন অথবা কোনো ট্যুরিজম কোম্পানির প্যাকেজে যারা আসছেন—তাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে এসেছেন কিছু লোক। হাতে, বুকে বা গলায় ঝোলানো প্ল্যাকার্ড অথবা আর্ট কোডে ইংরেজিতে বড় বড় করে লেখা আগমনকারীর নাম। দেখলেই বোঝা যায় এরা হোটেল বয়, কর্মচারী। তবে তাদের মধ্যে আমাদের পরিচিত কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। বাবু ভাই বলেছিলেন আমাদের এগিয়ে নিতে বিমানবন্দরে আসবেন, এমনকি আমাদের জন্য হোটেলে রুম বুকিং করা পর্যন্ত কনফার্ম করেছিলেন বিমানে ওঠার আগে মোবাইলে। তাহলে এলেন না কেন? আবার পরক্ষণে সাহসের ওপর নির্ভর হয়ে ভাবছি, আমদের যখন হাতছানি দিয়ে ডাকছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, ঘন নিরক্ষীয় বনাঞ্চল, সমৃদ্ধ প্রাণীজগত, খরস্রোতা নদী, গাছ-গাছালি ঘেরা পাহাড় ও বরফজমা উপত্যকা—তাহলে ভয় কিসের?
গেট পার হয়ে যখন ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ভবনের বাইরে, তখন তাকিয়ে দেখি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন শামসুল আলম বাবু ও মি. দাওয়া। সঙ্গে ড্রাইভারসহ মাইক্রোবাস। তার মানে মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। তাও আবার নেপালে। পরিচিত হয়ে নিলাম বাবড়ি চুলওয়ালা নেপালি যুবক মি. দাওয়ার সঙ্গে। এবার গাড়িতে চেপে রুমে যাওয়ার পালা। রুম মানে কোনো একটি হোটেলের কক্ষ। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি চলছে থামেলের উদ্দেশে। জেনে নিলাম আমদের গন্তব্য নেপালের ট্যুরিস্ট এরিয়া থামেলের নরবোলিংকা গেস্ট হাউস। বিকাল চারটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম থামেলের নরবোলিংকা গেস্ট হাউসে। এরই মধ্যে আলাপচারিতা করে দাওয়ার সঙ্গে আমি কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। বুঝতে আর কষ্ট হলো না যে, নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে আগত পর্যটকদের কাছে থামেল নামক স্থানটি বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। জনসংখ্যার দিক দিয়ে এলাকাটি ঘনবসতিপূর্ণ হলেও যাবতীয় কেনাকাটা ছাড়াও এখানে বিভিন্ন ট্যুরিস্ট এজেন্সি, ট্রাভেল এজেন্সি, ভ্রমণ উপকরণের বৈচিত্র্য রয়েছে। এ কারণে বিদেশি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান থামেল। সস্তা থেকে শুরু করে মধ্যম ব্যয়ের পর্যটকদের জন্য এই স্থানের কোনো বিকল্প নেই। এছাড়াও স্বল্প দূরত্বের ভেতর আছে সুপার মার্কেট, নাইট ক্লাব, ড্যান্স বার, নেপালি লোকজ সঙ্গীতের আসর, বিভিন্ন ঘরানার রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি। তাই থামেল জুড়ে সব সময় থাকে বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা।
হোটেল রুমে ঢুকতেই এক নতুন অভিজ্ঞতা। রুমের কোথাও কোনো সিলিং ফ্যান বা এসি নেই। বোঝা গেল নেপালে সারা বছর ঠাণ্ডা লেগে থাকে, তাই এসি-ফ্যানের প্রয়োজন হয় না। ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে প্রবেশ করতেই আরেক বিপত্তি। গরম পানির কল দিয়ে ঠাণ্ডা পানি বের হচ্ছে। রুমটি ঘোলাটে, ফকফকা আলো নেই, তার মানে এখানে এনার্জি বাল্ব ঠিকই আশি পার্সেন্ট বিদ্যুত্ সেভ করছে, তখন বুঝতে আর দেরি হলো না, হোটেলটি সৌর বিদ্যুত্চালিত। শুধু এই হোটেলটিই নয়, পুরো কাঠমান্ডু শহর জুড়ে রয়েছে সৌর বিদ্যুতের সাপ্লাই। সারা দিন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে একটানা চৌদ্দ ঘণ্টাই লোডশেডিং, বাকি দশ ঘণ্টা বিদ্যুত্ থাকে। তবে আমাদের দেশের মতো বিদ্যুত্ আসে আর যায় না। এক টানা দশ ঘণ্টাই বিদ্যুত্ থাকে। সন্ধ্যা নাগাদ আমাদের বের হওয়ার কথা। এটি আগের নির্ধারণ করা সময়। বাইরে মাঘ মাসের ঘন কুয়াশার মতো অবস্থা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আগের অভিজ্ঞতা না থাকায় ছাতা নিয়ে যাওয়া হয়নি। ব্যাগে গিন্নির গুঁজে দেয়া মাফলারটি মাথা ও দু’কানে পেঁচিয়ে বের হব, এসময় শামসুল আলম বাবু ভাই বললেন—এই মিয়া এইটা কী পরছেন? এখানে কেউ মাফলার পরে না। পরলে সমস্যা কী? ভারতীয়দের মতো মনে হয়। ভারতীয়দের নেপালিরা ঘৃণার চোখে দেখে। মাফলার পরে বের হলে আপনার সঙ্গে কেউ ভালো ব্যবহার করবে না।
কারণ হিসেবে অনুসন্ধানে যা পাওয়া গেল, তা এরকম—বিশাল এলাকা নিয়ে নেপালের অবস্থান। যার শুরুটা আফগানিস্তান এবং শেষটা আসাম। যার আয়তন ১,৪৭,১৮১ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ। এই মানুষগুলোর ভাগ্য কেড়ে নিয়েছে নেপালের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। শোষণ করে যাচ্ছে যুগের পর যুগ। বছরের পর বছর। যে কারণে এখনও নেপাল বিশ্বের মানচিত্রে গরিব দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশ্বের অন্যতম পর্যটনের দেশ হিসেবে নেপালিদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। পৃথিবীর অন্য কোনো রাষ্ট্রে ভারতীয় মুদ্রা চালু থাকার প্রথা না থাকলেও নেপালকে বাধ্য করা হয়েছে। দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ লোক কৃষি পেশার ওপর নির্ভরশীল থাকলেও তাদের কৃষিপণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করা হয় ভারতের কাছে। ভারত যেসব নদী থেকে বিদ্যুত্ উত্পাদন করছে, তার বেশিরভাগই হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল থেকে উত্পন্ন এবং অধিকাংশ নদীর উত্পত্তিস্থল নেপালের বিভিন্ন পর্বতের হিমবাহ থেকে। এজন্য ভারত নেপালকে বঞ্চিত রেখেছে বিদ্যুত্ উত্পাদন করা থেকে। আন্তর্জাতিক রুট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারত নেপালকে বাধ্য করছে তাদের রুট ব্যবহারের জন্য। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে নেপালকে ভারতীয় পোর্ট ব্যবহার করতে হয়। অথচ ভারতের পরিবর্তে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম পোর্ট ব্যবহার করে নেপাল খুব সহজে কম সময়ের মধ্যে পণ্য আমদানি-রফতানি করতে পারে। নেপালের জাতীয় আয়ের প্রধান উত্স পর্যটন। কিন্তু ভারতীয়দের নেপালে যেতে কোনোরকম ভিসা-পাসপোর্টের প্রয়োজন হয় না। এমনকি তাদের নেপাল ভ্রমণে ডলার বেচাকেনার ঝামেলাও পোহাতে হয় না। নেপালে ভারতের মুদ্রা চালু রাখতে বাধ্য করায় ভারতীয়রা নির্বিঘ্নে নেপাল ভ্রমণে ভারতীয় মুদ্রা খরচ করে। এতে লাভবান হয় ভারতীয় সরকার। আর ঝুটঝামেলা পোহাতে হয় নেপালকে। মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ১ ডলার সমান ৭৮-৮০ নেপালি রুপি। (চলবে)